সর্র্বন্যুস্যুত দর্শন বলতে কী বোঝায়? মানবসমাজের সর্বক্ষেত্রের সর্বপ্রকার সমস্যারই সুষ্ঠু সমাধান যে দর্শনে একসূত্রে গ্রথিত রয়েছে--সেই দর্শনকেই বলা হয় সর্বান্যুসূত দর্শন৷
বর্তমানে মানবসমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে সেগুলির সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়৷ এইভাবে বিভিন্ন দার্শনিক পৃথক পৃথকভাবে আধ্যাত্মিক দর্শন , অর্থনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রনৈতিক দর্শন, শিক্ষাদর্শন, শিল্প-সাহিত্যের দর্শন প্রভৃতি দর্শন দিয়েছেন৷
একজনের দর্শনের সঙ্গে অন্যজনের অন্যধরণের দর্শনের ‘‘আকাশ-পাতাল’’ পার্থক্য৷ দুয়ের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য থাকে না৷ যেমন, একজন দার্শনিকের আধ্যাত্মিক দর্শনের সঙ্গে অন্য দার্শনিকের অর্থনৈতিক দর্শনের কোনোমাত্র সামঞ্জস্যই থাকে না৷
কিন্তু একজন মানুষ তো একটাই সত্তা৷ তার আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে, অর্থনৈতিক দিক রয়েছে, সাংসৃকতিক দিক রয়েছে--- এমনি বিভিন্ন দিক রয়েছে ৷ সেক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক দর্শনের সঙ্গে যদি অন্য দর্শনের কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে না পায় , তখন তো তার মধ্যে স্ববিরোধিতা দেখা দেবে৷ দুনৌকার মাঝখানে পড়ে সে হাবুডুবু খাবে৷
এইভাবে বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রের দর্শনের মধ্যে সামঞ্জস্যের প্রচণ্ড অভাব৷ কারণ, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রের দার্শনিকরা অন্য সমস্যা সম্পর্কে কোনো চিন্তাই করেননি৷ তাই এই দর্শনগুলি মানব সমাজের যথার্থ সার্বিক কল্যাণ সাধনে অপারগ৷ শুধু তাই নয় মানব সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে বিরোধ সমাজকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেবে৷ শৃঙ্খলাকে ধুলিসাৎ করে দেবে৷ আর বর্তমানে হচ্ছেও তাই৷
তাই বর্তমানে জটিল সমাজ ব্যবস্থায় একান্ত প্রয়োজন একটা সর্র্বন্যুসূ্যত দর্শনের গোড়ার কথা হল মানুষের সামগ্রিক সমস্যার কথা ভাবা ও সামগ্রিক কল্যাণের চিন্তা করা৷
যে অভাব এতদিন ছিল, শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী সেই অভাবকেই পূর্ণ করলেন৷ তিনি মানুষের সমস্যাকে সামগ্রিকভাবে দেখেছেন৷ তাই বলেছেন, ‘‘আমি চাই প্রতিটি মানুষ জীবনের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির গ্যারান্টী পাক৷ প্রতিটি মানুষ তার মানসিক ক্ষেত্রের সমস্ত সম্ভাবনার পূর্ণ সুযোগ পাক৷ প্রতিটি মানুষ শাশ্বত সত্য উপলদ্ধির সমান সুযোগ পর বিশ্বের সকল উৎকর্ষ ও গৌরবের অধিকারী হোক৷ প্রতিটি মানুষ সেই শাশ্বত অনন্ত ও সত্তার দিকে এগিয়ে চলুক৷
এইভাবে মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের ভাবনা নিয়ে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর নূতন দর্শন দিলেন৷
শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর মূল দর্শনের নাম হ’ল আনন্দমার্গ৷ ‘আনন্দসূত্রম্’ পুস্তকে তিনি তাঁর দর্শনকে পাঁচটি অধ্যায়ে ৮৫টি সংসৃকত সূত্রের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন৷ সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভাষায় সূত্রগুলির সংক্ষিপ্ত সরল ব্যাখ্যাও দিয়েছেন৷ অন্যান্য ভাষায় পরবর্তীকালে এই ব্যাখা অংশটি বিভিন্ন ভাষাতে অনুবাদ করা হয়েছে৷
এই ‘আনন্দসূত্রম্’ গ্রন্থের প্রথম ৪টি অধ্যায় আধ্যাত্মিক দর্শন সম্পর্কিত আর ৫ম অধ্যায়টি সমাজ সম্পর্কিত৷
