আমরা কোথায় চলেছি?

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

আমরা, আজকের অধিকাংশ মানুষ, ছাত্র-ছাত্রা, যুবক-যুবতী --- আমরা কোথায় চলেছি? আমরা তো প্রতিদিন প্রচন্ড ব্যস্ততার  মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছি  অর্থ, পদ, যশ এগুলির পেছনে বা এগুলির কোনো একটির  পেছনে৷ এর বেশি আমরা খুব একটা চিন্তা করছি না৷ তাই নয় কি?  হয়তো আজকের সমাজব্যবস্থায় এ ছাড়া উপায় নেই, বাঁচাবার পথ অবরুদ্ধ৷ বিশেষ করে অর্থ না হ’লে তো কিছুই হবে না৷ সব অন্ধকার দেখতে হবে৷ কথাটা মিথ্যে নয়৷   হয়তো ব্যষ্টিগতভাবে আজকের যা পরিস্থিতি তাতে কথাটা  অস্বীকার করার উপায় নেই৷ কিন্তু সমষ্টিগতভাবে অর্র্থৎ সমাজের দিক থেকে তো আমরা অন্যভাবে চিন্তা করতে পারি৷ 

কেন একথা বলছি?

তার কারণ বলতে গিয়ে আমি প্রথমে মহান দার্শনিক  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি উদ্ধৃত করতে চাই৷ তিনি বলেছেন, ‘‘মানুষের ক্ষুধা অনন্ত৷ এই অনন্ত ক্ষুধাকে সে যদি জাগতিক ভোগ্যবস্তুর দিকে ছুটিয়ে দেয় তাহলে মানুষে মানুষে  সংঘর্ষ বাধবেই৷  কারণ জাগতিক সম্পদ সীমিত৷ একজনের প্রাচুর্য ঘটলে অন্যের অভাব দেখা দেবে, মানুষের এই ক্ষুধা মানস তথা অধ্যাত্ম সম্পদেই মেটাতে হবে৷ হ্ম অকৃপণভাবে অনন্ত মানস তথা অধ্যাত্ম সম্পদ মানুষের সামনে সাজিয়ে রেখেছেন৷ মানুষকে সে সম্পদের সদ্বব্যবহার করতে হবে৷’’

এর তাৎপর্য সম্যকভাবে উপলব্ধি করার জন্যে একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে চাই৷ ধরুন, আমি তো অর্থের পেছনে ছুটে চলেছি৷  কিন্তু এই অর্থ আমাকে প্রকৃত  সুখ বা শান্তি দিতে পারবে কি? পারে কি? আমি যদি আমার এই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ   হই তো কথাই নেই, আমার জীবনে মরুভূমির হাহাকার নেমে আসবে৷ অধিকাংশের জীবনে তো তাই আসছে৷ বহু শিক্ষিত মানুষকেও বাস্তবিকভাবে বেকরত্বের জীবন কাটাতে হচ্ছে৷ বেঁচে থাকার আপ্রাণ সংগ্রাম করে যেটুকু যোগাড় হচ্ছে তাতে নিশ্চয়ই সন্তুষ্টি বা শান্তির প্রশ্ণই উঠে না৷

আর , যে এই অর্থ রোজগারের  প্রতিযোগিতায় মোটামুটি জিতছেও, তার অবস্থাটা কী? তার মনে তো অনন্ত চাহিদা! তাই সে যা পাচ্ছে , তাতে তার সন্তুষ্ট হওয়ার  অবকাশ কই? মানুষ যত পায়, তত চায়৷ আগুনে যত ঘি ঢালা হবে, আগুন ততই বেশি করে জ্বলবে৷ মানুষ যত পাক না কেন, তার পাওয়ার  তৃষ্ণা মিটবে না, হয়তো সেই তৃষ্ণা খানিকটা দিক পরিবর্তন করবে ৷  সে যে অনেক  কিছুই চায়! অনেক কিছু না পাওয়ার বেদনা তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে৷ তাই শান্তি সে পায় না৷ আর, এই সব পাওয়ার প্রতিযোগিতায় না-পাওয়া মানুষের সংখ্যাও দারুণভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ তাদের বুকের হাহাকার গোটা সমাজকে বিষিয়ে দেয়৷ আর এই প্রতিযোগিতা মানুষকে ঠেলে দেয় নানান দুর্নীতির পাঁকে৷ দুর্নীতি দুদিক থেকে৷ যারা অনেক পায় তাদের দিক থেকেও---তাদের অতি ক্ষুধা  দুর্নীতির রাস্তা খোঁজে৷ আইন-আদালত শত চেষ্টা করেও তাদের নিরস্ত করতে পারে না৷

আজকের সমাজে সার্বিক অবক্ষয় তো এই কারণেই৷ তাই সারা সমাজ জুড়ে অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে৷ আর এই দাবানল সমাজের কাউকেই ছেড়ে দেয় না৷

তাহলে বিকল্প পথ কী?

