তাকেই Learned বা বিদ্বান বলব যে প্রচুর পড়াশোনা করেছে, যা পড়েছে তা ৰুঝেছে, সেটা মনে রেখেছে, ও সেগুলিকে কার্যেও রূপায়িত করেছে৷ কোনো শিক্ষিত (Educated) ও বিদ্বান মানুষের পুঁথিগত বিদ্যা থাকতে পারে বা নাও পারে, তেমনি প্রথাগত ভাবে বিদ্যার্জনকারী কোনো একজন মানুষ প্রকৃত শিক্ষিত হতেও পারে আবার নাও পারে৷ তাহলে সত্যিকারের বিদ্বান ও শিক্ষিত তাকেই বলব যার মধ্যে নিম্নোক্ত চারটি তত্ত্ব থাকতেই হবে, এদের মধ্যে একটিরও অভাব থাকলে তাকে বিদ্বান বলা যাবে না ঃ–
১৷ একটি দু’টি নয়, বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অনেক বই যত্নের সঙ্গে পড়তে হবে৷ অল্প পড়াশোনা করে বিদ্বান হওয়া যায় না৷
২৷ শুধু পড়লে হবে না, ৰুঝে পড়তে হবে৷ অর্থাৎ যা পড়লুম তা হূদয়াঙ্গম করতে হবে, অধিগত করতে হবে৷
৩৷ যা পড়লুম, ৰুঝলুম তা মনে রাখতে পারলুম না–এরকম হলেও চলবে না৷ মনে রাখতে না পারলে বিদ্যালাভের কোনো অর্থই হয় না৷ যে অনেকদিন আগে ত্ত.ত্রন্তু. পাস করেছে তাকে এখন Matriculation পরীক্ষায় বসতে বললে সে নির্ঘাৎ অকৃতকার্য হবে কেননা সে বেশীরভাগটাই ভুলে গেছে৷
৪৷ পড়া, হূদয়াঙ্গম করা ও মনে রাখা–এই তিনটি একসঙ্গে চলতে হবে৷ তার সঙ্গে সেগুলিকে কাজেও লাগাতে হবে৷ কেউ একজন খেটে খুটে আইন পাশ করল আর তাকে যদি করণিকের কাজ করতে হচ্ছে তা হলে তাকে আইন–শিক্ষিত বলব না বড় জোর আইন সংক্রান্ত সাধারণ কাজে নিযুক্ত আছে–এটুকুই বলব৷ একজন পাস করা Advocate অথচ সেই বৃত্তিতে সে নিয়োজিত নয়, তার মানে অল্পদিনে সে সব আইন ভুলে যাবে৷ তাহলে তাকে আর আইন–বিষয়ক বিদ্বান কী করে বলব?
আমরা যাকে পড়া (Reading) বলি তা তিন ভাবে করা যায়৷ প্রথমতঃ চোখের সাহায্যে পড়া, দ্বিতীয় হচ্ছে শুণে পড়া৷ অতীতে মুনি–ঋষিরা অক্ষর–জ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন না কিন্তু তারা শুণে শুণে (শ্রুতি) অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হতেন৷ তোমরা এখনও অনেক মানুষ পাবে যারা লিখতে পড়তে জানে না কিন্তু রামায়ণ–মহাভারত তাদের কণ্ঠস্থ৷ তৃতীয় উপায় হচ্ছে মুদ্রা বা অন্য অঙ্গের ব্যবহার করে পড়া৷ একজন অন্ধ স্পর্শের মাধ্যমে কোনো কিছু সম্পর্কে জানতে পারে৷ একে বলে স্পর্শজনিত পদ্ধতি (Tactual method)৷ কেউ একজন তোমার থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে, তুমি যদি তাকে কিছু বলতে চাও বা কাছে ডাকতে চাও তাহলে কথা না বলেও তুমি মুদ্রার সাহায্যে তা করতে পার৷ শ্রবণশক্তিবিহীন ও বাকশক্তিহীন মানুষেরা এই মুদ্রারই সহায়তায় নিজেদেরকে অভিব্যক্ত করে৷ একজন মানুষের কোনো একটি ইন্দ্রিয় (sense organ) যদি অক্ষম থাকে তাহলে অন্য ইন্দ্রিয়গুলি অধিক সংবেদনশীল হয়ে উঠে৷ উদাহরণস্বরূপ মানুষের পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় আছে৷ ধরা যাক্, তাদের শক্তি হচ্ছে ২০ ডিগ্রী করে৷ যদি এদের মধ্যে একটি কার্যকর না থাকে তা হলে সেই জ্ঞানেন্দ্রিয়ের শক্তি অন্যগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়৷ অর্থাৎ বাকী ইন্দ্রিয়গুলির শক্তি বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ ডিগ্রী৷ বধির মানুষ চোখের ভাষা আর মুখের অভিব্যক্তির ব্যবহার করে অনেক কিছু জানাতে পারে তেমনি অন্ধ সাহায্য নেয় শ্রবণ, ঘ্রাণ ও স্পর্শানুভূতির৷
মুদ্রার মাধ্যমেই ললিতকলার অভিপ্রকাশ৷ ললিত কলার উদ্ভাবক ভগবান সদাশিব৷ মনের ভাবের বাহ্যিক ব্যক্তিরণই মুদ্রা অর্থাৎ মুদ্রা হচ্ছে মনের অভীপ্সাকে বাইরে ফুটিয়ে তোলা৷
