বর্তমানে সেমেটিক ভাষা হিব্রু ইস্রায়েলের সরকারী ভাষা, কিন্তু সেখানকার অধিবাসীদের ঘরের ভাষা নয়৷ এই ভাষাটির ইস্রায়েল দেশ থেকে মৃত্যু হয়েছিল বেশ কয়েক শতাব্দী পূর্বেই৷ তার পর থেকে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদীরা তাঁদের ধর্মভাষা ও সাংস্কৃতিক ভাষা হিসেবেও হিব্রুকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু আটপউরে ভাষা হিসেবে হিব্রুকে বাঁচানো যায়নি৷ সাম্প্রতিককালে তাঁরা বিভিন্ন দেশ থেকে এসে নিজেদের সাংস্কৃতিক ভাষা হিব্রুকে সরকারী ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন৷ দীর্ঘকালীন হিমনিদ্রার (ড়ম্ভত্ব্ন্দ্বব্জুত্রব্ধ) পর ভাষাটি আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে ও ধীরে ধীরে ঘরের ভাষাতেও পরিণত হতে চলেছে৷ সেমেটিক মুখ্য তিনটি ভাষা হচ্ছে–(১) অতোম্যান, (২) হিব্রু ও (৩) প্রাচীন আরবী৷ এদের তিনের মধ্যে মিল যথেষ্টই, সে তুলনায় গরমিল কম৷ মূল ওল্ড টেস্টামেণ্টের ভাষা থেকে আজকের সরকারী ভাষা হিব্রু কিছুটা সরে গেলেও খুব বেশী দূরে সরেনি৷ হিব্রু যদি তার তিন হাজার বছরের একতানতা রক্ষা করে এগিয়ে চলত তাহলে ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষা থেকে বর্তমানের হিব্রু অবশ্যই অনেক দূরে সরে যেত৷ কিন্তু সেটা হ’ল না হিব্রু ভাষার এই হিমনিদ্রার জন্যে৷
হিব্রু আরবী
সলোমন সুলেমান
জোসেফ ইউসুফ
জ্যাকব ইয়াকুব
মূল সেমিটিক অক্ষর ডান থেকে বাঁ দিকে লিখিত হ’ত কিন্তু তার সঙ্গে ভাষাগত কারণে কিছুটা নিকট সম্পর্কিত হওয়া সত্ত্বেও আজকাল গ্রীক ভাষায় সে নিয়ম চলে না৷ তুর্কী যখন আরবী লিপি ব্যবহার করত, তখন এই নিয়মেই করত৷ কিন্তু কামাল আতাতুর্কের সময় তুর্কী তার ভাষায় রোমান লিপির ব্যবহার করে আসছে ও ভাষাগত পরিচিতিতেও সে সেমেটিক গোষ্ঠীর থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে আর্য গোষ্ঠীর কিছুটা কাছাকাছি চলে এসেছে৷ ইস্রায়েলে পুনরাবাসিত হবার পূর্বে ইহুদীরা যে যে দেশে থাকতেন সেই দেশের ভাষাকেই মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন৷ কয়েকটি দেশে তাঁরা ‘ইআআল্তীশ্’–কে ঘরোয়া ভাষা রূপে ব্যবহার করতেন৷
