আনন্দমার্গ এক ব্যতিক্রম

লেখক
সুভাষ প্রকাশ পাল

পাঁশকুড়া ব্রাডলিবার্ট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রীবনমালি সামন্ত শুধু ছাত্রদরদী শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন পরহিতৈষী সমাজসেবক৷ পাঁশকুড়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের স্কুল, কলেজ, ক্লাব বা যে কোন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সদাহাস্যময়, মিতভাষী ও অকৃতদার বনমালিবাবুর ডাক পড়বেই৷ তাঁকে অতিথি হিসাবে পেলে সবাই খুশী হতেন৷ আনন্দমার্গের যে কোন অনুষ্ঠানে বিশেষ করে আনন্দমার্গ স্কুলগুলির বার্ষিক অনুষ্ঠানে জরুরী কোনরকম কারণ না থাকলে তাঁকে অবশ্যই পাওয়ার সুযোগ হত৷ স্কুলে এলেই আনন্দমার্গ প্রকাশিত বইগুলি সংগ্রহ করতেন, নুতন কোন বই প্রকাশিত হলে সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি পাওয়ার জন্য অর্ডার দিতেন, যখনই সময় পেয়েছেন আনন্দমার্গের সাধনা-পদ্ধতি মার্গের আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন অনেকবারই তাঁকে বলতে শুনেছি---‘আমি অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিশেছি ও ধর্মীয় পুস্তক পাঠ করেছি৷ কিন্তু আনন্দমূর্ত্তিজীর লেখা বইগুলি আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে৷ বিশেষ করে তাঁর লেখা ‘জীবনবেদ’ বইটির উচ্ছসিত প্রশংসা তাঁর মুখে প্রায়শই শুনতে পেতাম৷ মহর্ষি পতঞ্জলি নির্দেশিত অষ্টাঙ্গমার্গের ‘যম-নিয়ম’কে আনন্দমূর্ত্তিজীও স্বীকৃতি দিয়েছেন, তিনি তাঁর চরম নির্দেশে বলেছেন---‘যে দুবেলা নিয়মিতরূপে সাধনা করে, মৃত্যুকালে পরমপুরুষের কথা তার মনে জাগবে ও মুক্তি সে পাবেই পাবে৷ তাই প্রতিটি আনন্দমার্গীকে দুবেলা সাধনা করতেই হবে৷ ইহাই পরমপুরুষের নির্দেশ, যম-নিয়ম ব্যতিরেকে সাধনা হয় না৷ তাই যম-নিয়ম মানাও পরমপুরুষেরই নির্দেশ’’৷ যমের পাঁচটি ভাগ যথা---(১) অহিংসা, ২) সত্য,৩) অস্তেয় ৪) অপরিগ্রহ ৫) ব্রহ্মচর্য, নিয়মের পাঁচটি ভাগ, যথা---১) শৌচ,২) সন্তোষ, ৩) স্বাধ্যায় ৪) তপঃ ৫) ঈশ্বর প্রণিধান৷ মহান গুরু আনন্দমূর্ত্তিজীর কঠোর নির্দেশ---দুবেলা সাধনা করতে হবে৷ সেই সঙ্গে যম-নিয়মও মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে৷ যম-নিয়ম ব্যতিরেকে সাধনা সম্পূর্ণতা লাভ করে না৷ অন্যান্য ধর্মীয় সংঘটনের থেকে আনন্দমার্গের এখানেই পার্থক্য, আমাদের সমাজেও যাঁরা সেবামূলক কর্মে রত ও বিশেষ করে মানুষের সেবা করার জন্য রাজনীতির পথকে বেছে নিয়েছেন তাঁরা যদি যম-নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করতেন, তাহলে আমাদের সমাজটা অন্যরকম হত, সমাজে এতখানি বিশৃঙ্খলা, হিংসা, দ্বেষ, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি থাকত না৷ বনমালি সামন্ত মশাই এই বিষয়টি সম্যকরূপে উপলব্ধি করেছিলেন৷ তাঁর কথায়--- যম-নিয়মের এরকম যুক্তি নির্ভর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তিনি আর কোথাও পাননি৷ সেজন্যই তিনি প্রতিটি সভায় যম নিয়ম পালনের উপর জোর দিতেন৷ কি করলে সাধারণ মানুষ যম-নিয়মের পদ্ধতিগুলি সহজে মেনে চলতে পারবে, তার পথ নির্দেশনাও তিনি দিয়ে দিতেন৷ ছাত্র-শিক্ষক সবার মঙ্গলের কথা চিন্তা করে নিজের বিদ্যালয়ের দেওয়ালে যম-নিয়মের এই দশটি অনুসঙ্গ সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন৷

