বাঙালী জাতির অস্তিত্বের লড়াই

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

গত ১লা নভেম্বর অসমের তিনসুকিয়ায় বাঙালী বিদ্বেষী এক জঙ্গীগোষ্ঠী পাঁচ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালীকে চরম নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে৷ নিহতকরা গরীব খেটে খাওয়া বাঙালী৷ তারা কেবলমাত্র বাঙালী---এছাড়া এদের বিরুদ্ধে আর কোনরকম অভিযোগও ছিল না৷ এন আর সি, ডি ভোটার নিয়েও তাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ছিল না৷ তবুও তাদের এমনই বর্বরভাবে হত্যা করা হ’ল!

এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার, অসমে এক শ্রেণী বাঙালী বিদ্বেষী গোষ্ঠী যেন-তেন-প্রকারে অসম থেকে বাঙালীদের তাড়াতে চায়৷ এ ব্যাপারে এদের সঙ্গে সরকারেরও মদত আছে৷ আর তার জন্যে এন আর সি, ডি ভোটার তৈরী করা৷ নাহলে ভারতের আর কোথাও এন আর সি, বা ডি-ভোটার করা হচ্ছে না, কেবল অসমেই তা করা হচ্ছে কেন? কেন গুজরাতে, রাজস্থানে, পঞ্জাবে, দিল্লীতে, চেন্নাইয়ে, বা উত্তরপ্রদেশের কোথাও এসবের কোন বালাই নেই৷ সর্বত্রই তো সীমান্ত রয়েছে ও সীমান্ত-সমস্যা রয়েছে! তাই এর পেছনে উগ্র অসমিয়া জাতিবাদী জঙ্গীদের সঙ্গে কেন্দ্রেরও যে বিরাট ষড়যন্ত্র রয়েছে তা পরিষ্কার৷

স্বাধীনতার পর অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ নলবাড়ির এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘‘অসম রাজ্য শুধু অসমীয়াদের জন্যে৷’’ ১৯৫০ সাল থেকেই অসমে চলছিল ‘‘বঙ্গাল খেদা’’ আন্দোলন৷ তখন থেকেই বাঙালীদের ওপর বার বার আক্রমণ ও নির্যাতন নেমে আসে যার বীভৎস রূপ দেখা যায় ৮০-এর দশকে৷ বাঙালী বিদ্বেষী চক্রান্তের ফলে ১৯৮৩ সালে অসমে রক্তক্ষয়ী বাঙালী নিধনযজ্ঞ হয় তাতে প্রায় ১০ হাজার বাঙালী নিহত হয়েছিল৷ সেই সময় তথা ১৯৮৫ সালে বাঙালী বিদ্বেষী অসমের এ.জি.পি দলের সঙ্গে ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর বিদেশী বিতাড়ন চুক্তি হয় ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চকে ভিত্তি বছর ধরে৷ এই বিদেশী বিতাড়ন চুক্তি যে আসলে জঙ্গীদের সঙ্গে কেন্দ্রের বাঙালী বিতাড়ন চুক্তি ছিল তা বর্তমান ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে৷

অসমের ইতিহাসে  সামান্য একটু পর্যালোচনা করলে  আমরা জানতে পারি ঃ ‘‘১৯১২ সালে যখন অসম প্রদেশ তৈরী হয়, তখন দেখা যায়, অসম প্রদেশের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়৷  কলকাতার বার্ষিক আয়ের চেয়ে নবসৃষ্ট অসমের বার্ষিক আয় কম৷ তাই এই নবসৃষ্ট রাজ্যে  আর্থিক অবস্থা দৃঢ় করবার জন্যে  বাঙলার সিলেট, কাছাড় ও উত্তর-পূর্ব রংপুর জেলা তিনটিকে  নবসৃষ্ট অসম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়৷ রংপুর রইল বাঙলায় আর উত্তরপূর্ব রংপুর গেল অসমে৷ এটি একটি বিসদৃশ ব্যাপার৷ তাই ইংরেজরা উত্তরপূর্ব রংপুর জেলার নাম পরিবর্তন  করে  নূতন নাম দেন ‘গোয়ালপাড়া’৷ তবে জেলা সদর থেকে  যায়  ধুবড়িতেই ৷ গোয়ালপাড়া জেলাটি ত্রিধা বিভক্ত হয়েছে --- (১) ধুবড়ি, (২) কোকরাঝাড় ও (৩) গোয়ালপাড়া৷’’ (‘বাঙলা ও বাঙালী’ ঃ শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার)৷

এইভাবে নানান রাজনৈতিক ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা ইতিহাসের আলোয় এটা সকলেরই জানা যে, বর্তমান অসমের  নওগাঁ, হোজাই,লঙ্কা, লামডিং, বরপেটা, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, কাছাড়, মিকির পাহাড়ের সমতল অংশ---  এসবই প্রাচীনকাল থেকে মূল বাঙলার অংশ ও বাঙালী অধ্যুষিত৷ বর্তমান এই এলাকাগুলি  অসমের অন্তর্গত হলেও  বাঙালীরাই  এখানকার  ভূমিপুত্র  বা ভূমিকন্যা৷  কোনও যুক্তিতে  এই অঞ্চলের বাঙালীরা অসমে বিদেশী হিসেবে চিহ্ণিত হতে পারে না৷  অথচ এই এলাকায়  এন.আর.সি-র নামে লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে অনুপ্রবেশকারী ও বিদেশী তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ তাই বর্তমানে বৈধ নথিপত্র বা পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও বাঙালীদের অনেককেই কেবলমাত্র বাঙালী হওয়ার জন্যে  এন.আর.সি থেকে ইচ্ছাকৃত  ভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে৷

আর, যারা দেশভাগ জনিত সমস্যার বলি হয়ে  তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে পরিস্থিতির চাপে ভারতের অসম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যে চলে এসে কোনোরকম বাঁচার পথ খুঁজে নিয়েছে, তাঁরাও তো ভারতের বৈধ নাগরিকই৷ দেশভাগ জনিত সমস্যার বলি বাঙালীদের প্রতি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর প্রতিশ্রুতি ছিল--- ‘Whenever the minorities  of West Bengal will cross the border they will be welcome৷’’ --- অর্থাৎ যখনই পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু  তথা বাঙালীরা সীমানা অতিক্রম করে ভারতে আসবে তাদের স্বাগত জানানো হবে৷ তাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘বিদেশী’ তক্মা দেওয়ার প্রশ্ণই  বা উঠে কি করে? যাদের রক্তের বিনিময় ভারত স্বাধীনতা পেল সেই বাঙালীদের  ভারতে  ‘বিদেশী’ বলে অভিহিত করার অধিকার তারা কোথা থেকে পায়?

আজ তাই সর্বত্রই বাঙালীদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে  মাথা তুলে বাঁচতে হলে  সমস্ত বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে৷ এটা বাঙালী জাতির অস্তিত্বের লড়াই---তা ভুললে চলবে না৷