বাঙালীরা আর কতদিন ‘আ মরি’ বাংলা ভাষা বলতে পারবে?

লেখক
অসিতদগ্ধ দত্ত

ভাষা মানুষের অন্তরের ভাব প্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম৷ এই ভাষা মানুষের প্রাণীন সম্পদ---যা তার প্রাণধর্ম অর্থাৎ সত্তাগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ নিজস্ব মাতৃভাষায় একজন যেমন স্বচ্ছন্দে ও সাবলীলভাবে নিজের ভাবকে প্রকাশ করতে পারে তেমনটি অন্য কোন ভাষায় পারে না৷ মাতৃভাষা ছাড়া অন্যভাষার কথা বলতে সে অসুবিধা বোধ করে৷ প্রতিনিয়তই যদি তাকে অন্যভাষায় কথা বলতে বাধ্য করান হয়, তবে প্রাণশক্তি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে ও ক্রমশ তার প্রাণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে৷ ফলে ব্যষ্টি  বা ব্যষ্টিসমূহের মধ্যে এক মনস্তাত্ত্বিক সংকট দেখা দেবে যা তার মধ্যে এক হীনমন্যতার জন্ম দেবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে এক? পরাজিতের মনোভাব জাগবে৷ যার ফলে তারা কখনোই মাথা তুলে দাড়াতে পারবে না ও তাদের অকাল ও অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে৷

বিশ্বে সাতশোরও বেশী ভাষা রয়েছে যে ভাষায় বিশ্বের মানুষেরা কথা বলে৷ বহু ভাষা পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে গেছে৷ অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ভাষার সংস্পর্শে আসার জন্য অবিকশিত ভাষাগুলি অবলুপ্ত হয়ে গেছে৷ অবিকশিত ভাষাগুলির জনগোষ্ঠীর হীনমন্যতাবোধ অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ভাষার জনগোষ্ঠীর মহামান্যতাবোধ তথা অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে দাবিয়ে রাখার জন্যই বহু ভাষা অবলুপ্ত হওয়ার কারণ৷ এই দৃষ্টান্ত থেকে সভ্য মানুষের শিক্ষা নেবার প্রয়োজন আছে৷

এবার বাংলা ভাষার উপর খানিকটা আলোকপাত করা যেতে পারে৷ বাঙালী জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা, বুকের ভাষা, বাংলা৷ বাঙলায় তিনটি ব-দ্বীপীয় সভ্যতার বিমিশ্রন ঘটেছে গাঙ্গেয় সভ্যতা, ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা ও রাঢ় সভ্যতা৷ বাঙলার সভ্যতা হল রাঢ়ের গণ্ডোয়ানা সভ্যতা তার সঙ্গে উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সভ্যতা তার সঙ্গে তিববত-চীনের মঙ্গোলীয়ান সভ্যতার বিমিশ্ররূপ৷ ‘‘গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের আদিম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গাঙ্গেয় উপত্যকায়ও যে আদিম সংস্কৃতির উৎসধারা তারও বিরুদ্ধে আবার ব্রহ্মপুত্র উপতক্যায় যে মৌল মঙ্গোলীয়ান সংস্কৃতি তার বিরুদ্ধে এই তিনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সে একটা ইন্টিগ্রেটেড বেঙ্গলী কালচার গড়ে তুলেছে৷ জগতের সভ্যতার ইতিহাসে এটাই সর্র্বেত্তম বিমিশ্র সভ্যতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ৷ বাঙালীর বৌদ্ধিক বিকাশের ব্যাপারে প্রকৃতির সাহায্য অবারিত৷ এটি তিন তিনটি ব-দ্বীপীয় সভ্যতার বিমিশ্ররূপ৷ তাই বাঙলার সভ্যতা খুবই শক্তিশালী সভ্যতা---বৌদ্ধিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যা খুবই প্রাগ্রসর৷’’ (মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার-বাংলা ও বাঙালী)৷