প্রথম ৪টি অধ্যায়ে ব্রহ্মতত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্ব, (সঞ্চর ও প্রতিসঞ্চর), ভূততত্ত্ব, তন্মাত্রতত্ত্ব, ইন্দ্রিতত্ত্ব, মন, প্রাণেন্দ্রিয় , বৃত্তি কোষ, আত্মা, পরমাত্মা, সাধনা, জীবন, মৃত্যু, সংস্কার মানবসাধ্যাত্মিক সমান্তরাল প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে৷ এসবই আধ্যাত্মিক দর্শনের পর্যায়ে পড়ে৷
কিন্তু মানুষ সামাজিক জীব৷ সমাজকে বাদ দিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না৷ অস্তি, ভাতি ও আনন্দ --- এই তিন তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মানুষের জীবন অর্থাৎ প্রথমে মানুষকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে৷ অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে জীবনের নূ্যনতম চাহিদার পূর্তি -চাই৷ তারপর সে তার মনের বিকাশ ঘটাবে৷ জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা-সংসৃকতি সঙ্গীত-কলা এগুলি তার জীবনের বিকাশের মাধ্যম৷
কিন্তু এসবের জন্যে প্রয়োজন একটা সুন্দর সামাজিক -অর্থনৈতিক কাঠামো৷
এই কারণে আনন্দসূত্রমের প্রথম ৪টি অধ্যায়ে আধ্যাত্মিক দর্শন সম্পর্কিত আলোচনা করার পর ৫ম অধ্যায়ে তিনি আদর্শ সমাজ কেমন করে তৈরী হবে --- তার পথনির্দেশনা দিলেন৷
‘আনন্দসূত্রমে’ এই ৫ম অধ্যায়ের সংযোজনই আনন্দমার্গ দর্শনকে সর্বানুসূ্যত দর্শনে পরিণত করেছে৷ ‘আজকের সমস্যা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে---
‘‘প্রকৃত অধ্যাত্মদর্শনই বিশ্বসমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ সে বিষয়ে আনন্দমার্গের আদর্শকে বলতে পারি স্পর্শমিণি৷ কবি-কল্পনার স্পর্শমণি যেমন সব কিছুকেই সোণায় পরিণত করে দেয় আনন্দমার্গের দর্শনও ঠিক তেমনি যে সমস্যার ওপরেই প্রয়োগ করা হোক না কেন ন্যায়-সম্মত সদুত্তর সে অবশ্যই বের করে দেয়৷’’
আনন্দমার্গের এই যে সমাজ সম্পর্কীয় বক্তব্য একে বলা হয়েছে ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷ ‘আনন্দসূত্রম্’ গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ের শেষে বলা হচ্ছে--- ‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বমিদং সর্বজন হিতার্থং সর্বজন সুখার্থং প্রচারিতম্’’---
সমস্ত মানুষের-কল্যাণ তথা সুখবিধানের জন্যে এই প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব প্রদত্ত হ’ল৷
আনন্দমার্গ দর্শনের প্রবক্তা তাঁর অপর আধ্যাত্মিক দর্শন ‘ভাব ও ভাবাদর্শ’ গ্রন্থে বলছেন, ‘‘সমাজদেহে নোতুন করে প্রাণশক্তির সঞ্চার করতে ও এর প্রগতিকে ত্বরাম্বিত করতে আনন্দমার্গ দিয়েছে প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব Progressive Utilisation Theory), সংক্ষেপে ‘প্রাউট’ Progressive Utilisation Theory)৷ যাঁরা এই ‘প্রাউট’কে সমর্থন করবেন তাঁদের বলা হবে ‘প্রাউটিষ্ট’৷ প্রাউটের নীতিসমূহ নিম্নলিখিত মৌলিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল ঃ---
(১) কোন ব্যষ্টিই সামবায়িক সংস্থার collective body) সুস্পষ্ট অনুমতি বা অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না
(২) বিশ্বের যাবতীয় জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে ও যুক্তিসঙ্গত বণ্টন করতে হবে
(৩) মানব সমাজের মধ্যে ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত ভাবে যে আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ মজুদ আছে তার সর্র্বধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে৷
(৪) এই জাগতিক, মানসিক, আধিভৌতিক,আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ সমূহের উপযোগের মধ্যে যথাযথ সন্তুলন থাকা অবশ্য প্রয়োজনীয়৷
(৫) দেশ, কাল ও পাত্রের পরিবর্তন অনুযায়ী সমগ্র উপযোগনীতির পরিবর্তন হতে পারে, আর এই উপযোগ হবে প্রগতিশীল স্বভাবের৷
এই হ’ল আমাদের প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব বা প্রাউট৷’’
