বাঙালীকে রাষ্ট্রহীন করতেই নাগরিক সংশোধন আইন

লেখক
এইচ. এন. মাহাত

ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ করে এন.আর.সি. , এন.পি.আর,  সি.এ.এ. নিয়ে তৎপর হ’ল কেন? এত জোর দিয়ে আইন সংশোধন করে সরকার কী বোঝাতে চাইছে? বাঙালী জনগোষ্ঠী একটু ভেবে দেখেছেন কী? ব্যষ্টিগতভাবে আমার মনে হয় এন.আর.সি. হওয়া খুবই প্রয়োজন৷ কিন্তু ভারতের সংবিধানের আওতায় থেকেই তা হওয়া উচিত ছিল৷ তার জন্যে নূতন আইনের কোন প্রয়োজন ছিল না৷ আসলে বিজেপি সরকার বোঝাতে চাইছে দীর্ঘ ৭০ বছরের সমস্যার তারা আইন সংশোধন করেই করে দেবে৷ আসলে সংবিধানের আওতায় থেকেই করলে কিছু বলার ছিল না৷ কিন্তু আইন সংশোধনের উদ্দেশ্যটা মহৎ নয়, আর লক্ষ্যটা গোটা দেশ নয়৷ পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালী জনগোষ্ঠীর দিকে নজর রেখেই এই নাগরিকত্ব সংশোধন আইন৷

ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল পঞ্জাব ও বাঙালীস্তানকে ভাগ করে৷ তৎকালীন ভারতে নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা তীব্র বাঙালী বিদ্বেষী ও ক্ষমতালোভী৷ তাছাড়া নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের কথায় তারা প্রমাদ গুণছিলেন৷ নেতাজী বলেছিলেন---ব্রিটিশের সূর্য অস্তগামী৷ অপেক্ষা করুন, আমাদের প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা৷

সেই সময়ের বৃদ্ধ নেতৃত্বের মনে আতঙ্ক ধরেছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেতে গেলে আন্দোলন আরও দীর্ঘ হ’ত৷ ওই নেতারা ভেবেছিল আমাদের আর ক্ষমতায় বসা হ’ল না! তাই দিল্লীর দরবারে বসতে যা পাই তাই শ্রেয়৷ এর জন্যে দেশ ভাগ হলেও কিছু যায় আসে না৷

আসলে দেশভাগের কাঁটা ওই নেতাদের গায়ে বিঁধবে না৷ ওদের পরিবারেরও সুখের ব্যাঘাত ঘটবে না৷ তাই দেশভাগ নিয়ে ওদের চিন্তা ছিল না৷ একবারও ওরা স্বাধীনতার জন্যে যাদের অবদান, যাদের আত্মত্যাগ অনস্বীকার্য সেই বাঙালীর কথা ভাবে নি৷

স্বাধীনতার পর দেশভাগের বলি পঞ্জাবীদের অঢেল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হয়েছে৷ এছাড়াও পঞ্জাবে ভাকড়া-নাকাল বাঁধ তৈরী করে রুক্ষ্ম মাটিকে সুজলা-সুফলা করে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু বাঙালীস্তানে পূর্বপাকিস্তান থেকে যারা এসেছিল তাদের প্রতি সামান্য সহানুভূতিও দেখায়নি বাঙালী বিদ্বেষী কেন্দ্রীয় সরকার৷ যারা মান-সম্মান বাঁচানোর জন্যে পৈত্রিক ভিটেমাটি ধন-সম্পদ ছেড়ে সামান্য কাপড়ে চলে এসেছিল তাদের স্থান হ’ল ফুটপাত, রেলষ্টেশন নয়তো পড়ে থাকা পতিত জমি৷ তাদের জন্যে না একটা বসতি করে দেওয়া  হয়েছে, না কোন পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে৷ শাসক বিরোধী কোন পক্ষই সেদিন বাঙালী উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়ায়নি৷ তাদের পাঠানো হ’ল আন্দামন দ্বীপপুঞ্জে, ওড়িষ্যার মালকানগিরি  ও রাজস্থানে রুক্ষ্ম মাটিতে৷ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতেও অনেক উদ্বাস্তু বাঙালী বহু সংগ্রাম করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আজ ৭২ বছর পরে তাদেরকে বিদেশী বানানো হচ্ছে৷ আসলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ভূত পুঁজিবাদের অর্থে পুষ্ট শাসকদের আজও তাড়া করছে৷ তাই বাঙালীকে তাদের এত ভয়৷ তাই  বাঙালীকে রাষ্ট্রহীন করার এই ঘৃৃণ্য চক্রান্ত৷