সিনাগগে (ইহুদীদের ধর্মস্থান) দেখেছি প্রাচীন পদ্ধতিতেই হিব্রু উচ্চারণ করা হ’ত৷ এখন হিব্রু ইহুদীদের, অন্ততঃপক্ষে ইস্রায়েলের ইহুদীদের কাজকর্মের ভাষা হয়ে যাবার পরে হয়তো বা সিনাগগের ভাষাতেও আধুনিক উচ্চারণের ছাপ পড়লেও পড়তে পারে৷ ভারতের কেরল রাজ্যে সুপ্রাচীনকাল থেকেই ইহুদীদের বাস৷ তাঁরা কিন্তু কেরলের মালায়লাম ভাষাতেই কথাবার্তা বলতেন৷ তাঁদের সিনাগগের হিব্রুর উচ্চারণে মালায়লাম প্রভাব অনেকখানিই ছিল৷ তবে তাঁদের কেউ কেউ বিশুদ্ধভাবে হিব্রু উচ্চারণের চেষ্টা করতেন৷ এককালে তুর্কীর আর্মেনিয়ান গীর্জাতেও লাতিনের পরিবর্তে হিব্রুতে সার্বিস দেওয়া হ’ত৷ এখন হয়তো বা লাতিনে অথবা আর্মেনীয় তুর্কীতে দেওয়া হয়ে থাকে৷ আমাদের কলকাতাতে এককালে অনেক আর্মেনিয়ান থাকতেন৷ তাঁদের গীর্জাও ছিল (হয়তো বা এখনও আছে)৷ তবে সেখানে সার্বিস কোন্ ভাষায় হয় শোণবার সুযোগ হয়নি৷ তবে আর্মেনিয়ানদের ‘অ’ অক্ষরের উচ্চারণটি গ্রীক উচ্চারণের কাছাকাছি, অর্থাৎ সেমিতীয় উচ্চারণের কিছুটা দূরে৷ সেমিটিক হিব্রু, আরবী, অতোম্যান ও ইআআলতীশ্ ভাষাতে ‘অ’–এর দু’ধরণের উচ্চারণ–‘অ’, ‘আ’৷*(‘‘বর্ণবিচিত্রা’’ দ্বিতীয় খণ্ড থেকে গৃহীত৷–সম্পাদক৷)
হিব্রু ও আরবী ভাষা
লাতিনের প্রায় সমসাময়িক আরেকটি ভাষা হচ্ছে হিব্রু৷ এটি সেমিটিক ভাষা অর্থাৎ আর্য ও আর্যেতর ভাষার মাঝামাঝি৷ ইয়ূরোপের পূর্ব দিকে ও এশিয়ার পশ্চিম দিকে অর্থাৎ উত্তরে তুরস্ক থেকে দক্ষিণে এরিট্রিয়া (প্রাচীন আবিসিনিয়া, বর্তমান ইথিওপিয়ার উত্তরে) পর্যন্ত এই ভুভাগটি হ’ল সেমিতিক ভূমি (ত্রন্দ্বপ্পন্ব্ধন্ন্তু প্ত্ত্রুস্তু)৷ এই সেমিতিক ভূমির মধ্যমণি ছিল প্রাচীন হিব্রু ভাষা৷ পরবর্তীকালে হিব্রু ভাষা দুটি শাখায় বিভক্ত হয়৷ এক, মধ্যযুগীয় হিব্রু, অপরটি প্রাচীন আরবী৷ প্রাচীন আরবীর বিবর্তনে আমরা পাচ্ছি বর্তমান আরবী৷ কিন্তু মধ্যযুগীয় হিব্রুর বিবর্তনে আমরা বর্তমান হিব্রু বলে কোন ভাষা পাচ্ছি না৷ কারণ, মধ্যযুগীয় হিব্রু যাঁদের মাতৃভাষা ছিল কয়েকটি বিশেষ কারণে তাঁরা মাতৃভূমি ত্যাগ করে পৃথিবীর নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন৷ তাতে তাঁদের মূল মাতৃভাষাটি বিনষ্ট হয়ে যায়৷ বর্তমানে এই সেমিতিক ভূমিতে তাঁদেরই উত্তর–পুরুষেরা যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁরা সেই মধ্যযুগীয় হিব্রুকেই আবার পুনর্জীবিত করে বিভিন্ন কাজে কর্মে ব্যবহার করছেন৷ সে যুগের সেই সেমিটিক লিপিকেও তাঁরা আবার জাগিয়ে তুলেছেন৷ নূতনতর সাহিত্য তৈরীর কাজও জোর কদমে এগিয়ে চলেছে৷ ইস্রায়েলে থাকাকালে আমি তাঁদের এই নতুনভাবে সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস দেখে খুবই আনন্দ পেয়েছিলুম৷ তাঁরা প্রাচীন হিব্রু লিপিটিকেই ব্যবহার করছেন৷ হিব্রু ভাষার মত এই হিব্রু লিপিটিও সেমিটিক লিপি৷ আরবী ও হিব্রু ভাষার মত আরবী ও হিব্রু লিপিও স্ব–গোত্রীয় লিপি৷ এর সঙ্গে প্রাচীন গ্রীক লিপির ও অতি প্রাচীন রোমক লিপির লাতিনে এককালে ব্যবহার করা হ’ত, যা বেশ একটা সম্পর্ক মেনে চলে৷ তফাতের মধ্যে এই যে প্রাচীন গ্রীক ও প্রাচীন রোমক লিপি লেখা হয় বাঁ দিক থেকে ডান দিকে ও সেমিটিক লিপি লেখা হয় ডান থেকে বামে৷ অক্ষরের নামকরণেও কিছু কিছু সাদৃশ্য রয়েছে৷ একজন বলছেন ‘আলিফ’, অন্যে বলছেন ‘আলফা’, একজন বলছেন ‘বে’, অন্যে বলছেন ‘বিটা’৷ আরবী লিপিতে যুক্তাক্ষর বা ডিপথং (ড্ডন্হ্মব্ধড়প্সুন্ধ) রয়েছে৷ একটি অক্ষরের মাথার দিক, অপরটির ন্যাজের দিক সংযুক্ত করে যুক্তাক্ষর লেখবার ব্যবস্থা আছে৷ কিন্তু সে ব্যবস্থা প্রাচীন রোমক লিপিতে থাকলেও বর্তমান রোমক লিপিতে নেই৷
হ্যাঁ, বলছিলুম আরবী ভাষার কথা৷ আরবী একটি মাঝারি ধরনের উন্নত ভাষা৷ বর্তমানে কয়েকটি রাষ্ট্রে, বিশেষ করে ইরাকে ও মিশরে নূতনভাবে আরবী সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াসও পুরোদমে চলেছে৷ এ ব্যাপারে মিশরে আরবী সাহিত্যের ওপর ফরাসী সাহিত্যের প্রভাব সুস্পষ্ট৷ বেশ কিছুকাল মিশর ফরাসী প্রভাবে ছিলও৷ পরবর্তীকালে ইংরেজী প্রভাব বেড়েছে যার ফলে মিশর ইংরেজী ও ফরাসী উভয় ভাষার সাহিত্যের গঠনমূলক কাজের সুযোগ পেয়েছে৷ ইরাক সে ধরনের সুযোগ না পেলেও তার বর্তমান গতিতে রীতিমত দ্রুতি রয়েছে৷ ফার্সী ভাষা বর্তমানে পরিবর্ত্তিত ও পরিবর্দ্ধিত আরবী লিপিতে লিখিত হয়৷ অর্থাৎ সে তার প্রয়োজনমত কয়েকটি অক্ষর বাড়িয়েছে কিন্তু প্রাচীন ফার্সী ভাষা আরবী লিপিতে লিখিত হ’ত না৷ হচ্ছে মাত্র গত প্রায় এক হাজার বছর ধরে৷ তার আগে ফার্সী ভাষা ৰ্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী লিপিতে লিখিত হত৷ ফার্সী সেমিটিক ভাষা নয়, সে আর্য ভাষা ও বৈদিক ভাষার দক্ষিণ–পূর্বীয় শাখা ও বিবর্ত্তন৷ ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে কেউ কেউ বৈদিক ভাষার দক্ষিণ–পূর্বীয় শাখা ও বিবর্তন৷ ঠিক যেমন লাতিন ভাষা পশ্চিমী শাখা ও বিবর্ত্তন৷ মধ্যযুগীয় ফার্সী ভাষা যেমন উন্নত ছিল, সাহিত্যও তেমনি যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল৷ তবে বর্তমান ফার্সী সাহিত্য উন্নতির পথে এগোলেও তার গতিতে মধ্যযুগীয় সাহিত্যের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে দ্রুতি কম৷