‘ভাব ও ভাবাদর্শ গ্রন্থেও শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী প্রথমে ঈশ্বরতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি আত্মগত বিষয়গুলি আলোচনার পর সর্বশেষে তিনি আলোচনা করেছেন ‘সমাজচক্রে সদ্বিপ্রের স্থান ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব’ সম্পর্কে৷ তিনি সদ্বিপ্র তাঁদেরই বলেছেন, যাঁরা একাধারে, ধার্মিক, নীতিবাদী, সেবাব্রতী ও সমাজের সমস্ত অন্যায় ও পাপাচারের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী৷
বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তিনি যে বিষয়গুলির ওপর সমধিক গুরুত্ব দিয়েছেন ওই বিষয়গুলি হ’ল---(১) জীবন সম্পর্কে সাধারণ দর্শন (Common philosophy of life), (২) সাধারণ সাংবিধানিক কাঠামো (Same constitutional structure), (৩) সাধারণ দণ্ডবিধি Common penal Code), (৪) জীবন ধারণের সর্বনিম্ন চাহিদাগুলির (উৎপাদন, সরবরাহ ও ক্রয়ক্ষমতা) পরিপূরণ A(vailability of minimum essentialities of life)৷
বস্তুতঃ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী সমাজের প্রতিটি মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে যেমন প্রারম্ভিক যোগ, সহজযোগ বিশেষ যোগ প্রভৃতির মাধ্যমে সাধনামার্গের সুউচ্চ-শীর্ষে আরোহণের পথ প্রদর্শন করেছেন, ঠিক তেমনি একটি আদর্শ সমাজ দর্শন ‘প্রাউট’ দিয়েছেন ও তার বাস্তবায়নেরও উপায় বলেছেন৷
তার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আদর্শ শিক্ষা-ব্যবস্থারও নোতুন দর্শন দিয়েছেন--- যার নাম নব্যমানবতাবাদী শিক্ষা৷ তাঁর ‘নব্যমানবতাবাদ তত্ত্বে’ তিনি বলেছেন , কোনো ‘জিও সেন্টিমেন্ট’ বা আঞ্চলিকতাবাদ নয়, ‘সোসিও সেন্টিমেন্ট’ বা গোষ্ঠীবাদ বা সাম্প্রদায়িকতাবাদ’’ নয়, কেবল শুষ্ক ও সীমিত ‘মানবতাবাদ’ও নয়, মানবসভ্যতার সমস্ত সংকটের সমাধান তথা নিপীড়িত মানবতার শেষ আশ্রয় নব্যমানবতাবাদ--- যেখানে মানবতাদের মাধুর্য্যকে বিশ্বের সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ তথা চেতন-অচেতন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে নিজের আস্তিত্বিক চেতনাকে ভূমাভাবের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷
শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী সমাজের সমস্ত রকমের সমস্যা--- আধ্যাত্মিক, সাংসৃকতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহ যাবতীয় সমস্যারই সমাধান দিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে৷
আর তাঁর আধ্যাত্মিক সামাজিক বিভিন্নক্ষেত্রের ভাবধারাকে একসঙ্গে গ্রথিত করে তিনি বললেন, তাঁর আদর্শের মূল কথা হল--- ‘আধ্যাত্মিক পরাগতির সঙ্গে বৈষয়িক সামঞ্জস্যের সন্তুলন’৷
মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর সর্বানুসূ্যত দর্শন যেমন দিলেন, তেমনি সেই দর্শনের মূলভাবটিকে তিনি অভিনব ভাব,ভাষা, সুর ও ছন্দের মাধ্যমে প্রকাশ করে৫০১৮ টি নোতুন ধরণের সঙ্গীত দিয়ে নিজেই সেগুলিতে সুরারোপণ করলেন৷ এই সঙ্গীতের ডালিতে সাজানো রয়েছে নানান্ ধরণের অপূর্ব সুন্দর পুষ্পরাশি৷ এর নাম ‘প্রভাত সঙ্গীত’৷ কেন নাম প্রভাত সঙ্গীত? না, শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকারের রচিত বলে যে এর নাম প্রভাত সঙ্গীত না নয়, প্রভাতকালে গাওয়ার জন্যেও নয়, মানব চেতনায় ঘনীভূত অমারাত্রির অবসান ঘটিয়ে প্রভাতের সূচনা করাই এই সঙ্গীতের উদ্দেশ্যে৷
আর প্রভাত সঙ্গীতে স্রষ্টা তথা সর্বানুসূ্যত দর্শনের প্রবক্তা তাঁর সঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষকে আশাবাদের গান শুণিয়েছেন---
‘‘কে যেন আসিয়া কহে গেছে কাণে নূতন প্রভাত আসিবে
কালো কুয়াশার যবনিকা পারে সোণালী জীবন হাসিবে৷’’
- Log in to post comments