মাস ছয়েক আগের কথা ডাক্তার দেখাতে চেপেছিলাম মেট্রো, গন্তব্য যতীন দাস পার্ক৷ দুপুর বেলা প্রায় ফাঁকা স্টেশন, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় দেখি কিছু ছেলেমেয়ে বসে৷ একটা মেয়ের মন্তব্য কানে এলো, পাশের জনকে বলছে,‘‘এই যতীন দাস নাকি খালি হাতে বাঘ মেরেছে৷ বাঘের সাথে কুস্তি করে গাত্রে হলো ব্যথা, হাঃ হাঃ হাঃ ‘‘হাউ ফানি ইয়ার’’৷
চমকে গেলাম শুণে, জবাব দিতে গিয়ে মনে পড়ে গেল দমদমে মেট্রো কাণ্ড৷ আমারও ষাট পেরিয়েছে, অপরিচিত কিশোরীর সাথে তর্ক করলে যদি নেটিজেনরা পারভার্টেড বুড়ো বলে দেগে দেয়৷
অবশ্য ওদেরই বা দোষ কি? ইতিহাস বইতে যে যতীনদের জন্য পুরো একটা পাতাও বরাদ্দ নেই৷ আর তাই আজকের প্রজন্ম যতীন দাশ আর যতীন মুখোপাধ্যায়ের (বাঘাযতীন) মধ্যে ফারাকটাই জানলো না৷ ১৯২৯ সালে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় ধরা পড়েন যতীন দাস৷ লাহোর জেলে ভগত সিং, বটুকেশ্বর দত্ত সহ এদের সবাইকে রাখা হল পেশাদার অপরাধীদের সঙ্গে৷ অবর্ণনীয় সেখানকার পরিবেশ, রান্নাঘরে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে টিকটিকি, আরশোলা, ইঁদুর, সেই সাথে অখাদ্য খাবার৷ কয়েদীদের না আছে কাপড় কাচার সুযোগ না তাদের দেওয়া হয় কোন বই বা পত্রিকা৷ অথচ পাশের ইউরোপীয়ান ওয়ার্ডে ভি.আই.পি ব্যবস্থা৷ এরই প্রতিবাদে যতীন শুরু করলেন অনশন৷ প্রথম দিকে জেল কর্তৃপক্ষ অগ্রাহ্য করলেও পরে পাঠান কয়েদীদের দিয়ে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে৷ ফল হয় আরো মারাত্মক, দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়৷ ভয় পেয়ে জেলার তাঁকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে রাজি হয় কিন্তু বেঁকে বসেন পাঞ্জাবের গভর্নর মোরেন্সী৷ অবশেষে অনশনের ৬৩তম দিনে অর্থাৎ ১৩ই সেপ্ঢেম্বর ১৯২৯ সালে জেলেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷
তাঁর মৃত্যুতে জনমানসে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়৷ পাঞ্জাব বিধানসভা থেকে দুই ভারতীয় সদস্য ইস্তফা দেন৷ মহম্মদ আলি জিন্নাহ সেন্ট্রাল এ্যাসেম্বলিতে সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনেন, এমনকি লণ্ডন ‘হাউস অব কমনস-এ বিরোধীরা সরকারের বিবৃতি দাবী করে৷ সুদূর আয়ারল্যাণ্ড থেকে টেরেন্স এম.সি. সুইনি (আইরিশ বিপ্লবী ৭০ দিন অনশনে থেকে ব্রিক্সটন জেলে প্রাণ দেন) তার পরিবার চিঠি লিখে সমবেদনা জানান৷ নীরব থাকেন শুধু গান্ধীজী৷ নেতাজীর অনেক অনুরোধের পর মন্তব্য করেন, ইটস্ অ্যা কেস অব ডায়বলিক্যাল সুইসাইড৷ আই হ্যাভ্ নাথিং টু সে!
কি নির্মম উক্তি কিন্তু কেন....?
গান্ধীজি অনশই তো রাজনৈতিক জীবনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার, তাহলে যতীন দাসের বেলায় কেন এই রূঢ়তা? দুদিন বাদেই লেবুর রস খেয়ে অনশন ভঙ্গ করেননি বলেই কি? লাহোরের দূর্গাভাবী দেহ নিয়ে হাওড়া পৌঁছুলে নেতাজী তা গ্রহণ করেন৷ মরদেহ নিয়ে অগণিত মানুষের বিশাল শোভাযাত্রা শেষ হয় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে, পঞ্চভূতে লীন হয়ে যায় বাঙলার দধিচীর নশ্বর দেহ৷ অজ্ঞানতা কোনো অপরাধ নয়৷ কোনো মানুষকে সব কিছু জানতে হবে এমন কোনো মানে নেই....আর সেটা সম্ভবও নয়৷ কিন্তু আমার প্রশ্ণ... এসব ঘটনা বর্তমান প্রজন্মের কাছে কি সত্যিই ‘‘ফানি’’? ৬৩ দিনতো অনেক দূরে, আমাদের কারোর কি ৬৩ ঘন্টা উপবাস করবার ক্ষমতা আছে? নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য এমন আত্মবলিদান কি আমরা কেউ দিতে পারবো?
ঘটনা শুণে কে.এম.ডি.এ-তে চাকরি করা আমার এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা তার নিজের কথায় ....‘‘বহু বছর আগে আমার পরিচিত এক এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার-এর সাথে যতীন দাসের জন্মদিনে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে এক শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠানে গেছিলাম (আমার অফিস থেকে প্রতি বছর বাঙলার বিখ্যাত মানুষদের জন্মদিনে বা মৃত্যুদিনে সরকারীভাবে অনুষ্ঠান করা হয়, এটি সেরকমই একটি অনুষ্ঠান ছিল)৷ প্রধান অতিথি ছিলেন আরেক যতীন, মানে যতীন চক্রবর্তী তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী৷ মাইক নিয়ে তিনি সমানে বাঘা যতীনের বীরগাথা বলে চলেছেন৷ এদিকে আমরা উসখুস করছি, কিন্তু কারোরই ভুল ধরিয়ে দেবার সাহস নেই৷ মন্ত্রী বলে কথা আর কেউই রাজরোষে পড়তে চান না৷ শেষে আমার অনুরোধে সেই ইঞ্জিনিয়ার মশাই একটা চিরকুটে ভুলটা বিনয়ের সাথে লিখে মন্ত্রীমশাইয়ের হাতে দিলেন৷ উনি ট্যাঁরা চোখে একবার পড়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘‘বন্ধুগন এই যে বাঘা যতীনের কথা এতক্ষণ বলছিলাম সেরকম হাজার হাজার যতীন আমাদের স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান দিয়েছেন৷ আজ সেই যতীন দাসকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সমবেত হয়েছি যিনি ব্রিটিশ সরকারের জেলে ৬৩ দিন অনশন করে মৃত্যুবরণ করেন৷ এদের কথা আমরা যেন কোনদিনও ভুলে না যাই....’’৷
সুতরাং ওই কলেজ পড়ুয়াগুলোকে শুধু শুধু আত্মবিস্মৃত প্রজন্ম বলে লাভ নেই, গোটা বাঙালী জাতিটাই বোধহয় আত্মবিস্মৃত জাতি৷ যতীন মুখার্জি হোক বা দাস, কেউই এরা লোভের বশবর্তী হয়ে বিপ্লবী হননি৷ কোনো মন্ত্রীত্ব, কোনো পদক বা সম্মানের প্রতি এঁদের বিন্দুমাত্র লোভ ছিল না৷ একমাত্র লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা শুধুমাত্র স্বাধীনতা৷
- Log in to post comments