গত ১৬ই নবেম্বর ২০১৯ কলিকাতার বুকে বাঙালী জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল৷ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগ্রাম-আন্দোলনের পীঠস্থান কলিকাতায় এই বাঙালী সমাবেশ মূলতঃ বাঙলা ও বাঙালীর আত্মমর্যাদা রক্ষার সমাবেশ, বাঙলা ও বাঙালীর অবদমন, নিপীড়ন, বঞ্চনা, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠার সমাবেশ৷ আমরা সকলেই জানি, অসমে এন.আর.সি.-র নামে প্রায় ঊণিশ লক্ষ বাঙালীকে বে-নাগরিক, ডি-ভোটার করে দেশছাড়া করার এক সুগভীর চক্রান্ত চলেছে৷ আর যদি তাদের দেশছাড়া করা সম্ভব না হয় তবে ডিটেনশন ক্যাম্প নামক সরকারী জেলখানা বা কষাইখানায় বন্দী করে, সমস্ত নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, অত্যাচার নির্যাতন ও মানসিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে বাঙালী জাতিকে ধবংস করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে৷ এখন প্রশ্ণ হচ্ছে, এন.আর.সি. কেন? কাদের জন্য? এটা কি শুধুমাত্র বাঙালী বিতাড়নের হাতিয়ার? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে৷
বাঙালী জাতি বরাবরই সংগ্রামী ও সামাজিক চেতনায় প্রাগ্রসর হিসেবে পরিচিত৷ ব্রিটিশ আমলে সাদা চামড়ার ইংরেজ শাসক দল বাঙালীকে সর্বদাই দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছে৷ স্বাধীনতার পর একই পদ্ধতিতে বাদামী চামড়ার হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিভূরা বাঙালী বিদ্বেষের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে যার প্রধান শিকার স্বদেশপ্রেমের মূর্ত্ত প্রতীক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, যিনি একজন বাঙালী৷ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীনতা লাভের সময় দেশটাকে ভাগ করে পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহীন ,সহায়-সম্বলহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত করা হয়েছে, রক্তের নদী বইয়ে দেওয়া হয়েছে৷ পশ্চিম সীমান্তে পঞ্জাবী উদ্বাস্তুদের সম্পূর্ণ পুনর্বাসন হলেও পূূর্ব প্রান্তে বাঙালীদের ক্ষেত্রে সেই সমস্যার সমাধান হয়নি---তাদের সঙ্গে বিমাতৃসুলভ আচরণ করে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বাঙালী নেতৃত্বও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে যথেষ্ট উদ্যোগী হননি৷ পরবর্তীকালে অন্যান্য সরকারের আমলেও এর কোন সুরাহা হয়নি৷ যে বাঙালীর আত্মত্যাগ, বলিদান, বুকের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের পর এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী রাজনীতির কারবারীরা শাসন ক্ষমতার উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হলেন---সেই বাঙালীই হ’ল বঞ্চিত, উপেক্ষিত, নির্যাতিত ও শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট৷ যার প্রতিকার আজও হয়নি৷ বরং রাজ্য পুনর্ঘটনের নামে বাঙলার মূল ভূখণ্ডকে বার বার টুকরো টুকরো করে বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম, ত্রিপুরা, ওড়িশা প্রভৃতি রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করে বাঙলাকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷
ভিন রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালীদের মুখের ভাষা ‘বাংলা’কে কেড়ে নিয়ে অন্য ভাষা শিখতে বাধ্য করা হয়েছে৷ সেখানকার বিদ্যালয়গুলিতে বাংলা ভাষা পঠন-পাঠনের ব্যবস্থাকে নষ্ট করা হয়েছে, বাংলা ভাষার শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ ফলে বাঙালী জাতিকে গৃহহীন, ভূমিহীন, মাতৃভাষাহীন ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার সব ব্যবস্থাই চূড়ান্ত করা হয়েছে৷ এইবার এন.আর.সি.-র মাধ্যমে বাঙালীকে অনাগরিক, ডি-ভোটার করে শেষ পর্যন্ত দেশ থেকে বিতাড়ন করা বা জেলবন্দী করার চক্রান্ত রচিত হয়েছে৷ তাই বাঙালী আজ কঠোর সংগ্রামের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে৷ এই সংগ্রামের পুরোভাগে রয়েছে ‘আমরা বাঙালী’ সংঘটন৷ ‘আমরা বাঙালী’র সংগ্রাম ও আন্দোলন কোন প্রাদেশিকতার, কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদের বা নিছক ভাবাবেগের আন্দোলন নয়৷ এই আন্দোলন বাঙালী জাতির বাঁচার আন্দোলন, জাতিসত্ত্বা রক্ষার আন্দোলন, এই পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার আন্দোলন৷ ‘আমরা বাঙালী’র আন্দোলন বাঙালীর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সামাজিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার আন্দোলন, বাঙালীর স্বভূমি পুনরুদ্ধারের আন্দোলন৷
পশ্চিমবঙ্গেও সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা আজও আবশ্যিক হয়নি, সরকারী-বেসরকারী কার্যালয়, আদালত ইত্যাদির কাজকর্মে বাংলা ভাষার ব্যবহার সুনিশ্চিত করা যায়নি৷ খাস কলকাতায় বহু বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার মুখে৷ কলকাতার সত্তর শতাংশ জমির মালিকানা অবাঙালীদের করায়ত্ত৷ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলগুলিতে অধিকাংশই অবাঙালীদের আস্তানা৷ বাঙালীরা আজ স্বভূমে পরবাসী৷ হিন্দী আগ্রাসনে বাংলা ভাষার নাভিশ্বাস উঠছে৷ মাতৃভাষা মাতৃদুগ্দ সম৷ মাতৃদুগ্দের অভাবে শিশুর যেমন সুষম বিকাশ হয়না---ঠিক তেমনি মাতৃভাষা অবহেলিত বা অবদমিত হলে মানুষের মধ্যে হীনন্মন্যতা, ভীতন্মন্যতা সংক্রামিত হয়ে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ নষ্ট হতে থাকে৷ ফলে ক্রমশ একটি ভাষাগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়, আর ধীরে ধীরে ধবংসের পথে এগিয়ে যায়৷ বাঙালী জনগোষ্ঠীরও আজ সেই অবস্থা৷ বাঙলার প্রায় সমস্ত শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য অবাঙালী শিল্পপতি ও পুঁজিপতিদের দখলে, যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফা কামানো আর সেই মুনাফার টাকা বাঙলার বাইরে চালান করা৷ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া বাঙলা বা বাঙালীদের কোনরকম উন্নতিই এদের লক্ষ্য নয়৷ অথচ বাঙলার নেতা-নেত্রীরা এদের জন্যেই নিবেদিত প্রাণ, এদেরই তোষণ করে চলেছেন৷
দেশের ও রাজ্যের সত্যিকারের সার্বিক উন্নতি সাধন করতে হলে ‘‘স্বয়ং সম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল’’ গড়ে তুলতে হবে৷ স্থানীয় স্তরে উৎপাদিত কৃষিজাত দ্রব্যের (ধান, পাট, আখ, কার্পাস ইত্যাদি) ব্যবহার করে কৃষিভিত্তিক শিল্প ও কৃষি সহায়ক শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদের একশত শতাংশ কর্মসংস্থান ও ক্রয়ক্ষমতা সুনিশ্চিত করতে হবে৷ ফলে বেকার সমস্যার সমাধান হবে ও অর্থের বহিঃস্রোত বন্ধ হবে৷ পরিণামে স্থানীয় অধিবাসীদের কর্মসংস্থানের জন্যে বাইরে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হবে না৷ সমবায়ের মাধ্যমে উন্নত কৃষি ব্যবস্থা ও শিল্প ব্যবস্থা পরিচালিত হবে, যার ফলে অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হবে ও শোষণের মূলোৎপাটন ঘটবে৷ একমাত্র অতি ক্ষুদ্র শিল্প বা কুটির শিল্প ব্যষ্টিগত মালিকানায় ও অতি বৃহৎ শিল্প স্থানীয় সরকারের দ্বারা ‘না লাভ, না ক্ষতি’-র ভিত্তিতে পরিচালিত হবে৷ এর দ্বারা প্রত্যেকটি অঞ্চলের মানুষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারবে ও পুঁজিবাদী শোষণের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হবে৷ সাধারণ মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রসারিত হবে, ফলে অর্থনৈতিক মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির চক্রবূ্যহ থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করা যাবে৷ এইভাবে প্রতিটি অঞ্চল স্বয়ম্ভর হলে ক্রমে ক্রমে সারা দেশ ও বৃহত্তর ক্ষেত্রে সমগ্র পৃথিবী উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারবে৷ তাই ‘আমরা বাঙালী’ চায় ‘প্রাউট’ দর্শনের নীতি অনুযায়ী ‘‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা৷’’ তখন বাঙালী জাতিকে বেঁচে থাকার জন্যে অন্য কারোর ওপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন থাকবে না৷ ফলে বাঙালীর আত্মমর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হবে ও পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবে৷ এই মর্মে একটি বিষয় অবশ্যই স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, কোনও অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসী তাদেরই বলা হবে যারা সেই অঞ্চলের অপরাপর মানুষের সঙ্গে সুখ-দুঃখকে ভাগ করে নেবেন ও সেই অঞ্চলের অর্থনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কোনরকম অর্থের বহিঃস্রোত ঘটাবে না৷ উপর্যুক্ত শর্তগুলি পূরণ হলে স্থানীয়দের মধ্যে ভাষাগত বিভিন্নতা কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না৷
সুদূর অতীত থেকে সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, সংগ্রাম, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালী উন্নত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক---বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল রায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রাসবিহারী বসু, সূর্য সেন শহীদ ক্ষুদিরাম বসু, বিনয়-বাদল-দীনেশ প্রমুখদের উত্তরাধিকারী৷ তাই বাঙালী জাতির ভবিষ্যৎ কোনভাবেই তমসাবৃত হতে পারে না৷ হিন্দী অগ্রাসনের ফলে বাঙালী সাময়িকভাবে পিছিয়ে থাকলেও সমগ্র বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের দ্বারা আবার পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসন পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হবেই৷ বাঙালীর ঘরেই রয়েছে এশিয়ার প্রথম সাহিত্যে নোবেল সহ তিনটি নোবেল পুরস্কার ও চলচ্চিত্রে অস্কার৷ জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত মেধা, অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদের সাহায্যে বাঙালী জাতি অনতিদূর ভবিষ্যতে অবশ্যই উন্নতির চরম শীর্ষে পৌঁছবে৷ এক্ষেত্রে আজকের বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে৷ সমাজ ঘটনের কাজে ‘‘অসির চেয়ে মসী’’ অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী৷ তাই বুদ্ধিজীবী মহল, সংস্কৃতি জগতের মানুষজন, শ্রমজীবী-কর্ষক, কবি, লেখক, সাংবাদিক, ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের সকলের প্রতি আহ্বান---তাঁরা যেন হীন বুদ্ধি ও স্বার্থের ধবজাধারী রাজনৈিত্রতক নেতৃবৃন্দের ধোঁকাবাজীর গোলকধাঁধায় আবদ্ধ না থেকে নিরপেক্ষভাবে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালী জাতির স্বার্থে মরণপন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে বাঙলা ও বাঙালীকে শ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হন৷
এছাড়া সংবিধানের নির্দিষ্ট পার্ট ওয়ানের তিন নম্বর ধারা অনুযায়ী অবিভক্ত বাঙলার খণ্ডিত অঞ্চলগুলিকে একত্রে সংযুক্ত করে শোষণমুক্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল ‘বাঙালীস্তান’ গড়তেই হবে---একমাত্র তখনই বাঙলা ও বাঙালীর স্বভূমি পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে৷ বাঙালীর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বাঙালীকেই গড়তে হবে৷ উদার ও সহনশীল জাতি বাঙালী বঞ্চনা, লাঞ্ছনা সইতে সইতে আজ খাদের কিনারায় উপনীত৷ পুঁজিবাদী ও কুচক্রীর শোষণের চাপে গুটিয়ে যাওয়া বাঙালীকে উইপোকা বা ছাড়পোকা ভাবার কোন কারণ নেই---তারা প্রকৃতপক্ষে ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’৷ আত্মপরিচয় বিস্মৃত আপামর বাঙালীকে উপলব্ধি করতে হবে তার প্রকৃত শক্তি, জাগিয়ে তুলতে হবে আত্মবিশ্বাস ও সর্বগ্রাসী সংগ্রামী চেতনা৷ ঘুমন্ত আগ্ণেয়গিরির অন্তর্নিহিত শক্তি বিস্ফোরিত হয়ে যেমন দুরন্ত লাভাস্রোত উৎক্ষিপ্ত হয়, তেমনি ভাবেই আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের শেষ লড়াইয়ে সর্বস্তরের বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে অগ্রসর হতেই হবে৷ এ ভিন্ন আর কোন পথ নেই৷ আর এই সংগ্রামের পরিচালনায় থাকবেন আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত, নৈতিকতা ও বিপ্লবী চেতনায় প্রতিষ্ঠিত আপোষহীন সংগ্রামী সদ্বিপ্র নেতৃত্ব৷
- Log in to post comments