সেমিটিক দেশগুলির ওপর অল্পস্বল্প নিগ্রো প্রভাব আছে, অল্পস্বল্প আর্য প্রভাবও আছে৷ তমে বৈদিক ভাষার প্রভাব নগণ্য৷ তবে তা’ যে একেবারেই নেই এমন কথা বলা যায় না৷ ওল্ড টেষ্টামেণ্ট প্রথম লেখা হয়েছে হিব্রু ভাষাতে৷ পরে তা লাতিনে অনূদিত হয়৷ (‘‘বর্ণবিজ্ঞান’’ থেকে গৃহীত৷–সম্পাদক৷)
হিব্রু ও প্রাচীন আরবী এক গোত্রীয় ভাষা–উভয়েই সেমিতিক৷ ইস্রায়েল ভূমি থেকে হিব্রু উৎখাত হয়েছিল দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী আগে৷ তারপর প্রাচীন আরবীর মত এরও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল৷ প্রাচীন আরবীর বিবর্তিত রূপ হিসেবে যখন বর্তমান আরবীর জন্ম হল তখন প্রাচীন হিব্রুর বিবর্তিত রূপ হিসেবে আর অন্য কোন নূতন ভাষা জন্ম নিল না কারণ হিব্রু ভাষীদের ছড়িয়ে পড়তে হয়েছিল দেশ–দেশান্তরে৷ ইয়ূরোপের কোথাও কোথাও হিব্রুর সঙ্গে স্থানীয় ভাষার বিমিশ্রণে ই–য়া–আ–ল–তী–স ভাষার জন্ম হয়েছিল কিন্তু তাকে ঠিক বিবর্তিত হিব্রু বলতে পারছি না৷ ইস্রায়েল রাজ্যের নূতনভাবে পত্তন হবার পর আবার হিব্রুকেই সেখানকার সরকারী ভাষা করা হয়েছে৷ হিব্রু এখন সেখানে বহাল তবিয়তে রয়েছে৷ কতটা মানসিক শক্তি থাকলে একটা প্রাচীন ভাষাকে নূতনভাবে জাগিয়ে ও চাগিয়ে তোলা যায় বর্তমানে ইস্রায়েলের হিব্রু ভাষার পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেখে তা অবাক হয়ে ভাবতে হয়৷ যাঁরা সংস্কৃত ভাষাকে মৃত বলে ঘোষণা করে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন সেই পণ্ডিতম্মন্য মানুষদের এটা একটা শেখবার ও ভাববার জিনিস৷ যে সংস্কৃত ভাষার কাছ থেকে আমরা দিনে ৭০০ বার শুধু যে শব্দ ধার করছি তাই নয়, ব্যঞ্জনা, আঙ্গিক ও উচ্চারণে – প্রক্ষেপ গ্রহণ করছি ও করে চলেছি তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা কতটা সঙ্গত তা নতুন করে ভাববার সময় এসেছে৷
হিব্রু ও প্রাচীন আরবী ভাষা দু’টি সমগোত্রীয় ও সহোদরা৷ হিব্রু শেখার সময় তাই প্রাচীন আরবী জানতে লেখকের বেশ কিছুটা সুবিধা হয়েছিল৷ ইস্রায়েলে থাকাকালে দেখে এলুম এখন সেখানে হিব্রুর সুন্দর ও প্রশংসনীয় চর্চা চলছে৷ কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলুম প্রাচনী আরবীর চর্চা কোন দেশেই তেমন হচ্ছে না৷ এমনকি তুলনামূলক বিচারে উন্নত ইরাক, লেবানন ও মিশ্র (ঈজিপৎ) দেশেও নয়৷ প্রাচীন আরবী আজ শুধু কালো পর্দার আড়ালেই নয়, অবজ্ঞা–বহেলার কুজ্ঝটিকাতেও ঢ়াকা পড়ে গেছে৷ *(‘‘বর্ণবিচিত্রা’’ তৃতীয় খণ্ড থেকে গৃহীত৷–সম্পাদক৷)