পূর্ব প্রকাশিতের পর
তাছাড়া শৌর্যে, বীর্যে, পৌরুষে, সাহসিকতায়, বীরত্বে রাঢ়বাসী সুপ্রাচীনকাল থেকে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে এসেছে৷ দক্ষিণ রাঢ়ের সিংহপুরের রাজা সিংহবাহুর পুত্র বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় করে তাঁর বিজয়ের অভিজ্ঞানরূপে সেখানকার নাম রাখেন সিংহল৷ সিংহপুরের আর এক রাজকুমার সহস্রবাহু থাইল্যাণ্ড রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন ও দেশের নাম দেন শ্যামদেশ৷ রাজা শশাঙ্কও ছিলেন রাঢ়ের সন্তান৷ ব্রিটিশ বিরোধী ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাঢ়বাসীর বীরত্বের পরিচয় পাওয়া যায়৷ চুয়াড় বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, বিয়াল্লিসের ভারত ছাড়ো আন্দোলন, আজাদহিন্দ বাহিনীর বিদ্রোহ৷ রাঢ়বাসীর দুঃসাহসিক বীরত্বের পরিচয় বহন করে৷ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পশ্চিম রাঢ়ের সিধো কানু---বীরসা, মানবাজারের চুনারাম, গোবিন্দ ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে সংগ্রাম করে শহীদ হয়েছেন৷ রাঢ়বাসীকে বীরপনা ও সাহসিকতায় প্রেরণা ও উন্মাদনা দেওয়ার জন্য ছৌ নৃত্য, নাটুয়া নৃত্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে ও করছে৷
আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে রাঢ়বাসীর ধর্মীয় বিশ্বাস, ঈশ্বর বিশ্বাস ছিল মজ্জাগত বিশ্বাস৷ প্রকৃতির বিভিন্নপ্রকার শক্তি যথা সৌরশক্তি, ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রবিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রাঢ়বাসীকে ধর্মীয় উন্মাদনায় অনুপ্রাণিত করত৷ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার লিখেছেন--- রাঢ়ের ফাগুনমাসের আগুন ধরা পলাশের বন তাদের মনেও রঙের নাচন লাগিয়ে দিলে৷ সে আজ অনেক হাজার বছর আগেকার কথা৷ তারা নিশ্চয় তপস্যা করেছিল৷ কিন্তু তারা কিসের তপস্যা করেছিল? কিভাবে তপস্যা করেছিল? কে তাদের তপস্যা করতে শিখিয়েছিল?--- খোঁজ খোঁজ, একজন কেউ আছেন---একজন কেউ আসছেন--- একজন কেউ তাদের চলার পথের পাথেয় যুগিয়ে লক্ষ্যে পৌছানোর নিশানা যুগিয়ে দেবেন৷ এই ছিল তাদের নাম-না জানা নীরব তপস্যা৷ আর্যরা তখন ভারতে আসছে, কিছু এসেছে, কিছু মধ্য এশিয়ার ঊষর প্রান্তর থেকে আসব আসব করছে, এমন সময় জন্মেছিলেন সেই বিরাট প্রাণপুরুষ সদাশিব তাঁরই অমরবাণীর, তাঁরই অভ্রান্ত নির্দেশনার সংস্পর্শে এসে রাঢ়ের মানুষ তাদের অভিষ্টের জীয়নকাঠি পেয়ে গেল৷ রাঢ় হল সভ্যতার আদিবিন্দু৷’’
আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে সাত হাজার বছর আগে সদাশিবের আবির্ভাব৷ এই বিরাট প্রাণপুরুষ মানবজাতির কল্যাণার্থে যে উদার শৈবধর্ম প্রবর্তন করলেন, রাঢ় সর্বতোভাবে সেই শৈবধর্মকে তার প্রাণীন্ সম্পদে পরিণত করেছিল৷ আজ থেকে মাত্র তেরশ বছর আগে শঙ্করাচার্যের পৌরাণিক ধর্ম,--- প্রচারের পর থেকে জাতিভেদ প্রথাটা এল৷ বৌদ্ধরা পৌরাণিক ধর্মাবলম্বীদের ভয়ে বুদ্ধের পূজা করতে না পেরে ধর্ম ঠাকুরের পূজা করতে লাগলো৷
এই ধর্ম ঠাকুরের পূজা আজও রাঢ়ের প্রায় সর্বত্র ছড়ানো রয়েছে৷ বীরভূম গোপভূম অঞ্চলে এইসব মন্দিরে পৌরোহিত্য করতে সদ্গোপ সম্প্রদায়ের লোকেরা৷ বাঁকুড়া অঞ্চলে ধর্মরাজের মন্দিরে পুরোহিত ছিলেন জালিক কৈবর্ত অথবা ডোম৷ এঁরা যে মন্ত্র দিয়ে দেবদেবীর পূজো করতেন বা করে থাকেন তা বাংলা ভাষায়৷ পশ্চিম রাঢ়ের কুর্মী মাহাতোরা ও এই ধরনের রাঢ়ে তথাকথিত নিম্নবর্ণের লোকেদের মধ্যে শৈবমতে বিবাহ এখনও প্রচলিত আছে৷ শিবের তিরোধানের পর সমাজে দেখা দিল এক বিশেষ ধরনের পূজা পদ্ধতি৷ রাঢ়ের সর্বত্র, বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি গ্রামে শিবমন্দিরে শিবলিঙ্গ পূজা হয়ে থাকে৷
