আনন্দমার্গ কী বলতে চায়?

লেখক
পত্রিকা প্রতিনিধি

মানবসভ্যতা আজকে এক চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছে৷ কি ধর্ম, কি সংস্কৃতি, কি শিক্ষা, কি অর্থনীতি, কি রাজনীতি–সর্বত্রই আজ চরম নীতিহীনতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে৷ গোটা সমাজে দেখা দিয়েছে চরম অবক্ষয় ও বিপর্যয৷ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক জ্ঞানী–গুণী মানুষ এসেছেন, বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ এসেছেন, অনেক সাধক–সাধিকা এসেছেন, তাঁরা তাঁদের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার জট খোলার চেষ্টা করেছেন বা কিছুটা খুলেছেনও, কিন্তু অনতিকাল পরে দেখা গেছে সমাজের সমস্যা জটিলতর হয়ে উঠেছে৷ সার্বিক সংকট থেকে মানবসভ্যতার উত্তরণ সম্ভব হয়নি৷ গত কয়েক শত বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে আমরা এই জিনিসটাই গভীরভাবে উপলব্ধি করব৷

বস্তুত, সমাজের বর্তমান অবস্থাটা হচ্ছে, যুগসন্ধির অবস্থা৷ পুরাতন ধ্যান–ধারণা বর্তমান সমাজে অচল হয়ে পড়েছে৷ অথচ এমন কোনো একটা সামগ্রিক প্রগতিশীল সর্বানুসূ্যত আদর্শ (comprehensive Idealogy) ছিল না, যা সমাজের এই সর্বাত্মক আদর্শগত শূন্যতাকে পূর্ণ করে’ সমাজকে নবপ্রাণে উজ্জীবিত করতে পারে ও দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে৷

ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে দিশাহারা মানবসমাজকে নোতুন পথের সন্ধান দিতে মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আবির্ভাব৷ মানবসভ্যতার বর্তমান সার্বিক সংকটমুহূর্তে ঠিক যেমনটি প্রয়োজন ছিল, তেমনি এক সর্বানুসূ্যত দর্শন তথা সর্বাত্মক আদর্শ তিনি মানবসমাজ উপহার দিয়েছেন, যার নাম আনন্দমার্গ–যাতে ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি সমস্ত ক্ষেত্রেরই সর্বপ্রকার সমস্যার সমাধানের সুষ্পষ্ট পথনির্দেশ রয়েছে৷

গীতাতে বলা হয়েছে, সমাজের চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে এই সংকটের অবসান ঘটাতে সর্বশক্তিমান পরমপুরুষের আবির্ভাব হয়৷ আধুনিককালে সত্যদ্রষ্টা ঋষি শ্রীরবিন্দও সমাজের এই সামগ্রিক সংকট নিসনকল্পে বিশেষ অবতারপুরুষের আবির্ভাবের ভবিষ্যৎবাণী করেছেন৷ তিনি কেমন হবেন? শ্রীরবিন্দ বলেছেন, ‘‘When Avatar comes we like to believe that, he will be not only the religious guide, but the political leader, the great educationist, the regenerator of society, the captain of co-operative industry, with the soul of poet, scholar and artist.’’  অর্থাৎ শ্রীরবিন্দের অনুভূতি অনুসারে সেই অবতারপুরুষ হবেন, একাধারে ধর্মগুরু, রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক, মহান শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও সামবায়িক অর্থনীতির পুরোধা৷ তিনি হবেন, অগাধ জ্ঞানের অধিকারী, সঙ্গে সঙ্গে তিনি হবেন কবি ও শিল্পীও৷

শ্রীরবিন্দ তাঁর উল্লেখিত বিরাট পুরুষের যে বৈশিষ্ট্যাবলীর কথা বলেছেন, শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ক্ষেত্রে  তা যে ষোল আনা প্রযোজ্য তা তাঁর দর্শন, আদর্শ তথা কর্মধারা অনুধাবন করলে আমরা স্পষ্টই উপলব্ধি করতে পারি৷ ধর্ম, সমাজব্যবস্থা, শিক্ষা, সংস্কৃতি অর্থনীতি, রাজনীতি–সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আজ যে বিপুল পরিমাণ আবিলতা জন্মেছে যার ফলে সমাজের অগ্রগতি একেবারে রুদ্ধ হতে বসেছে, সেই সমস্ত আবিলতাকে তিনি সরিয়ে দিয়ে সমাজের সার্বিক প্রগতির পথের পর্বতপ্রমাণ বাধা অপসারিত করেছেন৷

ধর্ম সম্পর্কে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী অভিমত

‘ধর্ম’ বিষয়ে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রদর্শিত নোতুন পথ (আনন্দমার্গ) প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশের পথ৷ এখন তার ওপর কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করছি৷

ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘ধর্ম আর রিলিজন সমার্থক নয়৷ রিলিজনের আরবিক প্রতিশব্দ হ’ল মজহব, কিন্তু ধর্মের প্রতিশব্দ হ’ল ইমান৷ ধর্ম মানুষকে যুগে যুগে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করার বাণী প্রচার করেছে৷ ধর্মমত (রিলিজন) যেখানে সংখ্যায় অনেক, ধর্ম সেখানে মাত্র একটি–মানুষের অসীমকে পাওয়ার এষণা৷ ধর্ম বৈবহারিক জ্ঞান ও যুক্তিসিদ্ধ বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ এতে রয়েছে পারমার্থিক সত্যোপলব্ধির যুক্তিসংগত প্রচেষ্টা৷ ধর্মসাধনার জন্যে বাহ্যিক কোন বস্তুর প্রয়োজন নেই–সাধনার জন্যে কেবল প্রয়োজন অণুমানস সত্তার৷ এতে মানুষকে অন্ধ বিশ্বাসের ফাঁদে ফেলে শোষণের কোন সুযোগ নেই৷ স্বার্থসিদ্ধির বা দলাদলির প্রতি এর কোন সমর্থন নেই৷ প্রেম, স্বতন্ত্রতা ও সমতা হ’ল তার ভিত্তি৷’’

 শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ধর্মের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘ধৃ’ ধাতুর উত্তর মন্ প্রত্যয় করে ‘ধর্ম’ শব্দের উৎপত্তি৷ তাই ধর্ম মানে হ’ল, প্রতিটি সত্তা এমন কিছু বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে রেখেছে যা সেই সত্তার পরিচিতি বহন করছে৷ আগুনের ধর্ম দহন করা, অর্থাৎ দহন করার এই যে ক্ষমতা–এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যই আগুনকে চিনিয়ে দিচ্ছে৷ দহন করার এই ক্ষমতা না থাকলে, তাকে আগুন বলা যাবে না৷ তাই আগুনের ধর্ম দাহিকাশক্তি বা সহজ কথায় ‘দহন করা’৷ জলের ধর্ম ‘ভিজিয়ে দেওয়া’, অর্থাৎ জলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল ভিজিয়ে দেওয়া৷ চিনির ধর্ম মিষ্টত্ব৷ মিষ্টত্ব না থাকলে তা চিনির মত দেখতে হলেও তাকে চিনি বলা যাবে না৷ তাই চিনির ধর্ম মিষ্টত্ব৷ এখন, আমরা যে ‘ধর্ম’ সম্পর্কে যে আলোচনা করছি, প্রকৃতপক্ষে আমরা কার ধর্মের কথা বলতে চাই? মানুষের ধর্ম৷ সমাজ বলতে সাধারণভাবে যেমন বোঝাই মানুষের সমাজকে, তেমনি আমাদের যে আলোচ্য বিষয় ‘ধর্ম’–তা হ’ল মানুষের ধর্ম৷ ধর্মের শব্দের অর্থ বোঝাতে গিয়েই আগুনের ধর্ম, জলের ধর্ম, চিনির ধর্ম–এই প্রসঙ্গগুলো তোলা হ’ল৷ এখন মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ধর্ম তাকেই বোঝাবে–যা মানুষের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ব্দন্দ্বপ্তন্দ্র ন্তুড়্ত্রব্জ্ত্রন্তুব্ধন্দ্ বা হ্মব্জপ্সহ্মন্দ্বব্জব্ যা অন্যান্য জীবের নেই৷ এই যে ‘ধর্ম’ বা সত্তাগত বৈশিষ্ট্য–একে চেনা যায় কেমন করে?–মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করলেই তা বোঝা যাবে৷

প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অভাব রয়েছে৷ আর এই অভাবের শেষ নেই৷ এই অভাব মেটানোর জন্যে সে অনবরত কিছু না কিছু করে চলেছে৷ অভাব মেটানোর তাগিদই হচ্ছে আকাঙক্ষা৷ জীব মাত্রেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা জৈব ধর্ম হ’ল–আহার, নিদ্রা, ভয় ও বংশবৃদ্ধির আকাঙক্ষা৷ মানুষের আকাঙক্ষা কিন্তু এই গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়৷ মানুষ অন্যান্য জীবের মত কেবল আহার, নিদ্রা, ভয় ও বংশবৃদ্ধির চৌহদ্দির মধ্যে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না৷ সে আরও চায়–তার চাওয়ার শেষ নেই৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘‘আমি যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না৷’’ মানুষের চাহিদা অনন্ত–অশেষ৷

অন্যান্য জীবজন্তুর দৈহিক অভাব মিটলেই হ’ল৷ তার আর কিছু চাহিদা থাকে না৷ কিন্তু মানুষের দেহের অভাব বা দেহের ক্ষুধা মিটলেও মনের অসীম ক্ষুধা থেকে যায়–যা কোনো সীমিত বস্তুতে মেটে না৷ মানুষ জাগতিক সম্পদ যতই লাভ করুক না কেন তার এই অভাব মেটে না৷ তার কারণ হ’ল এই যে, জগৎটা সীমিত৷ সীমিত জাগতিক ভোগ্যবস্তুর সহায্যে অসীম অভাব মিটতে পারে না৷ তাহলে অসীম অভাব বা অসীম আকাঙক্ষা মিটবে কেমন করে?