এই শক্তিশালী সভ্যতার বাহন হচ্ছে বাঙলা ভাষা৷ এই বাঙলা ভাষার উৎপত্তি একদিনে হয়নি৷ বৈদিক ভাষা থেকে সংস্কৃত সেখান থেকে প্রাকৃত ভাষা৷ প্রাকৃত ভাষার মধ্যে মাগধী প্রাকৃত অন্যতম৷ পণ্ডিতদের মতে পূর্ব মাগধী থেকে বাংলা এসেছে (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের মতে পূর্বী অর্ধমাগধী থেকে বাংলা এসেছে ও এই বাংলা ভাষার বারটি উপভাষা)৷ পরে বিভিন্ন মনীষির হাতে পড়ে৷ যেমন ভুসুকপাদ, বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, বৈষ্ণব কবিগণ, কৃত্তিবাস, বিভিন্ন মঙ্গল কাব্যের কবিদের হাত ধরে বয়ে এসে আধুনিক  যুগের স্বর্ণকারদের হাতে হাত পড়ে এলেন৷ এরপর রামমোহন, বিদ্যাসাগর,বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত, রমেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি বহু মনীষির অবদানে বাংলাভাষা বাংলা সাহিত্য এসে পড়েছে৷ মাইকেল মধুসূদনের কন্ঠে ধবনিত হল,

‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন

তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি

পরধন লোভে মত্ত, করিনু প্রমাণ

পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আধার৷

স্বপ্ণে তব কুল লক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে

ওরে বাছা মাতৃকোষে রতনের রাজি

এ ভিখারীদশা তবে কেন তোর আজি?

বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ তার ভাণ্ডারে বিবিধ রতন৷ এই রতনের রাজি পরিত্যাগ করে ভিক্ষাবৃত্তির প্রয়োজন নেই৷ আবার ধবনিত হোল অতুল প্রসাদের কালজয়ী গান৷

‘মোদের গরব মোদের আশা

আ মরি বাংলা ভাষা’

বাংলা ভাষা শুধু সমৃদ্ধ হল তাই নয় তার সৌরভ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল৷ তবে শুধু কী বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সেই সঙ্গে সঙ্গে বাঙালীর ও বাঙলার গুণগাথা দিকে দিকে ঘোষিত হতে থাকলো৷

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে উঠলেন,

‘আমার সোনার বাংলা,

আমি তোমায় ভালবাসি৷’

পরাধীন ভারতে এই বাঙালীর মনে বাংলার কবি লেখকগণ নতুন চেতনাবোধ সৃষ্টি করলো৷ তারা পরাধীনতার শিকল মুক্ত করার জন্য সঞ্জীবনীমন্ত্র পেয়ে গেল,

বন্দে মাতরম্‌

এই মন্ত্র মুখে নিয়ে শত সহস্র বাঙালী বীরবিক্রমে   ঝাঁপিয়ে পড়লো ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে৷ এ সংগ্রাম ব্রিটিশের কবল থেকে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম৷ সমগ্র ভারতবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে সকলকে নিয়েই এই সংগ্রাম৷ সেদিন ব্রিটিশ বাঙালীর জাগরণ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷ ভাবলো এই বাংলা থেকেই একদিন ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনা হয়েছিল আবার বুঝি বাংলা থেকেই ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের সূচনা হবে৷ সুতরাং বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেওয়া চলবে না৷ তাই বাংলা ভাগ করা হল৷ বাঙালী গর্জে উঠল৷ দিকে দিকে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়লো৷ বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করে হিন্দু ও মুসলিমদের পুনর্মিলন করতে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখী বন্ধন উৎসব শুরু করেছিলেন৷ কন্ঠে দিয়েছিলেন আন্দোলনের মূলমন্ত্র

‘বাংলার মাটি, বাংলার জল

বাংলার বায়ু, বাংলার ফল

পুণ্য হউক পুণ্য হউক

পুণ্য হউক হে ভগবান৷’