এন.আর.সি. মানে কত সাল থেকে বসবাস করছেন, আপনার ডালপালা কারা, কাগজে কলমে আপনার পরিচয়পত্র ঠিক না বেঠিক, এককথায় াপনার নাগরিকত্ব ঠিক করবে বাঙালী বিদ্বেষী কয়েকটা ভারতীয়৷ কেননা বিপ্লবী মানসিকতার বাঙালী জনগোষ্ঠী অন্যায়-অবিচার দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার চেয়েও বড় কথা হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাঙালীর প্রতিবাদ৷ তাই বাঙালীকে পৃথিবী থেকে এরা শেষ করতে চায়৷ অসমে ৫০ লক্ষ বাঙালীকে এরা বেদেশী বানিয়েছে ও গোটা দেশে কয়েক কোটি বাঙালীকে এরা রাষ্ট্রহীন করতে চায়৷

সি.এ.এ. নতুন ভাবে করে এরা জানতে চায় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ, জন্ম বৃত্যান্ত তার পরেও আপনাকে লিখতে হবে আপনি একজন উদ্বাস্তু৷  এরপর কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা হবে৷ কেননা  আপনি এন.আরসি.তে স্বীকার করেছেন  আপনি  উদ্বাস্তু৷ এখন সরকার ইচ্ছা করলে আপনাকে জেলে পাঠাতে পারে৷

দ্বিতীয়তঃ উদ্বাস্তু লিখলে আপনার সম্পত্তি আপনার হাতে থাকবে না৷ দীর্ঘ ৭০/৭২ বছর দেশে থেকে যা কিছু করেছেন সবই আপনার পণ্ডশ্রম৷ আপনার কোন পরিচিতিই থাকবে না৷

তৃয়তঃ আপনি যে দেশ থেকে এসেছেন, কী কারণে এসেছেন তার লিখিত প্রমাণ আনতে হবে৷ যে মানুষটি অত্যাচারিত হয়ে দেশ ছেড়ে চলে আসছে তার পক্ষে সম্ভব কী লিখিত আনার? সেই দেশ কি কোন লিখিত দেবে? এই সহজ সত্যটা এক শ্রেণীর বাঙালী বুঝতে চাইছে না৷ অথচ লিখিত না দেখালে এই দেশের আইন আপনার জন্য নয়৷ এই দেশের মাটি আপনার জন্য নয়৷ এই আপনার থাকার অধিকার নেই৷ এখন আপনি বুঝুন কোথায় যাবেন!

৭২ বছরে দিল্লী ও রাজ্যের ক্ষমতায় থেকে কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি কেউ উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করেনি৷ এরা সবাই বাঙালী বিদ্বেষী৷

চতুর্থতঃ আপনি উদ্বাস্তু শব্দ থেকে মুক্তি পেতে বৈধ কাগজপত্র জমা দিলেও সরকার আপনাকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেবে এমন কোন তারিখ বা প্রতিশ্রুতি কোন আইনে নেই৷ তাই আপনি আবার নাগরিকত্বহীন, রাষ্ট্রহীন  উদ্বাস্তু হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন৷

শেষ কথা বলব, ভারতে বাঙালী জাতি সত্তা বাঁচাতে একটি পথ খোলা আছে, তা  হ’ল আমরা বাঙালীর দীর্ঘদিনের দাবী সংবিধানের ৩ নং ধাররা মেনে বাঙালী জনগোষ্ঠীর বাসস্থান ‘বাঙালীস্তান’ গঠন৷ অন্য কোন  পথ নেই৷