হ্যাঁ, একমাত্র বিকল্প পথ মহান দার্শনিক শ্রীশ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার যে পথে দিশা দেখিয়েছেন সেটাই৷  কী সে ? মানুষের অনন্ত ক্ষুধাকে  কেবল জাগতিক ভোগ্যবস্তুর দিকে ছুটিয়ে দিলে চলবে না৷ কারণ, জাগতিক ভোগ্যবস্তু  বা জাগতিক  সম্পদ  সীমিত৷ একজনকার প্রাচুর্য অন্যদের অভাবের কারণ হবে৷  জাগতিক সম্পদ নিজের কুক্ষিগত  করার অবাধ উদগ্র প্রতিযোগিতা মানুষে মানুষে সংঘর্ষ বাঁধাবে, এমনকি অতি নিকট আত্মীয়ের মধ্যেও---ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের, বোনের সঙ্গে বোনের, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানেরও বিরোধ ডেকে আনবে৷ মানুষের সমস্ত সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে৷

পন্ডিতেরা শুধু ‘মূল্যবোধ’ নিয়ে সেমিনার-বিতর্ক করেই চলবে৷ লাভের  লাভ কিছুই হবে না৷ তলে তলে নিজেরাও হয়তো , এই সর্বনাশা ব্যাধিতে আক্রান্ত৷

এর একমাত্র পথ মনের অনন্ত ক্ষুধাকে অনন্তের পথে চালিত করা৷  মানসিক সম্পদ অর্র্থৎ জ্ঞান-বুদ্ধির ক্ষেত্র বিশাল হলেও মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধিকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে  মানুষের মস্তিকের শক্তি সীমাবদ্ধ৷ একজন এম-এ পাশ পন্ডিতকে  আজই যদি মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে বলা হয়, তাহলে সে হয়তো কৃতকার্য- হবে না৷ কেননা, অনেক কিছু মানুষ ভুলে যায়৷ তাছাড়া, একজন হয়তো রসায়ন শাস্ত্রে  বিরাট পাণ্ডিত্য, কিন্তু অর্থনীতিবিদ্যার বা সাহিত্যের হয়তো কিছুই জানেন না৷ তাই জ্ঞান দিয়ে মানুষ তার অনন্ত ক্ষুধা মিটাতে পারে না৷ অতিরিক্ত জ্ঞানচর্র্চ আবার  মস্তিকের সমস্যারও কারণ  দাঁড়ায়৷

তাহলে একমাত্র পথ মনকে অনন্ত আধ্যাত্মিক সম্পদে তৃপ্ত কর৷ আধ্যাত্মিক সম্পদ মানে অনন্ত ব্রহ্ম৷ সৎচিদানন্দের সমুদ্র৷

আপনি হয়তো বলে বসবেন, এতো ভাববাদী কথা, বাস্তব নয়৷ ভুল তো আমাদের এখানেই৷ বাস্তব কেবল জড়বস্তু-সম্পর্কীয় ব্যাপার নয়৷ আমার যে মন--- সেটা কি বাস্তব নয়? মনের ক্ষুধা, মনের দুঃখ, মনের আনন্দ সবই অত্যন্ত সূক্ষ্ম ব্যাপার আর এগুলোই বাস্তব৷

বিশ্বের সমস্ত মহাজ্ঞানী মানুষেরা এই শিক্ষাই মানুষকে দিয়েছেন৷ আমরা সেই  মহাজ্ঞানী মানুষদের জন্মদিনে আমরা তাঁদের প্রশস্তি গাই, কিন্তু তাঁদের বাণীর মর্ম উপলব্ধি করার চেষ্টা করি না৷

হ্যাঁ, তাহলে কি মানুষ কেবল ধ্যান ধারনাই নিয়েই থাকবে?  চাকুরী, ব্যবস্থা-বাণিজ্য, এসব বাদ দেবে? মোটেই তা বলছি না৷ এটাও একটা মস্ত বড় ভুল যে মানুষ কেবল আধ্যাত্মিক সাধনায় ডুবে থাকবে৷ জগৎকে মায়া বলে উড়িয়ে দেবে৷ না, তো নয়৷ আসলে এ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে৷

এই সামঞ্জস্য আসল কথা, আন্তর্জগৎকে  ও বহির্জগৎকে ---কোনোটাকেই অবহেলা করলে চলবে না৷ অবহেলা করাটা নির্বুদ্ধিতা৷ পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, ‘অস্তি, ভাতি ও আনন্দ’’--- জীবনের এই তিনটে অত্যাবশ্যক দিক৷ তিনটে নিয়েই চলতে হবে৷ ‘অস্তি’ বলতে তিনি এখানে বলেছেন, জীবনের স্থূল অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে অর্র্থৎ জীবন ধারণের জন্যে যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা তো করতেই হবে৷ কিন্তু , এখানেই থেমে থাকলেই চলবে না৷ ‘ভাতি’ চাই,  অর্র্থৎ মানসিক বিকাশ বা বিস্তার চাই৷ তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও আমাদের এগুতে হবে৷ মানসিক চর্র্চ করতে হবে৷ আর, তার সঙ্গে ‘আধ্যাত্মিক চর্র্চ’ও চাই৷ কেন? ---না,  এর মাধ্যমে মানুষ মুখ্যত: মনের ভারসাম্য অর্জন করতে পারবে৷ জীবনের পরম শান্তি খঁুজে  পাবে৷ ব্রহ্ম হচ্ছে অনন্ত অসীম ৷ মনের অনন্ত ক্ষুধা অনন্তের ধ্যানেই  মিটবে৷  আর মনের এই অনন্ত ক্ষুধার পরিতৃপ্তির ফলে মনে আসবে প্রকৃত ‘আনন্দের বা শান্তির অনুভূতি৷ তাই উপনিষদে বলা হয়৷ আনন্দৈ ব্রহ্ম৷ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীও তাই বলেছেন, আনন্দং৷ ব্রহ্ম ইত্যাহু’৷ এই ‘আনন্দসীমিত’ সুখ নয়, অনন্ত সুখ৷