বাঙালীর জাগরণের ও তীব্র চেতনাবোধ সঞ্জাত আন্দোলনে ব্রিটিশ ভয় পেয়ে বঙ্গ ভঙ্গ করেছিল কিন্তু  বাঙালীর সংগ্রাম শেষ হয়নি৷ ভারত থেকে ব্রিটিশকে তাড়িয়ে দেবার লড়াই চলতে লাগলো৷ সহিংস-অহিংস দুরকমভাবে লড়াই চললো৷ সহিংস সংগ্রামে কত প্রাণ যে বলি হল তার ইয়ত্তা নেই৷ ফাঁসীর বেদীমূলে সেইসব বিপ্লবী বাঙালীরা মনের মণিকোঠায় স্থান লাভ করে বাঙালীকে বাঁচার রসদ জুগিয়ে চলছে৷ অহিংস আন্দোলনে বাঙালীরা অশেষ কারা যন্ত্রণা, নানা ধরণের নির্যাতন সহ্য করে বাঙালীকে গৌরবান্বিত করে চলেছে৷ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, ঋষি অরবিন্দ, রাসবিহারী বসু, মাষ্টারদা সূর্য সেন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এমনি বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী মনীষিগণ বাঙালীকে বিশ্বের ইতিহাসে অমর করেছেন৷

কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে ব্রিটিশ পর্যুদস্ত হয়ে অবশেষে ভারতবাসীদের মধ্যে চিরস্থায়ী অনৈক্যের বীজ বুনে ভারতের স্বাধীনতা দিল৷ ভারত স্বাধীন হল কিন্তু তিন টুকরো হল৷ ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান৷ ধর্মের ভিত্তিতে এই বিভাজনে  পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র হল৷ আবার বাঙালীর দুঃসময় শুরু হল৷ বাংলা ভেঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান হওয়ায় দলে দলে উদ্বাস্তুর স্রোত বাঙালীর জনজীবনকে বিধবস্ত করলো৷ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের ঘাড়ে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হোল৷ এবার বাঙালীদের আর এক সংগ্রামের মুখে ফেলে দিল৷ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা মাতৃভাষা বাঙলার স্বীকৃতির জন্য লড়াই করতে শুরু করলো৷ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বাঙলা ভাষার মর্যাদার জন্য ঢাকার রাজপথে রফিক, সালাম, জববর বরকত, শফীউর প্রমুখ৷ বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন৷ বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেল৷ কিন্তু তাদের লড়াই এখানেই শেষ হয়নি৷ সেই লড়াইয়ের সূত্র ধরেই---১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হয়৷ জাতীয় সঙ্গীত সেই বাঙলাতে, ‘‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি৷’’ ভারত ভূখণ্ডেও বাংলা ভাষাভাষী বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য লড়াই করে চলেছে৷ ১৯৬১ সালে শিলচরে  বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য ১১ জন বাঙালী প্রাণ দেয়৷ কিন্তু ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য ২১শে ফেব্রুয়ারী যে বাঙালীরা প্রাণ বিসর্জন দেয় তা পৃথিবীর ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়৷ ঐদিনের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে বাঙালীরা একটি স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে৷ বাংলাভাষাকে কেন্দ্র করে এতবড় গৌরবজনক অধ্যায় পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই৷

কিন্তু বাঙালীরা কী অতীত গৌরবকে ধরে রাখতে পারবে? এপার বাংলায় ইতিমধ্যে কিছু কিছু এলাকায় উর্দুভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ বিভিন্ন এলাকায় বাংলা উপভাষাকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী মানুষেরা স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা দাবী করছে৷ হিন্দীর পুরো আগ্রাসন শুরু হয়েছে৷ রান্নাঘরে হিন্দীভাষা ঢুকে পড়েছে৷ সিনেমাহলে বাংলা ছবির পরিবর্তে হিন্দী সিনেমা প্রদর্শনে অগ্রাধিকার পাচ্ছে৷ বিজাতীয় সংস্কৃতি বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিকৃত করছে, ধবংস করছে৷ আরো অনেক উদাহরণ আছে৷ ফলে বাঙালীরা আর কতদিন ‘আমরি বাংলা ভাষা’ বলতে পারবে সে ব্যাপারে সন্দেহ জাগছে৷ কিন্তু বাঙালী জনগোষ্ঠী অতীতে জীবিত ছিল, আজও জীবিত আছে, ভবিষ্যতে আরও দুর্দান্তভাবে জীবিত থাকবে৷ সেই জনগোষ্ঠীকে আজ নতুন করে শপথ নিতে হবে কীভাবে নিজেদের অস্তিত্ব সফল করে আরও প্রানবান করে প্রাণোচ্ছ্বোল করে তুলবে৷