বাঙালির বইমেলা আছে কিন্তু বইপড়ার অভ্যাস নেই

লেখক
বীরেশ্বর মাইতি

জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আমার এগরা মহকুমা বইমেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল৷ অনেকদিন আগে থেকেই  চারিদিকে  পোস্টারে ব্যানারে হোর্ডিং এর মাধ্যমে প্রচার চালানো হয়েছিল৷ বইমেলা উপলক্ষ্যে সোস্যাল মিডিয়াতেও বিস্তর প্রচার করা হয়েছিল৷ সে দিক থেকে দেখতে গেলে  এগরা হচ্ছে  একটি মফস্বল শহর৷ শহরে শিক্ষিত মানুষের  বসবাস৷ বেশিরভাগ মানুষই চাকুরিজীবী বুদ্ধিজীবী৷ এই শহরে নামিদামি  স্কুল যেমন রয়েছে  তেমনি কলেজ রয়েছে৷ মহকুমা শাসকের কার্যালয়, কোর্ট, মহকুমা হসপিটাল সুপার  স্পেশালিটি  হসপিটাল প্রভৃতি শহরের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷ যে কারণে প্রচুর মানুষের ভিড় হয় এই শহরে৷

পরিকল্পনা মতো আমি আর আমার এক বাল্যবন্ধু শীতের বিকেলে বই মেলায় গিয়ে হাজির হলাম৷ গিয়ে যা দেখলাম সেটা সত্যিই অবিশ্বাস্য৷ মঞ্চে তখন সান্ধ্যাকালীন সাংসৃকতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে৷  মঞ্চের উপরে একজন সুবক্তা বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ওপর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করছেন৷ পাশে বিশেষ অতিথি প্রধান অতিথি  আরো অন্যান্য কর্মকর্তারা রয়েছেন৷ অথচ যাদের জন্যে এই আয়োজন অর্র্থৎ দর্শক  একেবারে নেই বললেই চলে৷ হাতে গোনা চার-পাচজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন তাও অনুষ্ঠান শোণার জন্য নয়৷ কারোর জন্যে অপেক্ষা করছেন  অথবা কি হচ্ছে দেখার জন্যে এসেছেন এক্ষুনি হয়তো চলে যাবেন৷

বই মেলায় নাই নাই করে সত্তর থেকে আশিটি বইয়ের ষ্টল ছিল৷ বেশিরভাগই কলকাতার প্রকাশন৷ আয়োজনেরও  কোন ত্রুটি নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেশ ভালো তবুও পাঠকের  দেখা নেই৷ স্টলগুলোতে বই কেনার জন্যে মানুষের হুড়োহুড়ি নেই,কোন ব্যস্ততাও চোখে  পড়লো  না, বরং বিষন্ন মুখে  বই বিক্রেতাদের বসে থাকতে দেখা গেল৷ তাদের সাথে  কথা বলে জানা গেল বিক্রি বাটার অবস্থা খুবই খারাপ৷ মেলা শেষ হওয়ার মুখে অথচ বিক্রি-বাটা সেভাবে কিছুই  হলো না৷ ষ্টলের খরচ, নিজেদের পারিশ্রমিক সবকিছু বাদ দিয়ে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশী হল৷ সারা বইমেলায়  ৫০ জন ক্রেতাকেও দেখতে পাওয়া গেল না৷

একই রকম চেনা ছবি অন্যান্য জেলা বা মফস্বল বইমেলাগুলোতে চোখে পড়ে৷ বইমেলার আকর্ষণ কিছুটা হলেও হারিয়েছে---একথা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ নোতুন প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার উৎসাহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে৷ সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অবসর যাপনের জন্যে তরুণ প্রজন্ম সদা-সচেষ্ট৷ তাই হয়ত বই পড়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে৷ যার প্রভাব বইমেলায় পড়ছে৷

কলকাতা বইমেলার রয়েছে জগৎজোড়া খ্যাতি৷ কলকাতা বইমেলা বাংলার গর্ব, বাঙালির  গর্ব তথা ভারবর্ষের গর্ব৷ আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা নিয়ে  তাই হয়তো  সমাজের সর্বস্তরের মানুষের  মধ্যে থাকে চরম উন্মাদনা৷ জেলা শহর বা মফস্বলের বই মেলার মধ্যে যে জনসাধারণের  অনুপস্থিতি দেখা যায় কলকাতা বইমেলার  ক্ষেত্রে  তা হয়তো কিছুটা  ব্যতিক্রম৷ এক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, বইমেলা শুরু হতে না হতেই যেভাবে  প্রচার চালানো হয় তাতে  সমাজের প্রতিটি মানুষের মনে বই মেলায় যাওয়ার বিষয়ে একটি প্রবণতা তৈরী হয়৷

প্রচুর মানুষের ভিড় হওয়া মানেই যে বইমেলার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে  তা কিন্তু বলতে পারি না৷ হুজুক  প্রিয় বাঙালি হুজুগে মেতে থাকতে ভালোবাসে৷ প্রতিদিন যত মানুষ  বইমেলায় যান প্রত্যেকে যদি একটি করে বই কিনতেন তাহলে যে পরিমাণ বই বিক্রি হতো তাতে কলকাতা বইমেলার মান রক্ষা হত৷ বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে  সংখ্যাগরিষ্ঠ  মানুষের মধ্যে শুধু খাওয়া-দাওয়া, হইচই, ঘুরে বেড়ানো, ছবি তোলা---এটাই বইমেলায় যাওয়ার একমাত্র  বা অন্যতম উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সত্যিকারের বইপ্রেমীর  সংখ্যা হয়তো খুবই কমে যাচ্ছে তা না হলে বই বিক্রেতাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিত না৷

আন্তর্জাতিক বইমেলার নোতুন চমক ঃ এক লাখ টাকার বই নিলে পাবেন আকর্ষণীয় পুরস্কার৷

সাধারণ মানুষকে বইমুখী করতে কলকাতা  বইমেলা  কর্তৃপক্ষ একটি নোতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কয়েক বছর আগে৷ যারা নূ্যনতম এক হাজার টাকার বই ক্রয় করবেন তাদের একটি লটারী কুপন দেওয়া হবে৷ লাকি ড্রয়ের  মাধ্যমে তিনি পেতে পারেন একটি গাড়ি৷ এছাড়া কুড়ি পঁচিশ হাজার টাকার  বই রাখার র্যাক ও অন্যান্য সাজ সরঞ্জামও মিলতে পারে৷

এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য৷ কিন্তু  এখান থেকে একটা সত্য পরিষ্কার  হয় যে  বইমেলার  ভিড় যতো বাড়ছে , সেইভাবে  বই পড়া মানুষের  সংখ্যা তত বাড়ছে না, তা না হলে লটারীর লোভ দেখিয়ে মানুষকে বই কিনতে  উৎসাহিত  করতে হবে কেন?