বাংলা ভাষার প্রতি অবদমন বন্ধ হোক

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

মাতৃভাষায় মানুষ যত সহজে সাবলীল ভাবে ও স্বচ্ছন্দে ভাবপ্রকাশ করতে পারে, অন্য কোনো ভাষায় সে তা পারে না৷ অন্য ভাষায় মানুষ স্বচ্ছন্দে ভাব প্রকাশ করতে পারে না৷ প্রতি মুহূর্ত্তে কোনো জনগোষ্ঠীকে অন্য ভাষায় ভাব প্রকাশ করতে বাধ্য করা হলে, সব সময় তারা অস্বচ্ছন্দ বোধ করে, ফলে তাদের প্রাণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এ অবস্থায় তাদের দু’ধরণের মানসিক সংকটের সম্মুখীন হতে হয়–(১) হীনম্মন্যতা বোধ৷ ওই হীনম্মন্যতা বোধ ওই জনগোষ্ঠীর মনকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়৷ তাই তাদের ভাষায় অবদমিত, মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষাতে সবসময় কাজকর্ম করতে হয় তারা ধীরে ধীরে যেমন মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, তারা তাদের নৈতিক উদ্যম ও প্রতিবাদ করার শক্তি ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলতে থাকে৷ পরিণামে তাদের মধ্যে পরাজিতের মনোভাবও দেখা দেয়৷ এইভাবে একটা জনগোষ্ঠী তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে অপরের দাস হয়ে যায়৷ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাথা তুলে তারা দাঁড়াতে পারে না৷

এই ভাবে ভাষার ক্ষেত্রে অবদমিত জনগোষ্ঠী দুর্বল চিত্ত হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক ভাবে অন্য জনগোষ্ঠীর দ্বারা শোষিত হতে থাকে৷ শোষণের বিরুদ্ধে ঠিকমত তারা প্রতিবাদও করতে পারে না৷ এইভাবে জাতিগতভাবে ওই জনগোষ্ঠীর মৃত্যু হয়৷

ইভাঙ্কী ভাষার কবি নেমতুসকিন তাঁর মাতৃভাষার প্রতি অবদমনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছেন –

‘‘If I forget my native speech

And the songs that my people sing

What use are my eyes and ears?

What use is my mouth?

.............................................

Why am I living in the world!

প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার মাতৃভাষার অবদমনের ফলে কীভাবে একটা জনগোষ্ঠীর চরম ক্ষতি হয় তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন ও তাই মাতৃভাষার অবদমনের বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷

রাষ্ট্রসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের নির্দেশ দিয়ে দেশে দেশে মাতৃভাষা অবদমনের প্রতিবাদ করেছে৷ অথচ, সারা পৃথিবী জুড়ে আজও মাতৃভাষার অবদমনের ঘটনা বিরল নয়৷ শোষক শ্রেণী সর্বত্রই তাদের শোষণব্যবস্থাকে কায়েম রাখার জন্যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে আজও ন্যায্য অধিকার দেয়নি৷

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী যে বাংলা ভাষা আন্দোলন একদিন সর্বাত্মক শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ নিয়ে স্বাধীন বাঙলাদেশ তৈরী করে বিশ্ববাসীকে উৎসাহিত ও উদ্দীপিত করেছে, সেই বাংলা ভাষা আজও অবদমন ও শোষণের শিকার হয়ে রয়েছে৷

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভাষার ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজ্য তৈরীর নীতি নিয়ে বাংলাভাষীদের জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হয়, কিন্তু দেখা যায় বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন এলাকাকে কোথাও অসমের সঙ্গে, কোথাও বা ওড়িষ্যার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে৷ পরে আবার বিহার থেকে ঝাড়খণ্ড সৃষ্টি হয়েছে, ওই ঝাড়খণ্ডের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা৷ অথচ সমস্ত এলাকায় বাঙালীরা ওই মাতৃভাষার চর্চার সমস্ত সুযোগ হারিয়েছে৷ বিদ্যালয়ে বাঙালীরা বাংলা পঠন পাঠনের সুযোগ হারিয়েছে৷

বৈবহারিক ক্ষেত্রে বেসরকারী, সরকারী সর্বক্ষেত্রে বাংলাকে অপাংক্তেয় করে রাখা হয়েছে৷

ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বাংলা ভাষাই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হলেও সুকৌশলে জাত বাঙালী মাহাতোদের ভাষাকে বাংলা ভাষা বলে স্বীকৃতি না দিয়ে শোষকরা বাংলাকে তার যথার্থস্থান দেওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে৷ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাকে প্রথম রাজভাষা করার দাবীতে ঝাড়খণ্ডের ‘আমরা বাঙালী’ দল দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে৷ প্রাউটিষ্টরা দাবী করে, ঝাড়খণ্ডের সর্বত্রই বিদ্যালয়ের পঠন–পাঠন, অফিস, আদালত, সরকারী ও বেসরকারী সমস্ত কাজকর্মই বাংলা ভাষার মাধ্যমে হওয়াই উচিত৷ বাংলা ভাষার অবদমনের বিরুদ্ধে শুধু ঝাড়খণ্ড কেন, সমস্ত বাংলা ভাষা–ভাষী এলাকাতেই তীব্র আন্দোলন হওয়া উচিত৷

পশ্চিমবঙ্গেও এখনও পর্যন্ত বহুক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারী কাজকর্ম ইংরেজীতে হয়ে থাকে, সাধারণ গ্রামে ইংরেজীতেই বিভিন্ন নোটিশ বা সরকারী নির্দেশ যায়, এটা হওয়া মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়৷ আদালতের রায় প্রভৃতিও বাংলাতেই হওয়া উচিত৷ এ ব্যাপারে আমরা মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি৷ সমস্ত প্রকার বৈবহারিক ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হোক৷ সমস্ত বাঙালীদের অন্তরের এটাই সুচিরসঞ্চিত আশা৷