‘‘সৎসঙ্গেন ভবেন্মুক্তি অসৎসঙ্গেষু ৰন্ধনম্৷
অসৎসঙ্গ মুদ্রণং যৎ সা মুদ্রা পরিকীর্ত্তিতাঃ৷৷’’
সৎসঙ্গ মানুষের জীবনে মুক্তির দিশারী আর অসৎসঙ্গের অর্থই হ’ল অধিকতর ৰন্ধনে জড়িয়ে পড়া৷ দুষ্ট লোকের সঙ্গ পরিহার করাই মুদ্রা নামে অভিহিত৷ৰ
মুদ্রা অর্থাৎ দেহভঙ্গি বা অঙ্গ বিন্যাসের দ্বারা কোনো একটি আইডিয়াকে সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করা যায়৷ প্রাচ্যনৃত্য মুদ্রা প্রধান আর পাশ্চাত্যনৃত্য ছন্দ প্রধান৷ ভারতের লোকনৃত্য ও ক্লাসিক্যাল নৃত্য সব মুদ্রা ভিত্তিক৷ মুদ্রা ছন্দের থেকে সূক্ষ্মতর৷
সঙ্গীত কাকে বলব? নৃত্য–বাদ্য–গীত এই তিনে মিলে সঙ্গীত৷ যেখানে শুধুমাত্র কণ্ঠ ও বাদ্যের ব্যবহার তাকে বলব গীত৷ মহাভারতের যুগে কৃষ্ণ যা বলেছিলেন বা উপদেশ দিয়েছিলেন তাকে বলা হয় গীতা কেননা তাতে কোনো নৃত্য সংযুক্ত ছিল না৷ কৃষ্ণ যদি নৃত্য সহযোগে ধর্মের বিশেষত্ব ব্যাখ্যা করতেন তবে তাকে গীতা না বলে সংগীতই বলা হত৷
‘‘যা ভগবতা গীতা সা গীতা’’–স্বয়ং ভগবান কর্তৃক যা গীত তাই গীতা৷
প্রাথমিক ভাবে ছয়টি রাগ ও ৩৬টি রাগিণী আছে৷ ভারতে প্রধান দু’টি রীতির নৃত্য প্রচলিত–আর্যাবর্ত্ত নৃত্য (কেউ কেউ বলেন উত্তর ভারতীয় নৃত্য) আর কর্ণাটকী নৃত্য (দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্য)৷ এই দু’টি নৃত্য রীতিই সদাশিবের প্রবর্ত্তিত৷ কিন্তু জনসমক্ষে এদের নিয়ে আসার কৃতিত্ব মহর্ষি ভরতের৷
বেদে আছে ছন্দ প্রধানতা কেননা বেদের প্রথম দিকের বেশীরভাগ অংশ লেখা হয়েছিল বহির্ভারতে৷ তাই বেদের উদগাতা ঋষিরা ছন্দের বাইরে যেতে পারেননি৷ যদিও বেদের সময় ব্যাকরণের অতটা কড়াকড়ি ছিল না৷ তাই বেদে অনেক ব্যাকরণগত ত্রুটিও আছে৷
তন্ত্রে কিন্তু মুদ্রা প্রধানতা৷ সেখানে ছন্দ্র মুদ্রার দ্বারা পরিশীলিত৷ অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেদেও মুদ্রার ব্যবহার আছে৷ যেমন শ্রাদ্ধ, যেখানে আছে পিণ্ডদান মুদ্রা বা অঙ্কুশ মুদ্রা৷ পিতৃযজ্ঞে ঙ্মপ্রাত্যহিক স্নানের পরে ভেজা শরীরে সূর্য বা জ্যোতিষ্মান বস্তুর দিকে তাকিয়ে স্নানমন্ত্র সহযোগে করতে হয়ৰ আছে নমঃ মুদ্রা, তেমনি আছে অভয় মুদ্রা, বরদা মুদ্রা৷ আসলে বেদের যে অংশ ভারতবর্ষে রচিত হয়েছিল তাতেই মুদ্রার ব্যবহার সন্নিবেশিত হয়েছিল৷
বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও মুদ্রা ভিত্তিক৷ পাশ্চাত্য দেশে কেবলমাত্র বেহালা (violine) বাদ্যযন্ত্রটি মুদ্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট৷ লোকনৃত্যের মধ্যে মণিপুরী নৃত্য, ছো–নৃত্য ও রামবাঁশ নৃত্যগুলিতে মুদ্রার ব্যবহার বেশী৷ রামবাঁশ নৃত্য মূলতঃ যুদ্ধের নৃত্য বলে এতে মুদ্রার ব্যবহার একটু কম৷ কিন্তু ছো–নৃত্য যা সৈন্যশিবিরে যুদ্ধের সাময়িক বিরতিতে অনুষ্ঠিত হত তাতে আবার মুদ্রার প্রয়োগ বেশী৷ এই নৃত্যে অংশগ্রহণকারী নিজে কোনো গান করে না৷ কিন্তু অন্য একজন গীতের মাধ্যমে নৃত্যের বিষয়বস্তু বর্ণনা করে (অন্য কয়েকজন বাদ্যবাদনে নিযুক্ত থাকে)৷
সদাশিব প্রবর্ত্তিত তাণ্ডব নৃত্য ছন্দ–প্রধান আর পার্বতী প্রবর্ত্তিত ললিত নৃত্য মুদ্রালাস্যে ও মধুরতায় সংক্লিপ্ত৷ তাণ্ডবের ‘তা’ ও ললিতের ‘ল’–এই নিয়ে ‘তাল’ শব্দের উৎপত্তি৷ এই দুই প্রকার নৃত্যের ভাবধারা ও প্রকরণের সুন্দর সমন্বয়ই হচ্ছে তাল৷ তাই ‘তাল’ এত জনপ্রিয় হতে পেরেছে৷* ১৫ জুন ১৯৭০, রাঁচী