আত্মনির্ভরতার অসার বুলি

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠে এখন শুধু আত্মনির্ভর দেশ গড়ার আহ্বান৷ কিন্তু তিনি দেশকে আত্মনির্ভর করার উপায় নিয়ে একটি বাক্যও বলেননি৷ বরং অর্থমন্ত্রী ২০২১-২২ আর্থিক বছরের বাজেট সংসদে পেশ করে আত্মনির্ভরতার  বিপরীত পথে চলার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে ব্যাপকভাবে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে৷ এর অর্থ দেশের সমস্ত সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতিদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যাবে৷

এই ধনকুবেরদের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম৷ দীর্ঘ লক্‌ডাউনের সময় যখন কোটি কোটি কর্মহীন হয়ে উপার্জন হারা হয়ে ঘরে বসে সামান্য কিছু সরকারী অনুদানে কায়ক্লেশে দিন কাটায় তখনও এই ধনকুবেররা তাদের সম্পদের পরিমান কয়েক’শ কোটি করে বাড়িয়ে নিয়েছে৷ এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী দেশ আত্মনির্ভর বলতে কাদের বোঝাতে চাইছেন৷ অর্থমন্ত্রী সংসদে যে বাজেট পেশ করেছেন তাতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নেই এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই৷ তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তির বিলগ্ণীকরণই কি আত্মনির্ভরতার পথ!

দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদগুলি বেসরকারী কোম্পানির হাতে তুলে দিলে সমাজ-অর্থনীতির নিয়ন্ত্রনটা মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে চলে যাবে৷ এতে একদিকে যেমন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা আরও দৃঢ় হবে, দেশে ধনী-দরিদ্রের ধনবৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলবে৷ এরফলে দেশে গড় জনসাধারণের মাথাপিছু আয় নিম্নমুখী হবে, ধনকুবেরদের সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে৷ গড় জনসাধারণের সঙ্গে ধন কুবেরদের আর্থিক বৈষম্য আরও বাড়বে৷

এই অবস্থায় দেশ আত্মনির্ভর বলতে প্রধানমন্ত্রী কি বোঝাতে চাইছেন৷ তিনি কি দেশের আত্মা বলতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতিকে বোঝাতে চাইছেন! অর্থমন্ত্রীর বাজেট যেখানে সম্পূর্ণ পুঁজিবাদ নির্ভর সেখানে প্রধানমন্ত্রীর মুখে আত্মনির্ভরতারকথা রাজনৈতিক প্রচারের কৌশলমাত্র যার সঙ্গে অর্থনীতির কোন সম্পর্ক নেই৷

আত্মনির্ভর ভারত গড়তে হলে অর্থনীতির খোল-নলচে পাল্টে বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় স্থানীয় মানুষের হাতে অর্থনীতির চালিকাশক্তি তুলে দিতে হবে৷ গড়ে তুলতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কৃষি ও শিল্পের সমন্বয়ে৷ কিন্তু গত সাতবছরে বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির পথে চলার কোন দৃষ্টান্ত প্রধানমন্ত্রী রাখেন নি৷ বরং তাঁর একের পর এক সিদ্ধান্ত এমনকি গায়ের জোরে সংসদে কৃষিনীতি পাশ করিয়ে পুঁজিপতিদের হাতকেই শক্ত করতে চাইছেন৷ দেখে মনে হয় যে সরকার ধনকুবেরদের স্বার্থরক্ষার্থে মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতি গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে৷

ভারতীয় গণতন্ত্রের মজা এই যে নেতারা বড় বড় বুলি আওড়ে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়ে জনগণেরে ভোট আদায় করে৷ কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার দায় থাকে না৷ এরজন্যে জনগণকে জবাব দিতেও হয় না৷ বরং পাঁচবছর পরে আবার নূতন বুলি আওড়ে জনগণকে বশে রাখার প্রয়াস করে৷ জনগণও পুরনো প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়৷ দেশের জনগণের এই মানসিকতাকে বুঝেই প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভরতার অসার বুলি ভোটের ময়দানে বিতরণ করছে৷ কিন্তু তাঁর সরকারের অর্থমন্ত্রী সম্পূর্ণ বিপরীত পথে চলছেন৷ এই দ্বিচারিতাই  দেশের শাসকদলের একমাত্র সম্বল৷

প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতি না বুঝলেও তাঁর চারপাশে অর্থনীতি বোঝার লোকের অভাব নেই৷ আত্মনির্ভর দেশ বলতে কি বোঝায় তা তাঁরা ভালোই জানেন৷ কিন্তু এইসব অর্থনীতির লোকেরা পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষায় সদাব্যস্ত৷ আত্মনির্ভর দেশ গড়তে হলে পুঁজিবাদের বিনাশ ঘটাতে হবে৷ পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত শাসক, অর্থনীতিবিদ কেউ সেটা চাইবে না৷ তাই গণতন্ত্রের বিলোপ না করা পর্যন্ত জনগণকে সন্তুষ্ঠ রাখতে কিছু গালভরা বুলির প্রয়োজন৷ প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠে আত্মনির্ভর তেমনি এক গালভরা বুলি৷

অর্থনীতি প্রসঙ্গে প্রাউট প্রবক্তার কথায় অর্থনীতিকে অধিকতর বাস্তবমুখী হতে হবে৷ অর্থনীতি হবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও প্রয়োগ ভৌমিক বিজ্ঞান৷ আর একে বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ, সর্বজীবের তথা সর্ব অস্তিত্বের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে বিকশিত করতে হবে৷

ধনকুবেরদের হাত ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী কি পারবেন সেইপথে হাঁটতে, পুঁজি পতিদের প্রতিনিধি না হয়ে আপামর জনতার প্রতিনিধি হতে৷ যদি  পারেন দেশ আত্মনির্ভর হবে৷ নতুবা আত্মনির্ভরতার অসার বুলি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা, নির্বাচনী ভাঁওতা৷