কালের প্রবাহ বয়ে চলেছে অনাদি কাল থেকে অনন্তকাল৷ আর সেই কালপ্রবাহের একটা খন্ড অংশে আমাদের জীবন৷ এও বয়ে যায় কাল প্রবাহের ছন্দে৷ একটা জাতি, দেশ বা সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসও এই একই ভাবেই বয়ে চলে কালের প্রবাহের সঙ্গে৷ এই ইতিহাসকেও গড়ে তুলি আমরাই--- সামূহিকভাবে৷
কালপ্রবাহ অখন্ড হলেও চলার পথে আমরা এই কালপ্রবাহকে খণ্ড খণ্ড করে বৎসর,মাস, দিন ইত্যাদিতে বিভক্ত করেছি৷ কারণ সব গতিই উহ-আবোহাত্মক, অগতি-অগতির বা সংকোচ বিকাশাত্মক তরঙ্গায়িত পথ বেয়ে এগিয়ে চলে৷ তাই দিনের চলার পর রাতের বিশ্রাম, আবার নোতুন উদ্যম নিয়ে পথ চলা৷
ঠিক তেমনি ২০১৮ সাালের বর্ষব্যাপী অভিযানের পর এবার ২০১৯-তে নোতুন করে যাত্রা শুরু করার আগে উচিত হবে অতীতের ভুল-ভ্রান্তি, ভালো-মন্দ সম্পর্কে সমীক্ষা করে নিয়ে নোতুন করে পরিকল্পনা তৈরী করে শুভের পথে পুনরায় যাত্রা শুরু করা৷
হ্যাঁ, শুভও অশুভে মেশানো এই দুনিয়া লীলাখেলায় শুভ-অশুভের বিচার করতে হবে বৈ কি! কোনটা অশুভ কোনটা শুভ, কোনটা অন্যায় কোনটা ন্যায়, কোন্ অনুচিত কোনটা উচিত---সম্যকভাবে এই বিচারকেই বলে বিবেক৷ আর আমাদের বিবেকের প্রদর্শিত পথই চলতে হবে ৷ বিবেককে সদা জাগ্রত রাখতে হবে ৷ বিবেক যাতে কুয়াশাচ্ছন্ন না হয়, সে দিকে সবসময় নজর রাখতে হবে, না হলে তো ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার সম্ভাবনা৷
ব্যষ্টিগত জীবনে, সমষ্টিগত জীবনে সবক্ষেত্রেই এই কথা খাটে৷
তাই আজ প্রয়োজন আত্মসমীক্ষা৷ আমরা যে পথে চলেছি, এই পথে কি আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব? যদি মনে করি, না, কিছু একটা পাথেয় অভাব থেকে যাচ্ছে, কিছু একটা চাই আমাদের জীবনকে সার্থক করতে, তাহলে খঁুজে নিতে হবে আমার যা অভাব আমি কোথায় তা পাব৷
দেশের তথা সমাজের সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও আমরা একটু সমীক্ষা করলেই বুঝতে পারব, কোথায় যেন একটা মস্ত বড় ত্রুটি থেকে গেছে৷
কী সে ত্রুটি? তা বিশ্লেষণ করতে হবে ৷ ব্রিটিশ রাজত্বের সময় --- সেই উত্তাল আন্দোলনের কালে সেদিনকার কবির স্বপ্ণ ছিল---
‘‘বলো বলো বলো সবে শত বীণা বেণু রবে
ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে৷
ধর্মে মহান হবে কর্মে মহান হবে
নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পূরবে৷’’
সেদিন স্বপ্ণ ছিল---‘‘ভারত আবার ধর্মে মহান হবে’’৷ কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী দেশ-নেতারা সেই ধর্মকে কেটে-ছেটে বাদ দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন৷ ধর্মের প্রকৃত স্বরূপই বোঝার চেষ্টা করেননি কেউ৷ কেউ কেউ (যেমন এরাজ্যে দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন কম্যুনিষ্টরা) ধর্মকে আফিং বলে ঘৃণা করেছে৷ এখন আবার কেন্দ্রের গদীতে আসীন হিন্দুত্ববাদীরা আসল উদার বিশ্বমানব ধর্মকে ভুলে সাম্প্রদায়িকতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন উপধর্মকে নিয়ে মাতামাতি করছে৷ ধর্ম সমানভাবে অনাদৃত৷