অসীম আকাঙক্ষা তো কেবলমাত্র অসীম কিছু পেলেই মিটতে পারে৷ আর ‘ব্রহ্ম’ ছাড়া কোনো কিছুই অসীম নয়৷ জাগতিক ভোগ্যবস্তুর একটা সীমা আছে৷ ‘ব্রহ্ম’ কথাটির মানেই হ’ল, ‘বৃহত্বাদ্ ব্রহ্ম’–ব্রহ্ম হ’ল তা–ই যা বৃহৎ৷ সংস্কৃতে দু’টো শব্দ আছে–বিশাল ও বৃহৎ৷ যা বিশাল তা যতই বড় হোক না কেন–তার সীমা আছে৷ যেমন পৃথিবী বিশাল, সূর্য বিশাল৷ কিন্তু ‘বৃহৎ’ মানে এত বড় যে তার কোনো সীমা নেই৷ সীমারেখা তাকে বাঁধতে পারে না৷ অর্থাৎ অসীম–নন্ত৷ ব্রহ্মই একমাত্র অসীম–অনাদি অনন্ত চৈতন্য সত্তা৷

সীমিত বস্তু থেকে মানুষ পায় সীমিত সুখ৷ অনন্ত সত্তা–পরমব্রহ্ম থেকে মানুষ পায় অনন্ত সুখ৷ সবাই অভাব মিটিয়ে সুখ পেতে চায়, সীমিত বা অল্প সুখ নয়, অনন্ত সুখ৷ ‘সুখম্ অনন্তম্ আনন্দম্’–অনন্ত সুখকেই দর্শনে বলা হয় আনন্দ৷ প্রতিটি মানুষ সেই আনন্দ–পরম শান্তি পেতে চায়৷ তা একমাত্র ব্রহ্ম থেকেই পাওয়া সম্ভব৷ তাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘বৃহদেষণা প্রণিধানঞ্চ ধর্ম’’ (আনন্দসূত্রম্)–‘‘জ্ঞাতসারে হোক্ আর অজ্ঞাতসারেই হোক, মানুষ অনন্তের পানে ছুটে চলেছে৷ মানুষ যখন জ্ঞাতসারে এই বৃহৎকে পাবার চেষ্টা করে ও তজ্জন্য ঈশ্বর প্রণিধান করে তখন তার সেই ভাবের নাম ধর্ম ও সেই প্রচেষ্টার নাম ধর্ম সাধনা৷’’

বিশ্বের সমস্ত আগুনের যেমন এক ধর্ম, সমস্ত জলের যেমন এক ধর্ম, তেমনি বিশ্বের সমস্ত মানুষেরও এক ধর্ম৷ তাই আনন্দমার্গ বলে, সকল মানুষের ধর্ম এক, আর তা হ’ল মানবধর্ম৷ তাই অনেক ধর্মের কোনো প্রশ্ণ ওঠে না৷ ‘রেলিজন’ বা ‘ধর্মমত’ বা ‘উপধর্মে’র সংখ্যা অনেক হতে পারে, কিন্তু ধর্ম সকল মানুষেরই এক৷ ‘রেলিজন’ নানান্ অন্ধবিশ্বাস ভিত্তিক আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টি৷ তাই বিভেদমূলক রেলিজনকে নয়, যথার্থ ধর্মকেই আনন্দমার্গ উৎসাহ দেয়৷ আনন্দমার্গ চায়, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী ভুলে মানুষ এই এক মানবধর্মে উদ্বুদ্ধ হোক৷ অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত পথ ধরে এগিয়ে চলুক৷ জাত–পাত–সম্প্রদায়ে সংকীর্ণ গণ্ডী অতিক্রম করে মানুষ সর্বপ্রকার কুসংস্কারমুক্ত মানবধর্মের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বৈকতাবাদে প্রতিষ্ঠিত হোক৷

আকাশের অদৃশ্য জলীয় বাষ্পরাশি থেকে যথাক্রমে মেঘ, বৃষ্টি ও বরফ সৃষ্টি৷ একে সঞ্চরধারার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে৷ তৎপরে পুনরায় বরফ থেকে জল, তা থেকে নদী, নদীর সাগরাভিমুখী যাত্রা, আবার বাষ্প হয়ে আকাশে চলে যাওয়া৷ এর সঙ্গে প্রতিসঞ্চরের তুলনা করা যেতে পারে৷