বাঙালী বিতাড়ন ঃ কিছু কথা

লেখক
সূর্য গুপ্ত

ভূমিকা

মহান নাট্যকার সেক্সপীয়র বলেছিলেন --- রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এমন ধান্দাবাজ যে তারা ঈশ্বরকেও ধোঁকা দিতে পারে৷ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীদের কথায় ভুলে বাঙালী আর কতবার বঞ্চিত হবে, নিপীড়িত হবে, বিতাড়িত হবে? বিদেশী বাঙালীদের অসম থেকে তাড়াতে চাইছে বিজেপি ৷ কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে এর পেছনে রয়েছে ধর্মভিত্তিক জাতপাতের সুড়সুড়ি৷ গোপনে তাই প্রচার চলছে অসমে হিন্দুদের ভয় পাবার কিছু নেই৷ উদ্দেশ্যে অসমীয়া ও হিন্দু বাঙালীর ভোটে ক্ষমতা দখল করা৷ ‘বিদেশী’ যদি তাড়াতে হয় লক্ষ লক্ষ নেপালীদের তাড়ানো হচ্ছে না কেন? বাঙালীর বিদেশী আর নেপালীরা কোন যুক্তিতে স্বদেশী? বিজেপিরা তাদের সমর্থন নিয়ে ভোটে দাঁড়ায় কী করে?

ধান্দাবাজ অগপ (অসম গণপরিষদ) ও বিজেপি

এদের নেতৃবৃন্দ ভুলে গেলেও বাঙালীরা ভোলেনি যে অসমে প্রফুল্ল মহান্তি ও ভৃগু ফুকনের নেতৃত্বে বোটের দিকে তাকিয়ে অসমিয়ারা শ্লোগান তুলেছিল --- অসমিয়া- মিঞা ভাই ভাই৷ উদ্দেশ্য মিঞা অর্থাৎ মুসলমানদের সঙ্গে অসমিয়াদের ভোট যোগ করে নির্বাচনে জয়লাভ করা৷ হয়েওছিল তাই৷ আজ সেই পীরিত ছুটে গেছে বলে ভোটের স্বার্থে অসমিয়ারা হাত ধরেছে বিজেপির৷ বিজেপিও হিন্দু সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে অসমিয়াদের সঙ্গে মিলে ভোটে জেতার স্বপ্ণ দেখছে৷ তাই চলছে বাঙালী বিতাড়ন৷ সুপ্রিম কোর্ট, নাগরিক পঞ্জী এসব ঢাল ছাড়া কিছুই নয়৷

অসমে আসল বিদেশী কারা?

অসমের ধুবড়ী, গোয়ালপাড়া, কোকরাঝাড়, নগাঁও, কাছাড় বরাবর বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা৷ যখন অসম প্রদেশ তৈরী হল তখন আর্থিক দুর্দশার কথা ভেবে অসম নেতৃবৃন্দ বাঙলার নিজস্ব কিছু অঞ্চল অসমের সঙ্গে যুক্ত করার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রার্থনা করে৷ কেন্দ্রের অনুরোধে বিধান রায় মহাশয় অনেক ভাল কাজের মধ্যে একটা খুবই খারাপ কাজ করলেন৷ বাঙলার নিজস্ব বিস্তীর্ণ অঞ্চল অসমকে বাঁচাতে অসমকে দিয়ে দিলেন৷ আজ সেসব অঞ্চলেই বার বার বাঙালী খেদাও হচ্ছে৷ এর জন্যে কি দোষী বাঙালী?  ছয়টা জাত-বাঙালীদের মধ্যে রাজবংশীরা অন্যতম৷ রাজবংশী নেতা হরিদাস মন্ডল ‘কোচ’ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ও তা কামরূপ-কামাখ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল৷ সেখানকার নাম ছিল ‘প্রাগ্জ্যোতিষপুর’৷ বার্মা থেকে অহম রাজারা এসে বাঙালী অধ্যুষিত বিস্তৃত অঞ্চল দখল নেয়৷ সুতরাং বন্ধু অসমে বিদেশী যদি কেউ হয়ে অসমিয়ারা৷ তারা বাঙালীদের বিদেশী বলে কোন অধিকারে?

উদ্বাস্তু সমস্যা ও বাঙালী ঃ-

গদির লোভে দেশের নেতৃবৃন্দ বাঙলা ভাগকে মেনে নিয়ে স্বাধীনতা মেনে নিলেন৷ কথাছিল যতদিন একটাও উদ্বাস্তু বাঙালী নিজস্ব বাসভূমে আসবে তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে৷ পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আগত উদ্বাস্তুদের মাত্র দুই বছরের মধ্যে পূণর্বাসনের ব্যবস্থা হয়ে গেল কিন্তু বাঙালী উদ্বাস্তুরা আজও বিতাড়িত এক স্থান থেকে অন্যত্র৷ কেন? এর কারণ হচ্ছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের দালালরা বাঙালীদের ভয় পায়৷ স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালীদের অবদান কে না জানে? বাঙালীদের আত্মত্যাগে কেবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভীত ছিল, তাই নয়৷ দেশীয় হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের দালালরা ভিতরে ভিতরে ভীত ছিল৷ তাই কম্যুনিষ্টসহ বিভিন্ন দালালরা উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনীতি করেছে কিন্তু বাঙালীদের কোথাও থিতু হতে দেয়নি৷ সরকারী মদতে বাঙলায় লুন্ঠনকারী ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠা হয়েছে যাদের মূলভাবনা হচ্ছে ‘পরদেশ মে আয় হো যিতনা সকো লুঠলো৷’’ তারাই বাঙলা মুলুকে অবাঙালীদের কর্মের সংস্থান করে ভরিয়ে দিচ্ছে আর বাঙালীরা নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাচ্ছে৷ রাজনৈতিক দলগুলি কেবল গরীব বাঙালীদের নিয়ে রাজনৈতিক গুটি সাজিয়েছে সমস্যার কোন সমাধান হয়নি৷

গোর্খাল্যাণ্ড?