কবির যে আরও বেপ্ণ, ‘কর্মে মহান হবে’--- সে কর্ম ‘সেবা ও ত্যাগ ভিত্তিক’ কর্ম৷ কিন্তু দেশনেতারা ভোগবাদ ও পঁুজিবাদকেই তাদের জীবনধর্ম করে নিয়েছে৷ ফলে এ দেশের পূর্বাকাশে আর ‘নব দিনমণি’-র উদয় হয়নি, বরং অমানিশার অন্ধকার ঘন থেকে ঘনতর হয়েছে৷
এর মূল কারণ, স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের নিয়ন্তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে সন্ধি করে তাদের ধণতান্ত্রিক অর্থনীতি ও ব্রিটিশদেরই অনুসরণে তাদের অনুসৃত ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’কেই পরমাশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করেছে৷
নেতাজী বলেছিলেন, ‘‘আমাদের (ভারতের ) গৌরববোজ্জ্বল যুগগুলিতে আত্মা ও দেশের, চৈতন্য ও জড়ের দাবীর মধ্যে একটা মধ্যপথ বা সমন্বয় বের করা হয়েছিল৷ এরফলে দুইক্ষেত্রেই এক সঙ্গে সমান অগ্রগতি হতে পারে৷
আত্মার ও দেহের মধ্যে এমন এক পারস্পরিক সম্বন্ধ রয়েছে যার দরুণ দেহের ক্ষতি হলে যে দেহেরই ক্ষতি হয় তা নয়, পরিণামে আধ্যাত্মজীবনেও মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে৷ আজকাল ভারত কেবল দৈহিক শক্তিহীনতা নয়, আধ্যাত্মিক ক্লান্তিতেও ভুগছে৷ এটা আমাদের জীবনের একটা দিককে তাচ্ছিল্য করার পরিণাম৷ যদি আমাদের আত্মমর্র্যদা ফিরে পেতে হয়, তবে দৈহিক ও আত্মিক --- দুই ক্ষেত্রেই আমাদের একই সঙ্গে এগুতে হবে৷’’
অর্র্থৎ নেতাজী চেয়েছিলেন জাগতিক ও আত্মিক--- উভয় ক্ষেত্রেই সমান্তরাল উন্নতি৷ আর এইভাবে সমাজের যথার্থ অগ্রগতি সম্ভব৷ নেতাজী যাকে বলেছিলেন ‘সমন্বয়বাদ’৷
বলা বাহুল্য, বর্তমানে ভারতের কোনো রাজনৈতিক দলই নেতাজীর এই অভিনব চিন্তাকে উপলদ্ধি করতে পারেনি৷ আর এই কারণে, সবাই অন্ধকারে হাতড়িয়ে চলেছে, সবাই দিশাহারা৷ আর তারই ফলশ্রুতিতে সমাজের সার্বিক অবক্ষয় --- সার্বিক বির্পযয় দেখা দিয়েছি৷
নেতাজীর এই ভাবধারা তাঁর আরও একটি উক্তিতে পরিস্ফুট ৷ নেতাজী ভারতের নিজস্ব ভাবধারায় পুষ্ট একধরণের সমাজতন্ত্রের স্বপ্ণ দেখছেন৷ সে সমাজতন্ত্র কেমন হবে? নেতাজীর ভাষায় ‘‘সে সমাজতন্ত্র কার্লমাক্সের পুঁথির পাতা থেকে জন্ম নেয়নি৷ এর উৎপত্তি ভারতবর্ষের আপন চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির মধ্যে ৷’’
বলা বাহুল্য, একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের কাছে সুষ্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে--- নেতাজীর স্বপ্ণের মূর্ত্ত প্রকাশই হ’ল প্রকৃতপক্ষে প্রাউটেরই প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র৷
স্বাধীনতার পর ৭০ বছর ধরে আমাদের দেশের নেতৃবৃন্দ আমাদের ভুল পথে চালিত করেছেন৷ আসুন আজ নোতুন বৎসরের গোড়ায় দেশের ও দশের সর্বাত্মক উন্নতির চাবিকাঠি--- এই প্রাউটের মতাদর্শকে ভালভাবে জানুন৷ আর তা জেনে নোতুন করে নিপীড়িত মানবতাকে বাঁচাবার সংকল্প গ্রহণ করুন৷
- Log in to post comments