অনন্য প্রাউট (তৃতীয়)

লেখক
জিজ্ঞাসু

ভাতের হাঁড়িতে সেদ্ধ হতে থাকা একটা চাল টিপেই বোঝা যায় ভাত হয়েছে কি না৷ ভারতের ধনতন্ত্র বা পশ্চিমবঙ্গের বা ভেনেজুয়েলার বা চীনের অভ্যন্তরীণ কমুনিজমের দুর্দশা, দারিদ্র্য ও হিংস্রতার ছবি আমরা পেয়ে গেছি৷ ওই ধনতন্ত্র বা উল্টো পথ কমুনিজম কেন মানুষের দারিদ্র্য মেটাতে পারলো না? পারছে না? কারণ ওই দুটি দর্শনে একই সাধারণ ভুল আছে৷ ওঁরা ধরেই নিয়েছেন , মানুষও একটা শুয়োর বা ছাগল বা একটা গাধার মতোই এক সাধারণ প্রাণীমাত্র ৷ আহার-নিদ্রা-মৈথুনেই দিন শেষ, রাত শেষ৷ মানুষের এই অবমূল্যায়নের জন্যেই এই দুটি দর্শনকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জীবন ও সমাজ থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছেন ও দেবেন৷ এই কারণেই সমগ্র পৃথিবীকে দারিদ্র্য-মুক্তির সাথে জাগতিক সমৃদ্ধিতে ১০০ শতাংশ ভরিয়ে দিতে প্রাউটিষ্ট সমাজ অগ্রসর হচ্ছে৷ প্রাউটের দৃষ্টিতে কেবল জড় ভোগ-লালসার জীবনে থাকলে দারিদ্র্য কারো মিটবে না৷ কারণ মানুষ কখনোই ছাগল-গাধা- শুয়োরের মত একটা অসহায় জীব নয়৷ মানব মনে অসম্ভব শক্তি বুদ্ধি ঘুমিয়ে আছে ৷ অজানাকে জানার ইচ্ছা একমাত্র মানুষের আছে৷ বিশাল আকাশ ও সমুদ্র দেখে অথবা রাতের তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হতে পারে একমাত্র মানুষ৷ সুরে ছন্দে তালে একমাত্র মানুষই দুলে ওঠে৷ অনুপ্রাণিত হয়৷ অসহায় মানুষ বা পশু-পাখীর কষ্টে প্রকৃত মানুষ কষ্ট অনুভব করে ও তাদের কষ্ট দূর করতে সচেষ্ট হয়৷ এই হল মানবিক ধর্ম ৷ ভোরের বেলা ঘাসের গায়ে লেগে থাকা শিশির বিন্দুর নীরব ঝলকানি দেখে একমাত্র নান্দনিক মানুষ বাক্য হারা হয়ে যায়৷ এত সুন্দর এত রূপ! শুধু অনন্য মানুষের মানবিক হবার গুণ থাকার জন্যই এটা সম্ভব৷ তাই অন্য দুই দর্শনের মতো না ভেবে (মানুষ এক যুক্তিসঙ্গত প্রাণী মাত্র) প্রাউটিষ্টদের দিনচর্র্যর ‘যম সাধনা’ ও ‘নিয়মসাধনা’ আবশ্যিকভাবে জেনে বুঝে পালন করতে হয়৷ একমাত্র এই দুই অনুশীলন ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ ‘‘দেহ-মন-চেতনায় বিস্তারিত সমুন্নত মানুষে রূপান্তরিত হয়৷ অহিংসা-সত্য -অচৌর্য-অপরিগ্রহ-ব্রহ্মচর্য ভাবনার অনুশীলন হল যম বা সংযম সাধনা৷ অপরিগ্রহ মানে সরল, সাধাসিদা জীবন-যাপন, অতিরিক্ত বস্তু বা অর্থ বা সম্পদ বিষয়ে অনাগ্রহী হওয়া৷ আর ব্রহ্মচর্য মানে জগতের সবকিছুকে ব্রহ্মের বিকাশ হিসেবে ভাবা৷ অন্যদিকে নিয়ম সাধনা হল আন্তরিক বাহ্যিক শুচিতা -সন্তোষের ভাব নিয়ে চলা, স্বাধ্যায় থেকে লব্ধ যুক্তি-বুদ্ধি-বোধ নিয়ে এক মহাবিশ্ব চেতনার দিকে অগ্রসর হবার প্রয়াস, তপঃ হ’ল দেববুদ্ধি -শক্তি-সম্পদ দিয়ে অসহায়ে সেবা দান৷ ঈশ্বর প্রণিধান মানে মহাবিশ্বের অণু পরমাণু থেকে অনন্ত গ্যালাক্সির সর্বশক্তি ও চেতনায় মিলে মিশে এক হওয়ার প্রয়াস৷ আমিও তার অংশ, এই ভাব নিয়ে মানসিক ধ্যান-জপ৷ যম-নিয়মের নিত্য অনুশীলনে মানুষের ভয় কেটে যায়, হীনতাও কেটে যায়৷ সম্মিলিত প্রয়াসের দ্বারা তারা তখন এগিয়ে চলার পথের সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে খাদ্য-বস্তু-পোশাক-বাসস্থান-চিকিৎসার গ্যারাণ্টির পথও যেমন খুঁজে পায়, মানসিক বিকাশের পথেও এগিয়ে চলতে থাকে৷ জাত-পাত, ধর্মমত ও রাজনীতির বিচ্ছিন্নতাবাদ শূন্যে বিলীন হয়৷ প্রশ্ণ---ওই দুটি বিলীয়মান দর্শন যম-নিয়মকে জীবন সাধনার অঙ্গ হিসেবে নেয় না কেন? ক্ষুদ্র স্বার্থবোধ ও অহংকার থেকে তাদের মনে হয়েছে যম-নিয়ম পালন তাদের জন্যে নয়৷ কারণ যম-নিয়ম পালন করতে গেলে শোষণ করা যাবে না, মানুষকে নানাভাবে বোকা বানানো যাবে না৷ যম নিয়ম পালন করলে ধনতন্ত্র থাকতে পারে না৷ যম - নিয়ম পালন করলে কমুনিজম থাকতে পারে না৷ অথচ সেই যম-নিয়মের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে প্রাউট দর্শন৷ (চলবে)