বিভাজন নয়--- সংযোজন চাই

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

২০০ পার, ৪০০ পারের উচ্চাশা হতাশায় পরিণত হওয়ার পর রাজ্য বিজেপির নেতাদের মস্তিষ্ক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, পরাজয়ের জ্বালায় কল বিগড়াইয়া গেছে৷ অহরহ প্রলাপ বকে চলেছে৷ কেউ উত্তরবঙ্গ, কেউ জঙ্গল মহল পৃথক করিতে চাহে তো কেউ মালদা মুর্শিদাবাদ নিয়ে, কেউ দার্জিলিং নিয়ে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল---বুদ্ধিভ্রষ্ট নেতারা যে যার নিজের মত করে দাদাগিরি দেখানোর সীমানা নির্দ্ধারণ করতে চাইছে৷ বাঙলা ভাগের মহড়া চলছে রাজ্য বিজেপির অন্দরে৷ কে জানে বিভাজনের এই লেখা রাজ্য বিজেপির বিকারগ্রস্ত নেতারা কতদূর নিয়ে যেতে চাইছেন! বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘‘সারমেয় শের স্ব-সীমানায়! রাজ্য বিজেপির নেতারা স্ব-সীমানায় শের হওয়ার খেলা খেলুক৷ এই সুযোগে দেখা যাক বাঙলার নিকট অতীতের ইতিহাস৷

১৮৭২ সালে বিদেশী ব্রিটিশ শাসক যে পূর্ণ বাঙলার মানচিত্র প্রকাশ করেছিল তার আয়তন ছিল ২ লক্ষ ৪৮ হাজার ২৩১ বর্গমাইল (৫ লক্ষ ৩৫ হাজার ৪৭১ বর্গ কিমি)৷ মুঘল আমলে বাঙলা প্রদেশের নাম ছিল সুবা বাঙলা৷ সুবা বাঙলার পশ্চিমে শৌর্য, বীরত্ব ত্যাগের পরিচয় পেয়ে বুঝেছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় বিপদ বাঙলা৷ তাই বাঙলা কে দুর্বল করতে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাঙলাকে বিভক্ত করে দেয়---পূর্ববঙ্গ অসম প্রদেশ ও বঙ্গ প্রদেশ--- যা আজ পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও বিহার ওড়িষ্যার সীমানা সংলগ্ণ অঞ্চল৷ সারা বাঙলা জুড়ে সেদিন বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল৷ ইতিহাসে যা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন নামে খ্যাত৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সেই আন্দোলনের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়৷ কিন্তু চতুর ব্রিটিশ বাঙলার পূর্বে পশ্চিমে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়৷ সেই সময় কংগ্রেস নেতৃত্ব কথা দিয়েছিল ভারত স্বাধীন হলে বাঙলার অংশ বাঙলাকে ফেরত দেওয়া হবে৷ কিন্তু ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ ও বুদ্ধিভ্রষ্ট ক্ষমতালোভী নেতৃত্বের ষড়যন্ত্রে দেশ ভাগ হয়ে পূর্বে পশ্চিমে বাঙলা ও পঞ্জাবের অংশ নিতে তৈরী হয় পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান৷ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ উর্দু সাম্রাজ্যবাদের শোষণ থেকে বাঁচতে বাঙলার ভাষা-কৃষ্টি সংস্কৃতি বাঁচাতে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে নেয়৷

কিন্তু চতুর ব্রিটিশের থেকেও ধূর্ত স্বদেশী সাম্রাজ্যবাদী শাসক ভারতে বাঙলার অংশ বাঙলাকে ফেরত দেয়নি৷ বাঙলার খনিজ বনজ কৃষিজ সম্পদে সমৃদ্ধশালী পশ্চিম রাঢ় আজও বিহার ওড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে যুক্ত৷ আজও আবার পশ্চিমবঙ্গের বুকেও ছুরিকাঘাত করতে উদ্যত দিল্লীর শাসকের প্রত্যক্ষ মদতে বঙ্গীয় বিশ্বাস ঘাতকেরা৷ বাঙলা ভাগের চিৎকার যারা করছে তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি৷ তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে কোথাও বাঙলা ভাগের কথা ছিল না৷ তবে ২০০ পারের ডাক দিয়ে বাঙলার মস্‌নদ দখলের স্বপ্ণে বিভোর ছিল৷ কিন্তু নির্র্বচনে ২০০ পার তো দূরে কথা ১০০ ছুঁতেও পারেনি৷ একরাশ হতাশা নিয়ে তিন বছর পার করে লোকসভায় ঝাঁপিয়ে ছিল ৪২-এ ৩৫-এর আশা নিয়ে৷ সারা ভারতে ৪০০ পারের হুঙ্কার দিয়ে ছিল কেন্দ্রীয় নেতারা৷ নির্বাচনের পর চরম হতাশায় আক্রান্ত নেতৃত্ব হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে৷ একক গরিষ্ঠতা হারিয়ে শরিক দলের কাঁধে ভর করে কোনরকমে সরকার বাঁচালেও প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে দেশের শাসক দল যা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে মোটেই শুভ নয়৷ লোকসভায় বিজেপির ভরাডুবির অন্যতম কাণ্ডারী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী৷ তারই প্রতিশোধ নিতে নিকৃষ্ট রাজনীতি শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বাঙলাকে টুকরো টুকরো করার খেলায় নেমে৷

তবে বাঙলা ভাগের আশঙ্কার কালো মেঘ দেখা দিলেও অগ্ণিযুগের বাঙলা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি৷ বলা ভালো বিকৃত বিকারগ্রস্ত রাজনীতি, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মমত, অশ্লীল অসংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব বাঙলার ছাত্র-যুব সমাজকে বিভ্রান্ত বিপথগামী করলেও অগ্ণিযুগের ছাইচাপা আগুন এখনও ধিকিধিকি করে জ্বলছে সংখ্যায় অল্প হলেও কিছু সংখ্যক ছাত্র-যুব-তরুণের বুকে৷ চোখের সামনে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বাঙলাদেশ৷ বিশ্বাসঘাতকদের বাঙলাভাগের চিৎকারে ছাই উড়ে গিয়ে অগ্ণিযুগের আগুন একবার জ্বলে উঠলে বাঙলার ভৌগোলিক সীমানায় বিভাজনের নয়, সংযোজনের নূতন মানচিত্র তৈরী হবে৷