তিনি অনেকবারই আনন্দমার্গ সংঘটনের প্রধান কেন্দ্রগুলি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, মহতপুর আনন্দমার্গ স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রী অনন্ত কুমার গোস্বামীকে সঙ্গে নিয়ে একদিন সত্যসত্যই আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের কেন্দ্রীয় আশ্রম তিলজলায় হাজির হলেন৷ সেসময় তিলজলায় মহাপ্রয়াণ অনুষ্ঠান চলছিল৷ দেশ বিদেশ থেকে বহু মার্গী ভাইবোন এবং সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী উপস্থিত হয়েছেন৷ বনমালিবাবু একটু বিশ্রাম নিয়েই বিভিন্ন পদে আসীন সন্ন্যাসী ও মার্গীদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলেন৷ সংঘের উপাসনালয়, পাঠাগার, সভাগৃহ, মহারাজদের বাসস্থান, অতিথি নিবাস, ভোজনালয়, ফুলের বাগান সবকিছু ঘুরে দেখলেন৷ অনুষ্ঠান চলাকালীন সবার জন্যই মিলিত আহারের ব্যবস্থা ছিল৷ যথাসময়ে তাঁকেও ভোজনস্থলে নিয়ে যাওয়া হল--- একসাথে খেতে বসলেন৷ খেতে বসে অবাক বিস্ময়ে চারিদিকে শুধু তাকাচ্ছেন৷ দেখছেন হাজার হাজার নরনারী একসঙ্গে খেতে বসেছেন, সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনী ও গৃহী মার্গীরা পাশাপাশি একই আসনে বসে আহার করছেন৷ তিনি বিস্ময়ে হতবাক৷ নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না৷ সন্ন্যাসী ও গৃহী একই আসনে বসে আহার করছেন--- এও কি সম্ভব? এর আগে আর কোথাও এরকম দৃশ্য তিনি দেখেননি৷ মহারাজরা তাঁকে জানালেন---আনন্দমার্গে উচ্চ-নীচ ভেদ নেই, সবাই পরমপুরুষের সন্তান৷ এখানে গৃহী-সন্ন্যাসী, পণ্ডিত-মূর্খ, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল সবাই সমান৷ মানুষ মানুষ ভাই ভাই৷ পাঁশকুড়া ফিরে এসে বনমালিবাবু অনেকে কাছেই তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেছেন৷ মার্গীয় প্রথায় বিবাহ অনুষ্ঠান ঘোষনা করা হল--- এই বিবাহে পাত্রপক্ষে পৌরহিত্য করেন আচার্য প্রিয়শিবানন্দ অবধূত ও কন্যাপক্ষে পৌরহিত্য করবেন অবধূতিকা আনন্দ করুণা আচার্যা, বর-কনে ও দাদা দিদি তাঁদের নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করলেন৷ উপস্থিত অতিথিদের অনেকেই আনন্দমার্গের বিবাহ ইতিপূর্বে দেখেননি বা সে সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না৷ ফলে একজন--- কজন মহিলা বিবাহে পৌরহিত্য করবেন শুনে হলের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন শুরু হল৷ ভাবটা এই পুরুষরাই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করেন৷ কোন নারী কি পৌরহিত্য করার অধিকারী? মাইকে ঘোষনা করা হল---আনন্দমূর্ত্তিজী প্রদর্শিত এই বিবাহ অনুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য ও বর্তমান সমাজে তার যথার্থতা সম্পর্কে বক্তব্য রাখছেন--- প্রবীন সন্ন্যাসী আচার্য ত্র্যম্বকেশ্বরানন্দ অবধূত৷ তিনি তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন৷ বক্তব্যের মধ্যে মার্গীয় প্রথায় বিবাহের বৈশিষ্ট্যগুলি সহজ সরল ভাষায় সবার সামনে তুলে ধরলেন৷ বলাবাহুল্য ততক্ষণে গুঞ্জনও প্রশমিত হয়েছে৷ দাদার বক্তব্যের সারমর্ম ছিল--- ১) মার্গীয় প্রথায় বিবাহ অনুষ্ঠানে পাত্র বা পাত্রী কোনপক্ষই পন বা যৌতুক নিতে পারবেন না৷ ২) পাত্র-পাত্রীর জাতিগত বা গোত্রগত পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয় না৷ উভয়ের শিক্ষাগত ও পরিবেশগত সাযুজ্যকে মান্যতা দেওয়া হয়, ৩) সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনী যে কেউ অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করতে পারবেন, কেননা আনন্দমার্গের মতে নারী পুরুষ উভয়েই পরমপুরুষের সন্তান৷ পরমপুরুষের কাছে তাঁর পুত্র ও কন্যা সমান আদরের৷ ফলে কোন শুভ কর্মে নারী ও পুরুষ উভয়ই অংশগ্রহণ করতে পারবেন৷ এটাও সমাজে একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত৷

