অর্থনৈতিক গণতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই  বিভিন্ন ভাবে কি কেন্দ্রীয় সরকার কি রাজ্য সরকার দরিদ্র্য জনসাধারণের সমস্যা সমাধানের নামে নানা ধরণের চমক দিয়ে চলেছেন৷ কিন্তু স্বাধীনতার পর ৭৭ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল আজও গরীব জনসাধারণের দুর্দশার অন্ত নেই৷ আসলে পুঁজিবাদ বা মার্কসবাদ–এদের কোনটাই দরিদ্র মানুষের যথাযথ কল্যাণ করতে পারবে না৷ আর ভারতবর্ষে না পুঁজিবাদ, না মার্কসবাদ, মিশ্র অর্থনীতির নামে বক–কচ্ছপ অবস্থা ভারতীয় অর্থনীতির৷ তাই হাল ফেরাতে দেশের অর্থনীতির নিয়ামকদের প্রাউটের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া উচিত৷

প্রাউটের অর্থনীতির গোড়ার কথা হ’ল, বিশ্বের প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণকে সুনিশ্চিত করা ও উত্তরোত্তর তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা ও দেশ–কাল–পাত্রের পরিবর্ত্তনের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ হয় তার ব্যবস্থা করা৷

নূ্যনতম চাহিদা বলতে প্রাথমিকভাবে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষার কথা আসে৷

এগুলো একটা মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে অত্যাবশ্যক প্রাথমিক চাহিদা৷ অস্তিত্বটাই জীবনের সমস্ত কিছু নয়, এটাও ‘প্রাউট’ মানে৷ তার জীবনের বিকাশ (ভাতি) চাই৷ তারপর দেখতে হবে, মানুষ যেন তার জীবনে পরম আনন্দ লাভ করতে পারে৷ কিন্তু প্রথমে তার যা চাই  তা হ’ল অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে অত্যাবশ্যক অন্ন–বস্ত্রাদি প্রাথমিক উপাদান সমূহ৷

প্রাউট প্রবক্তা বলেছেন, ‘‘প্রতিটি মানুষের সর্বনিম্ন প্রয়োজন মেটাবার দায়িত্ব সমাজের কিন্তু যদি এই দায়িত্বের প্রেরণায় প্রেষিত হয়ে প্রত্যেকের গৃহে অন্ন প্রেরণের ব্যবস্থা করে, প্রত্যেকের জন্যে গৃহ–নির্মাণ করিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে ব্যষ্টির কর্মপ্রচেষ্টায় ভাঁটা পড়বে – সে ক্রমশঃ অলস হয়ে পড়বে৷ তাই সর্বনিম্ন প্রয়োজন মেটাতে গেলে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন নিজ সামর্থ্য মত পরিশ্রমের বিনিময়ে মানুষ যাতে সেই অর্থ উপার্জন করতে পারে সেই ব্যবস্থাই সমাজকে করতে হবে ও সর্বনিম্ন প্রয়োজনের মানোন্নয়ন করতে হলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়াই হবে তার প্রকৃষ্ট উপায়৷’’

এখন, প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণ করতে হবে – এটা হ’ল প্রাউটের মূল নীতি৷ এখন এই ‘নীতি’–কে বাস্তবায়িত করা হবে কীভাবে? এ ব্যাপারে প্রাউট কী বলছে – তা আমাদের জানা দরকার৷

বর্তমান সরকার ভেবেছেন দেশের গরীব মানুষকে চাল বা বিভিন্ন ভাবে কিছু দান দক্ষিণা দিয়ে তাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দেবেন–এটা আসলে জনগণের কাছে সস্তায় বাহাদূরী পাওয়ার বা ভোট সংগ্রহের উপায়ও হতে পারে, কিন্তু এতে জনগণের যথার্থ কলাণ হবে না৷ যেমন, নামমাত্র মূল্যে চাল/গম দিলেই কি খাদ্য সমস্যা মিটে যায়? খাদ্যের জন্যে কি চাল/গম ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন নেই? মানুষের পুষ্টির জন্যে শ্বেতস্বার কার্বোহাইড্রেট ছাড়া প্রোটিন, বিভিন্ন ভিটামিন প্রভৃতি অত্যাবশ্যক, আর তা না হলে পুষ্টির অভাবে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে৷ আর সেই রেশনের কারণে মৃত্যুও প্রকৃতপক্ষে অপুষ্টিজনিত মৃত্যু অর্থাৎ খাদ্যাভাবে মৃত্যুর নামান্তর মাত্র৷

আর, সরকারী কোষাগার উজাড় করে কেবল দানছত্র খুলে চললে অচিরেই কোষাগার খালি হয়ে যাবে৷ এটা সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে মানা যায় কিন্তু স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না৷ কারণ, সরকারী কোষাগারের তো জনগণের প্রদত্ত করের অর্থেই তৈরী হয়েছে৷ তাই কোষাগার ক্রমশঃ শূন্য হয়ে যাওয়া মানে শেষে ‘ঋণ করে ঘি’ খাওয়ার দশা হবে৷ তারপর দেউলিয়া হয়ে যেতে হবে৷

জনসাধারণের নূ্যনতম চাহিদা পূরণ কেবল সস্তায় বা বিনা ব্যয়ে চাল/গম প্রাপ্তিতে হবে না, চাই অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসগৃহ ও শিক্ষা৷ আর এ সব করতে গেলে অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ণ চাই৷ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ণ ছাড়া এর কোনো স্থায়ী ‘শটকার্ট’ পদ্ধতি নেই৷ প্রাউটের মতে জনসাধারণের নূ্যনতম চাহিদা পূরণ করতে গেলে সর্বপ্রথম যা করণীয় তা হ’ল – জনগণের ১০০ শতাংশের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা৷

কিন্তু বর্তমান পুঁজিবাদ নির্ভর কেন্দ্রীত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তা কখনও সম্ভব নয়৷ প্রাউট তাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের কথা বলে৷

বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক গণতন্ত্র বলা চলে, যা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়৷ কারণ রাজনৈতিক গণতন্ত্র বোটাধিকার দিলেও জনগণের  অর্থনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে৷ শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক গণতন্ত্র আজ চরম ধোঁকাবাজিতে পরিণত হয়েছে৷ উন্নয়নের নামে কেবল ফাঁকাবুলি আর স্তোক বাক্য   শোনান হয়৷ প্রাউট তাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা চায়৷ অর্থাৎ জনগণের অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘটন করে আর্থিক ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দেওয়া সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি তৈরী হবে জনগোষ্ঠী গত বৈশিষ্ট্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, আর্থিক সমস্যা, সম্ভাবনা প্রভৃতি বিষয়গুলি বিবেচনা করে৷ তাই প্রাউটের শ্লোগান–রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ধাপ্পা বাজি নয়, চাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ৷