এখানে একটা কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়৷ ব্রহ্ম অনন্ত, তাই সর্বব্যাপী৷ সবকিছুতেই   ব্রহ্ম বিরাজিত৷ প্রকৃত পক্ষে---সবকিছু ব্রহ্মেরই অভিব্যক্তি৷ তাই বলা হয় যত্রজীব, তত্র শিব৷  এখানে ‘শিব ও ‘ব্রহ্ম’ সমার্থক৷  আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে মানুষের মনের ব্যাপক বিস্তার ঘটে৷ মনের শুভবুদ্ধির জাগরণ হয়৷ মনের মধ্যে বিশ্বপ্রেমের বোধ জাগে৷

মুখে বিশ্বৈকতাবোধের খই ফুটালুম, আর ভেতরে স্বার্থের ছুরিতে শান দিতে থাকলুম,                এখন তো এই ধরণের কপটাতাই চলছে৷ আধ্যাত্মিকতাকে   অবহেলা করলে এই ‘কপটতা’ই স্বাভাবিক৷ তাই জড়বাদের ওপর ভিত্তি করে যথার্থ ‘বিশ্বৈকতাবাদ’ আসবে না, যা আসবে তা কেবল কপটতা সর্বস্ব ‘বুলি’মাত্র৷

হ্যাঁ, আধ্যাত্মিকতা মানে শ্রদ্ধেয় প্রভাত রঞ্জন সরকার ‘রিলিজিয়াস ন্যারোইজম’ বা তথাকথিত ধর্মমতগত সংকীর্ণ ও অযৌক্তিক ক্রিয়াকলাপের কথা বলছেন না৷ মনকে অন্তর্মুখী করে অনন্ত সৎচিদানন্দ সত্তার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা তথা ধ্যানের কথাই বলা হচ্ছে৷ গীতা উপনিষদেও তাই বলা হয়েছে৷ ‘আধ্যাত্মিকতা’ রিলিজিয়ানের থেকে অনেক ঊধের্বর  ব্যাপার৷ যার বৈবাহারিক দিক হোল ‘যোগধ্যান’৷

শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন ‘Subjective  approach through objective adjustment’’ অন্তর্জগতের পরাগতির সঙ্গে বর্হিজগতের সামঞ্জস্য বিধানের মধ্যে সন্তুলন Balance) বজায় রাখার সতত: প্রায়সই  মানুষের জীবনকে তথা মানুষের সমাজকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে৷ সহজ কথায় যাঁরা আধ্যাত্মিক সাধক, তারাই সর্বসভাকে অখন্ড চৈতন্য সত্তার অভিব্যক্তি৷

এতক্ষণ আলোচনার পর, সমস্ত শুণেও-- সমস্ত বুঝেও বলতে পারেন,  কিন্তু বর্তমানে কি এইভাবে সবাই চলতে পারবে? পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি--- সমাজের বর্তমান অবস্থা কি আমাদের এইপথে চলতে দেবে?

হ্যাঁ, একথাটাও ঠিক, আজকের ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় এর অনুকূল নয়--- বরং ভয়ঙ্করভাবে প্রতিকূল৷

তাই আমরা বলতে চাই, বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মানবতাবোধ তথা সমস্ত মূল্যবোধের বিপরীতধর্মী বলেই আজ আমাদের নোতুন করে, চিন্তা করতে হবে, এই ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন চাই৷ ধনতান্ত্রিক কাঠামোয় মানুষের কোনো মৌলিক সমস্যার সমাধান নেই৷ ধণতন্ত্র  মানেই, অন্যের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করে কেবল আমার অধিকারের প্রতিষ্ঠা৷ তাই এরই অপর  নাম শোষণতন্ত্র৷ এই ধণতান্ত্রিক  কাঠামোকে বজায় রেখে--- সমাজের প্রকৃত কল্যাণ কখনই করা যাবে না৷ তাই মানুষের চাই ন্যায্য অধিকার  ও সমস্ত মূল্যবোধের আধার শিলা প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা৷ এছাড়া মানবসমাজের সামনে আর অন্য কোনো পথ নেই৷ তাই আসুন, আজকে মানব সমাজকে চরম অবক্ষয়  ও বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে এই প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রবর্তিত ‘প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের পথ জেনে নিন৷