আর একটি ঘটনা, আমার কনিষ্ঠপুত্র শ্রীমান সৌরভের বিবাহ, কলিকাতাস্থি সল্টলেকের একটি অতিথিশালায় বিবাহ বাসর, আচার্য সুতীর্থানন্দ দাদার ব্যবস্থাপনায় তিলজলা থেকে আশ্রমের অধিকাংশ দাদা-দিদি ও কর্মীরা সেখানে উপস্থিত৷

আরও অনেক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত আছে৷ আজ একটি উদাহরণ দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করব, ধর্মগুরু, সমাজগুরু, শিক্ষাগুরু, সঙ্গীতগুরু মহান দার্শনিক শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বর্তমান পচাগলা ক্ষয়িষ্ণু সমাজের খোলনলচে বদলে দিয়ে সর্বপ্রকার শোষন ও কুসংস্কারমুক্ত সর্বাঙ্গসুন্দর একটি আদর্শ সমাজ গড়তে চেয়েছেন৷ ফলে শুধু ধর্মগুরুরূপে নিজের কার্যকে তিনি সীমাবদ্ধ রাখেন নি৷ তিনি দিয়েছেন এক যুগান্তকারী সমাজদর্শন ‘প্রাউট’৷ এখানেই অনেকের আপত্তি, ধর্মীয়ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে, রাজনীতির অঙ্গনে যাঁরা শোষন ও বঞ্চনাকে হাতিয়ার করে নিজের বা নিজগোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধি করে চলতেন, তাঁরা রে রে করে উঠেছেন৷ তাঁদের বক্তব্য--- উনি ধর্মগুরু৷ ধর্মের কথা বলবেন, সাধন-ভজন-কীর্ত্তনের কথা বলবেন, উনি কেন সমাজ নিয়ে বা অর্থনীতি নিয়ে কথ বলবেনঝ

মার্গগুরু ‘প্রকৃত গুরু’কে এই গ্রন্থে এর যথাযথ উত্তর দিয়েছেন৷ তাঁর কথায় --- যে মানুষটা খেতে পায় না, পরনে বস্ত্র নেই, উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ পায়না, মাথার উপর আচ্ছাদন নেই, কেননা খালিপেটে তাকে ধর্মের কথা নীতিকথা শুনিয়ে লাভ নেই৷ কেননা খালিপেটে ধর্ম হয় না, তাকে আগে খেতে দেব, পরণে বস্ত্র দেব, মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হবে৷ তারপর তাকে বলব--- তুমি সৎপথে চল, ধর্মপথে চল ইত্যাদি৷ অর্থাৎ আগে তার খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ইত্যাদির সর্বনিম্ন প্রয়োজনপূর্ত্তি হবে৷ তারপর তাকে সাধনায় বসাব৷

আনন্দমূর্ত্তিজীর এই চিন্তাধারাকে বহু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ্‌ দার্শনিক দেরীতে হলেও সমর্থন করছেন ও তার আদর্শ রূপায়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন৷ কলেজ, ইয়ূনিবার্সিটি ও জ্ঞানী-গুণী মহলে আনন্দমার্গ দর্শন নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে৷ সমাজ চিন্তাধারায় একটা রেণেশাঁ আসতে চলেছে, আশা করা যায় সবার প্রচেষ্টায় অদূর ভবিস্যতে আনন্দমার্গের আদর্শ বাস্তবায়িত হবেই হবে৷