আপনাদের কাছে যারা আজ যারা বড় বড় কথা বলছে তারাই কিন্তু বাঙলা ভাগ করে গোর্খাল্যাণ্ড বানানোর কথা বলছে যেন দার্জিলিঙ তাদের বাপের জমিদারী ৷ অথচ দেখুন বাঙালীদের কথা বললে কিছু দালাল আছে প্রাদেশিক প্রাদেশিক বলে চেঁচায়৷ এই ভারতে যদি তামিলদের জন্যে ‘নাড়ু’ থাকতে পারে (তামিল নাড়ু) ,মিজোদের জন্যে ‘রাম’ থাকতে পারে (মিজোরাম), মারাঠীদের জন্যে মহারাষ্ট্র হতে পারে, ওড়িয়াদের জন্যে উড়িষ্যা হতে পারে, পাঞ্জাবীদের জন্যে পাঞ্জাব হতে পারে আর বিদেশী গোর্খাদের জন্য গোর্খাল্যাণ্ড হতে পারে তবে পূর্বাঞ্চলের সমগ্র বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে ‘বাঙালীস্তান’ সংবিধানের ৩য় ধাপ অনুযায়ী হবে না কেন? এতে তো বাঙালীদের নিজস্ব অঞ্চলে বাঙালীরা বসবাস করবে আর বিতাড়িত হতে হবে না৷ সোজা কথাটা সোজা ভাবে বুঝুন৷ কিছু টাকার লোভে আর রাজনৈতিক দাদাদের হয়ে দাদাগিরি দয়া করে করবেন না৷ বাঙালীদের বাঁচাতে নিজেদের দল গড়ে তুলুন৷

 বাঙলা আমার মা

সুভাষচন্দ্র বসু , নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল প্রমুখ বাংলা ভাষায় বাঙালা মায়ের জয়গান করে গেল৷ আর আমরা হরিদাসের পোলারা তাদের জন্মদিন ঘটা করে পালন করে বাঙালীদের সর্বনাশ করে চলেছি৷ আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত যে ওপার বাঙলায় মুসলমান বাঙালীরা লড়াই করে বাঙলা ভাষাকে বিশ্বভাষায় পরিণত করে দিল৷ বাঙলা মা’কে স্বাধীন করে দিল৷ আর এ বাঙলার হিন্দু-মুসলমান জাত-পাতের সুড়সুড়ি দিচ্ছি৷ একথা কি অস্বীকার করা যাবে যে মুসলমান বাঙালী হিন্দু বাঙালীদের থেকে বেশী বাঙালী৷ এপার বাঙালায় আমরা কেবল নেতাদের পদরজ মাথায় তুলে নিন্দাবাদ করে চলেছি৷ একথা ভুললে চলবে না ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে রাজ্য বা রাষ্ট্র টেঁকে না৷ তা যদি হতো তাহলে দুই পাকিস্তান আলাদা হতো না৷ তাই একবার উচ্চকন্ঠে বাঙলা মা-কে ডাকুন৷ বাঙলার হয়ে লড়াই করুন৷ বাঙালীকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করুন৷ জেনে রাখবেন বাঙলা বাঁচলে তবেই ভারত বাঁচতে৷

অসমিয়ারা বাঙালী খেদাও বন্ধ করুক

অসমে বাংলা ভাষীরা যে সবাই বাঙলাদেশ থেকে এসেছে তা তো নয়৷ বেশীর ভাগই এদেশের ভূমিপুত্র৷ যে ৪০ লক্ষ বাঙালীর নাম নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়েছে তাদের মধ্যে অনেকের জন্ম অসম, ত্রিপুরা, বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গে৷ তাহলে বাঙালীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে অসমিয়ারা যদি কোন রাজনৈতিক দলের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে বাঙালী খেদাও-এ অনড় থাকে তাহলে কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাবে না৷ কারণ যদি উপায় না দেখে বাঙালীরা বলতে শুরু করে বাঙালীস্তান থেকে মাড়োয়ারী, অসমীয়া, বিহারী, ওড়িয়া খেদাও তাহলে সুখকর হবে কি? শুধু তাই নয় মাত্র ৪০ শতাংশ অসমিয়া ৬০ শতাংশ অ-অসমিয়াদের তাড়াবে এমন ভাবা মুখের স্বর্গে বাস করা৷ তা না হলে অদৃষ্টের ফেরে হয়তো অসমিয়াদের বার্মাতেই ফিরে যেতে হবে৷ তার চেয়ে নোংরা রাজনীতি বন্ধ করে দেশ ও জাতি গঠনের কাজে হাত লাগান৷