বাঙালীর জাতিসত্ত্বা, ভাষা, লিপি ও কৃষ্টি কি হারিয়ে যেতে বসেছে

লেখক
জে.ডি. মণ্ডল

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 বাংলা ভাষার বিবর্ত্তন ঃ প্রাচীনকাল থেকে বর্ত্তমান রূপঃ--- প্রাচীন বাংলা ভাষার কয়েকটি উদাহরণঃ---(ক) প্রাচীন বাঙলা সাহিত্যে খাদ্য তালিকায় আছে---

ওগগর ভক্তা, রম্ভাপত্তা,গাইক্ক ঘিত্তা, দুগ্দ সজন্তা,

নালিতা গচ্ছা, মোল্লামচ্ছা, দিচ্ছই কন্যা,খাত্র পুন্যবন্তা৷

অর্থাৎ ‘ওগ্‌গর ভক্তা’ মানে গরম গরম ভাত, আর এই ভাত দেওয়া হতো কলাপাতায়---ভাতের সাথে ফুটিয়ে দুধ দেওয়া হত৷ তার সঙ্গে ঘি, মৌরালী মাছ,আর নলতে শাক৷ কান্তা দিচ্ছে আর পুন্যবান খাচ্ছে৷

তারপর---

            টালত ঘর মোর নাহি পড়িবেশী,

            হাঁড়ির ভাত নাই নিতি আবেশী৷

প্রাচীন বাঙলায় বিনিময় বাণিজ্য সম্বন্ধে বলা হয়---

কুরঙ্গ বদলে লবঙ্গ নিব, কুমকুম বদলে চুয়া, গাছফল বদলে জায়ফল পাব, বহেড়ার বদলে প্তয়া৷

অন্যত্র---

কুড়বা কুড়বা লিজ্যে, কাঠায় কুড়বা কাঠায় লিজ্যে

কাঠায় কাঠায় ধূল পরিমাণ, বিশ ধূলে হয় কঠোর প্রমাণ৷

গণ্ডা যদি থাকে বাকী কাঠা নিলে পর,

ষোল দিয়ে হরে তারে যারা গণ্ডা ধর৷ ইত্যাদি

বাংলা সাহিত্য প্রথমে আসে কাব্য ও কবিতারূপে৷ যথা, মঙ্গলকাব্য তাতে একে একে---মনসা মঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি৷ এতে যেমন তৎকালীন সামাজিক, ইতিহাস ফুটে উঠে, তেমনি ও আলোকিত হয় সে সময়ের সমাজচিত্র৷ সঙ্গে  বিবৃত হয় তখনকার গণমানসের চিত্রও৷

কবি কঙ্কন মুকুন্দরামের ‘ফুল্লরার বারমস্যা’ এক বাঙালী নারী তথা বিশ্বনারী সমাজের সারাবছরের বেদনার কথা ফুটে  উঠেছে--- ‘কত শত খায় জোঁক, নাহি খায়  ফণী’ অথবা দারিদ্রের চিত্র--- শীত নিবারণের উপায়---

‘তৈল তূলা তনুপাত

তাম্বুল তপণে৷’

সংস্কৃত থেকে বাংলায় মহাকাব্য অনুবাদ প্রাঞ্জল ভাষায়  কবি কৃত্তিবাস ওঝার ‘মহাভারত’ আর কবি কাশিরাম দাশের  পদ্যে ‘রামায়ণ’ আজও ঘরে ঘরে গীত হয়৷ মূল রচনার চেয়ে এই কবিদ্বয়ের অনুবাদ অত্যন্ত মধুর, হৃদয়গ্রাহী ও ভাবগম্ভীর৷

সে সঙ্গে ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন,’ ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ বাঙালার আকাশে বাতাসে আধ্যাত্মিক ভাব উদ্‌গীরণে যথেষ্ট ভূমিকা  গ্রহণ করে৷

পরিশেষে, মাইকেল মধূসূদন দত্তের অমিত্রাক্ষর ছন্দে ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ আজও অম্লান৷ তিনি প্রথম বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দে সনেট বা চর্তুদশপদী কবিত রচনা করেন৷

তারপর আসে বাংলা সাহিত্য গদ্যের যুগ৷ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলা হয়--- ‘বাংলা গদ্যের জনক’৷ ‘সাহিত্য সম্রাট’ ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে বাংলা গদ্য গল্প, উপন্যাসে সমাদৃত হয়৷ কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাব্যরসে সমৃদ্ধ করে বাংলা সাহিত্যকে আরও এক উচুঁ ধাপে উন্নীত করেন৷  বঙ্কিমচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসাদি তাদের সাহিত্য রসের জন্য বিভিন্ন ভাষার লোকজন অনুবাদ করেন৷ পরিশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার আধুনিক রূপদানে সচেষ্ট হন৷ তাঁর কাব্যরস এতটা সমৃদ্ধ হয় যে --- তিনি  এশিয়াতে  প্রথম মাতৃভাষায় ‘নোবেল পুরস্কার’ লাভ করেন৷

আজ সেই বাংলাকে অবমাননা, ধ্রুপদী ভাষার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া ---এসব কি সহ্য করা যায়?

বাঙালী জাতিসত্ত্বার প্রাচীনত্ব

‘বাঙলা হচ্ছে জম্বুদ্বীপ ও সুবর্ণদ্বীপের প্রত্যন্ত সীমায়৷ সভ্যতা এগিয়ে চলে নদী পথ ধরে৷ এখন এই যে রাঢ়ের সভ্যতা যা অজয়, ময়ূরাক্ষী, দামোদর--- এদের পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছিল, তার সঙ্গে  গাঙ্গেয় পালিতে তৈরী পৌণ্ড্রবধনু ভুক্তি, সমতট, ডবাক--- এরাও এসে মিশলো৷... এখানেই শেষ নয়, তিববতের ভেতর দিয়ে এসেছে ব্রহ্মপুত্র৷ এটি মঙ্গোলিয়ান দেশের ভেতর দিয়ে এসেছে৷ তিববতের  মানুষ হলো--- ইন্দো-টিবেটান গ্রুপ৷ সেটা মঙ্গোলিয়ান সভ্যতা৷’

এই তিন ব-দ্বীপিয় সভ্যতা--- রাঢ়সভ্যতা,গাঙ্গেয় সভ্যতা ও ব্রহ্মপুত্র সভ্যতার বিমিশ্রণের ফলে আজ থেকে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে সৃষ্টি হলো ‘আর্য্য-অষ্ট্রিকো মঙ্গোলিয়ান’ ইন্টিগ্রেটেড কালচার৷ পৃথিবীর আর কোথাও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের মত দুইটি বৃহৎ নদী ও তাদের ব-দ্বীপিয় সভ্যতা মিলিত হয়নি৷ ফলে, বাঙলার মানুষ বৌদ্ধিক দিক দিয়ে খুব উন্নত ও জটিল সভ্যতা৷ফলে, বাঙলার লিপি পৃথক, উচ্চারণরীতি পৃথক, বাঙালীদের দেহ গঠন পৃথক৷ শুধু তাই নয়, বাঙালীদের নিজস্ব পোশাক রয়েছে, মেয়েদের নিজস্ব শাড়ী পরবার পদ্ধতি রয়েছে, নিজস্ব পঞ্জিকা রয়েছে৷ নিজস্ব দায়াধিকার ব্যবস্থাও রয়েছে৷ যতদূর জানা যায়---এতগুলো বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর আর কোনও জনগোষ্ঠীর নেই৷ (ক্রমশ)