যাইহোক, রাঢ়বাসীর ধর্মীয় আচরণ হলো তাদের জন্মগত ও মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য৷ তাই দেখা যায়, এখন জেনে বা না জেনে ধর্মাচরণ করে৷
তাইতো প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করা যায়, রাঢ়ের প্রায় প্রতিটি পরিবারই হয়তো শৈব, অথবা শাক্ত, হয়তো বৌদ্ধ অথবা জৈন,হয়তো হিন্দু অথবা মুসলিম অথবা খ্রীষ্টান ইত্যাদি৷ শঙ্করাচার্যের পৌরাণিক ধর্মের প্রভাবে বিভিন্ন পৌরাণিক দেবদেবীর পূজা প্রায় বারোমাসেই হয়ে থাকে৷ অবশ্য এখন স্যুডো কালচারের প্রভাবে ধর্মীয় আচরণে আন্তরিকতার পরিবর্ত্তে কৃত্তিমতা, বহিরাঙ্গিক ভাব এসে গেছে৷ তবু তা হয়ে থাকেই৷ তাই দেখা যায়, বাসে বা যে কোন যানবাহনে যেতে যেতে রাস্তার পাশে কোন মন্দির, মসজিদ বা গীর্জা দেখলে কপালে হাত স্পর্শ করে প্রণাম জানায়৷ এইভাবে অনেকে তুলসিমঞ্চে অথবা বটবক্ষ বা অশ্বস্থ বৃক্ষ দেখে অথবা সুউচ্চ পর্বত দেখে মাথা নত করে প্রণতি জানায়৷ তেমনি আবার দেখা যায়, সুদখোর মহাজন তার সুদের হিসাবের খাতায় মাথা ঠেকায়, ব্যবসায়ী তার টাকা রাখার বাক্সকে ধুপ দিয়ে প্রনাম করে, আর চোর বা দুষৃকতিও তার হীন কার্যসিদ্ধির জন্য তার অভিষ্ট কোন দেবদেবীর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে৷ যারা বাইরে নাস্তিকের মত কথা বলে--- তারাও নিজ পরিবারে গিয়ে কোন না কোন দেবদেবীর পূজার্চনা করছে৷ যাইহোক মহামানব সদাশিবের দেওয়া তন্ত্রসাধনাই প্রকৃত আধ্যাত্মিক চেতনা৷ বর্তমানে মহান দার্শনিক, মহান তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী রাঢ়বাসী তথা সমগ্র বিশ্ববাসীকে অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনার মাধ্যমে ধর্মীয় চেতনা, ও আধ্যাত্মিকতাকে মানব জীবনের আটপৌরে দিনচর্র্চ বা দিনচর্র্চয় পরিণত করেছেন৷ (হ্যাঁ, শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ও শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার এক অভিন্ন অবিনাভাবী, অখণ্ড সত্তা৷ সামাজিক - অর্থনৈতিক দর্শনের প্রবক্তা হিসাবে তিনি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার এই লৌকিক নামে পরিচিত এবং আধ্যাত্মিক, ধর্মগুরু তারকব্রহ্মরূপে তিনিই মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী৷ যেমন একজন কোয়ালিফায়েড ডাক্তার কখনো রোগীর দেখার সময়ে চিকিৎসক আবার কখনো মেডিক্যাল কলেজের ক্লাসে প্রফেসররূপে অভিহিত হয়ে থাকেন৷) তিনি ধর্মের প্রকৃত সনাতন মানবধর্ম অর্থাৎ ভাগবত ধর্মের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিভিন্ন গ্রন্থে৷ ধর্মের প্রকৃত নির্যাসটাও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘উত্তমঃ ব্রহ্ম সদ্ভাবঃ, মধ্যমা ধ্যান ধারণা, যপস্তুতি স্যাৎ অধমা,’’ মূর্ত্তিপূজা অধমাধমা৷’’ যাইহোক্ তাঁর প্রবর্ত্তিত ধর্মচেতনা এই ক্ষুদ্র পরিসরে বর্ণনা করে শেষ হবে না৷ এ ব্যাপারে তাঁর রচনা, প্রবচন ও আলোচনা সমুদ্রের মত সুগভীর সুবিশাল ও সুদূরপ্রসারী৷ স্বয়ং বিদ্যার দেবী সরস্বতীর পক্ষেও সে সব বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব হবে না৷
(পরবর্তী অংশ ৫ই ফেব্রুয়ারী---২০২১)
- Log in to post comments