পূর্ব প্রকাশিতের পর,
কেন্দ্রিত অর্থনীতির পরিকাঠামোর (ষ্ট্রাক্চার) পরিচয় পাওয়া গেল৷ এবার আসা যাক ভিতরের পাচনতন্ত্র ও সংবহনতন্ত্রে৷ বলাবাহুল্য, বিকেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থাকে মাটির পৃথিবীতে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে কতগুলো নীতি প্রয়োগের আবশ্যকতা রয়েছে৷ যথা ১) প্রথম নীতি হল--- একটি সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলের সমস্ত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করবে স্থানীয় মানুষ৷ অর্থাৎ মানুষের ন্যুনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির খাতিরে অত্যাবশ্যক দ্রব্যের উৎপাদনে যে সমস্ত আর্থিক সম্পদের দরকার তা অবশ্যই থাকবে স্থানীয় মানুষের হাতে৷ আরও মনে রাখতে হবে--- স্থানীয় অঞ্চলের (প্রতিটি সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলের) অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে স্থানীয় অঞ্চলের কাঁচামালের সর্বাধিক উপযোগ নিয়ে এবং তা দিয়েই ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করতে হবে৷ তাই সেইসব সম্পদের উপযোগ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে স্থানীয় মানুষেরাই৷
কিন্তু প্রশ্ণ হল---বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এই নীতির গ্রহণযোগ্যতা কতটা? উত্তরের প্রথমেই বলতে হয় যে বিপদের কথাটা তথা আশঙ্কার (অ্যালার্মিং) কথাটা হচ্ছে---বহিরাগতরা স্থানীয় আর্থিক কার্যকলাপে বা উৎপাদন তথা বন্টনে নাক গলালে বা হস্তক্ষেপ করলে পদে পদে স্থানীয় এলাকা থেকে তারা সম্পদের বহিঃস্রোত ঘটাবে (ঘটানোর সুযোগ - সম্ভাবনা থেকেই যাবে)৷ ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলটি ভয়ঙ্কর শোষণের কবলে পড়বে৷ দ্বিতীয়তঃ ---বহিরাগতদের আর্থিক মাতববরিতে এবং তাদের ক্রমশঃ সংখ্যা-বৃদ্ধিতে জনবিন্যাসটাই পালটে যেতে পারে৷ ফলে স্থানীয় মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক তথা সংখ্যা লঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে, এমনকি উদ্বাস্তু ছিন্নমূল হওয়াটাও বিচিত্র নয়৷ পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি আছে৷ কাজেই বিশ্বায়নের মহানুভবতার মেকি বুলির আড়ালের কুটচালকে, সূদূরপ্রসারী শোষণের ধান্দাকে বরদাস্ত করা যায় না৷
প্রাসঙ্গিকভাবেই আবার প্রশ্ণ এসে যায়---স্থানীয় কারা? বহিরাগত কারা? ---কোন সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলের বসবাসকারী স্থানীয় মানুষ তারাই--- যারা সেখানকার ভাষা-সাংস্কৃতিকও সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের ব্যষ্টি স্বার্থকে একাত্ম করে দিয়েছে৷ এখানে কোনস্পষ্টতা নেই, বিতর্কের কোন অবকাশ নেই৷ আর এই নির্ণয়ে মানুষের গায়ের রঙ, তার জাত-পাত, শ্রেণী,গোষ্ঠী, গোত্র, সম্প্রদায়, ধর্মবিশ্বাস, জন্মস্থানের সঙ্গে কোন সম্পর্কে নেই৷ আসল কথাটা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রত্যেকটা মানুষ তথা পরিবার তাদের ব্যাষ্টিগত সামাজিক অর্থনৈতিক ও ভাষা-সাংস্কৃতিক স্বার্থকে স্থানীয় সামূহিক স্বার্থের সঙ্গে একাত্ম করতে পেরেছে কিনা৷ বলাবাহুল্য, এই ভিত্তিতেই যে কেউ স্থানীয় মানুষ বলে স্বীকৃতি পাবে, নয়তো এই শর্ত লঙ্ঘন করলে বহিরাগত বলে চিহ্ণিত হবে৷
এই প্রসঙ্গে আরো স্মরণীয়, উপভোক্তাদের মধ্যে থাকে সাধারণ মানুষ ও বিশেষ বিশেষ কাজের জন্যে বিশেষ গুণসম্পন্ন গুণীমানুষ বা প্রতিভাবানেরা৷ তাই মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির ক্ষেত্রে আরেকটি আবশ্যিক নীতি থাকতে হবে যে স্থানীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির চাহিদা মেটানোর পর যে সম্পদ উদ্বৃত্ত দিতে হবে৷ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত বিশেষ গুনসম্পন্ন মানুষদের দেওয়াএই বিশেষ সুবিধা (অ্যামেনিটিজ্) তাঁদের সমাজের বৃহত্তর দেবায় উদ্বুদ্ধ করবে ইন্সেন্টিভ হিসেবে কাজ করবে৷ তবে সমাজের আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে এমন সুযোগ থাকতে হবে যাতে সকলের নূ্যনতম প্রয়োজন ও প্রতিভাবানদের বিশেষ সুবিধা---এই দু’য়ের মধ্যেকার ব্যবধান কমতে থাকে, অবশ্য কখনই তা শূন্য হবে না৷ সামান্য হলেও ব্যবধান থাকতে হবে৷ কেননা মুড়ি মিছরির একদর হয়না৷ আবার ব্যবধান যদি বেড়ে যায়, বাড়তেই থাকে তাহলে সাধারণ মানুষ পুনরায় শোষণ-বঞ্চনার শিকারে পরিণত হবে৷ অর্থাৎ বিশেষ সুবিধার আড়ালে সমাজে শোষণ আবার জেঁকে বসবে৷ তবে বৈষম্য দূর করতে ও ব্যবধান নূ্যনতম রাখতে (মিনিমাইজ্ করতে) সাধারণ মানুষের সামনে সর্বাধিক সুখ-সুবিধা পাবার সুযোগ থাকা দরকার, এবং এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাও দরকার৷ সবাই যাতে বিশেষ বা সর্বাধিক সুখ-সুবিধা পাবার যোগ্য হয়ে উঠতে পারে তার জন্য সমাজকে পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে৷ আর সাধারণ মানুষও যখন বাইরের ও ভিতরের তাগিদে বা সমাজের লিপিবদ্ধ নিয়মের বলে গুণীদের ঈপ্সিত সুখ-সুবিধার মত সুখ-সুবিধার যোগ্য অধিকারী হয়ে উঠবে বা সাধারণ মানুষের জন্যেও তা বরাদ্ধ করা হবে তখন গুণীদের প্রতিভাবানদের ক্ষেত্রেও প্রাপ্ত সুখ-সুবিধার চেয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত স্তর বা তার চেয়ে কিছুটা বেশী বরাদ্ধ করতেই হবে৷ তখন সাধারণ মানুষও আবার ওই পরিবর্তিত বর্ধিত সুখ-সুবিধা পাবার জন্যে চেষ্টা করতে থাকবে, সমাজকে তা দিতে হবে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে৷ আবার সেই সঙ্গে প্রতিভাবানদেরও দিতে হবে---যা পাচ্ছে তার চেয়ে উন্নত বা বেশী সুখ-সুবিধা৷ এইভাবেই সাধারণ মানুষ ও প্রতিভাবানদের বিরামহীন উন্নয়নের ধারা বয়ে চলবে আবৃত্ত দশমিকের মত৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments