অন্ধ রাজনীতি ও বন্ধ্যা অর্থনীতি

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

‘রাজনীতি’ শব্দটির সংসৃকত ভাষার আভিধানিক দৃষ্টিকোন থেকে তার বুৎপত্তিগত অর্থবিচার করতে গেলে, একটি সমাসবদ্ধ পদরূপে এর বিশ্লেষণে দাঁড়ায়---‘নীতিনাং রাজঃ ইত্যর্থে রাজনীতিঃ’৷ অর্থাৎ রাজনীতি বলতে বোঝায় নীতিসমূহের শ্রেষ্ঠনীতি৷ আবার, ‘নীতি’ শব্দকে যদি বুৎপত্তিভাবেই বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে আমরা পাই ঃ--- ন+ ক্তি = নীতি৷ অর্থাৎ  নী-ধাতুর সঙ্গে ক্তিন্‌-প্রত্যয়যোগে হচ্ছে নীতি৷ নী-ধাতুর মানে হচ্ছে নিয়ে চলা (ইংরেজীতে‘টুলীড লীড্‌ যিনি করেন তিনিই লীডার৷ এর বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়---যিনি পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেন৷) অবশ্য আজকাল ক্যাপিটালিজম, ম্যাটারিয়ালিজম আর কোন কোন ক্ষেত্রে ব্রুটালিজ্‌ম তথা রাউজিয়ম-এর দৌরাত্ম্যে সব কিছুই তালগোল পাকিয়ে যেতে বসেছে বলে সমাজ জীবনে অনেক ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিতভাবেই কিছুসংখ্যক সুবিধাবাদী তথা কায়েমী স্বার্থখোরদের  গায়ে পড়ে এসে  মুরুবিবয়ানা দেখাবার অযৌক্তিক পদ্ধতিতে বাহাদুরি দেখাবার অহিতকর চাপের দউলতে সমাজের  সরলমতি, শক্তিশিষ্ট ভদ্র ও সুবোধ-প্রকৃতির মানুষেরা অসহায়ত্বের অথৈ জলে ভাসমান হয়ে চলেছে৷

এ যুগে পাশ্চাত্য-দুনিয়ার জড়কেন্দ্রিক ও ভোগবাদী সভ্যতার জৌলুসে ও স্থূলভোগের মোহ-মত্ততার উগ্রতার কাছে একদিকে হার মেনে যেতে বসেছে আমাদের প্রাচ্যের তথা ভারতীয় ভাবাদর্শ ও অন্তর্মুখী ধ্যান-ধারণা ৷ পাশ্চাত্যে ভোগ-কেন্দ্রিক স্থূল চিন্তাধারাপ্রসূত পলিটিক্‌স অর্থে বোঝানো হয়ে থাকে--- রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন করতে ও মনপসন্দমত রাষ্ট্র-পরিচালনার লক্ষ্যে যে-সব রীতি-নীতি গ্রহণীয় তারই সার্থক অভিধা হবে পলিটিকস৷ দেখুন শুধুমাত্র এই পলিটিকসের সঙ্গে আমাদের  ভারতীয় ভাবাদর্শের (অহিডোলজির) স্বভাবগত পার্থক্যটা কতটাই বিশাল৷

 শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে আনা আর করায়ত্ত রাখাটাই যেক্ষেত্রে পলিটিকসের মূল লক্ষ্য বলে ধরা হয়ে থাকে, সেই পলিটিকস দিয়ে ব্যাপকার্থে বৃহত্তর জনসমাজের কতটুকু কল্যাণ সাধিত হতে পারে তা’ কিন্তু সহজেই অনুমেয়৷ তাই নয় কি? বস্তুতঃ এই একচোখা তথা অন্ধ রাজনীতিই  হয়েছে ভারত-রাষ্ট্রের সর্বনাশের মূল কারণ আর এই উপমহাদেশের  আপামর সাধারণ মানুষদের যাবতীয় দুর্র্ভেগেরও প্রধান উৎস৷

এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, অতীতে রাঢ় অঞ্চল ঘিরে ক্ষুদ্রাকারের জনপদগুলোর রাজ-রাজড়ারা নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবাদে লিপ্ত থাকতেন বলে প্রায়ই তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যেত৷ তাদের মধ্যে ঐক্যেরও যথেষ্ট অভাব ছিল৷ তারপর, কালের গতিতেই হিন্দু রাজাদের শাসনের ক্রমাবনতি দেখা দিলে ধীরে ধীরে পঃরাঢ়ে জৈনধর্মমতের প্রসার ঘটতে থাকে৷ কিন্তু পূঃরাঢ়ে একমাত্র বর্ধমান শহর এলাকায় কয়েকজন ধনী ব্যবসায়ীরা জৈনধর্মমতে দীক্ষা নিলেও খুব একটা পসার জমেনি৷ সেখানে বৌদ্ধ ধর্মমতের প্রচার ব্যাপকতা লাভ করেছিল৷ তারপর পাল রাজাদের আমলে বরেন্দ্রভূমিভূমিসহ ---বঙ্গডবাক তথা পূর্ববাঙলায় বৌদ্ধমতের প্রভাবে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল৷ তবে সর্বত্রই চলছিল শঙ্করাচার্যের ব্রাহ্মণ্যবাদ, বৌদ্ধমত, জৈনমতের দিগম্বর-প্রথার প্রতি ও অহিংসা নিয়ে বাড়াবাড়ির ফলে জনমানসে অনীহা আর এসব নিয়ে প্রজা সাধারণের মধ্যে অনৈক্য বেশ দানা বাধে৷ ওই সময়ে অরাজকতা ও অনৈক্য ঘনীভূত হয়ে এলে সমগ্র বাঙলা জুড়ে মুসলমানী তুর্কী আক্রমণ শুরু হয়ে যায়৷ ফলে সূত্রপাত হয় তুর্কী আমলের৷ তারও পর ক্রমান্বয়ে পাঠান, মোগল ও  ইউরোপীয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীদের যথা পর্তুগীজ,ওলন্দাজ, ফরাসী ও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের অভিযান ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে৷ এভাবে, মোটামুটিভাবে বল গেলে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বৈদেশিক শাসন,শোষণ এক নাগাড়েই চলেছিল৷ আর উক্ত সুদীর্ঘকাল জুড়ে পরাধীনতার গ্লানি, বিদেশী শাসকদের শোষণ ও  নিপীড়ণের উপর্যপরি আঘাতে ও শেষ পর্যন্ত এসে সেয়ানা ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো আর শাসন চালাও’ এই নীতির ফলে বাঙলা হয়েছিল নিঃস্ব, রিক্ত, শুষ্ক-মরুভূমি-সদৃশ আর বাঙালী হারিয়েছিলেন জাতীয়-সচেতনতাবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ৷ উল্লেখ্য যে ডিবাইড্‌ অ্যাণ্ড রুল-পলিসি বিট্রিশরা কেবল বাঙলা ছাড়া ভারতবর্ষের আর কোথাও কিন্তু প্রয়োগ করেনি৷ কেন শুধু বাঙলাকেই তারা এজন্যে বেছে নিয়েছিল এর পেছনেও ছিল গভীর গোপন রহস্য৷ এ ব্যাপারে মদত ছিল সুনিপুণভাবে বিদেশীদের সহ দেশীয় পুঁজিবাদী গোষ্ঠীরও৷ আর উভয়ের  সুপরিকল্পিত যোগসাজসেই ব্রিটিশ শাসকরা বাঙলাকে খণ্ড-বিখণ্ডিত করে দিয়েছে৷ ওদের সুদূর প্রসারী লক্ষ্য ছিল গোটা বাঙলাকেই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার আর বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠীটাকে বাস্তুহারা বানিয়ে, হাতে ও  ভাতে ও আঁতে ( আর্থিক শক্তিতে) মেরে মেরে দুনিয়া থেকেই লোপাট করে দিতে৷ অবশ্য, এক ব্রিটিশ-দুরাচারীরা কিছুতেই এতটুকু সফল হতে পারত না যদি না আমাদের দেশীয় দুষ্টচক্র তাদের গভীর ষড়যন্ত্রে সামিল না হত৷ (ক্রমশঃ)