বিদ্যার্থী ও বিদ্যা সাধনা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

পূর্ব প্রকাশিতের পর

মনের বিকাশ বলতে একদিকে যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সঙ্গীত, সাহিত্য-কলা এসব বিষয়ে মনের ব্যাপ্তি ঘটাতে হবে, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক ও আত্মিক বিকাশও অত্যন্ত জরুরী৷ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে মানুষ নোতুন নোতুন অনেক কিছু আবিস্কার করে৷ কিন্তু আবার মানুষের মনে যদি শুভ ভাবনা না থাকে, নৈতিক মান যদি উন্নত না হয়, তাহলে সেই নোতুন নোতুন আবিষ্কার মানুষের হিতসাধন না করে অহিত করবে, মানব সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে৷ তা’ মানুষের কাছে কখনই কাম্য হতে পারে না৷ অনেক জ্ঞানের অধিকারী হয়েও মানুষ যদি পশুর পর্যায় নেমে গেলো, তাই তাকে যথার্থ মানসিক বিকাশ বলা চলে না৷

প্রকৃত পক্ষে মানুষের মনের ক্ষুধার শেষ নেই৷ সব সময় মন বলছে---চাই চাই৷ মানুষ ১০০ টাকা পেলে ২০০ টাকা চায়, ২০০ টাকা পেলে ৪০০ চায়৷ ১লাখ টাকা পেলে ২ লক্ষ টাকা চায় ৷ এককোটি পেলে দুকোটি চায়৷ এমনি করে মানুষের চাওয়ার শেষ নেই৷ এই নিয়ে মানুষের মনে দ্বন্দ্ব, মানুষের নিজের মনে ও সমাজে অশান্তি দেখা যায়, লড়াই বাধে, রক্তের স্রোত বয়৷

 তাই প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘আজকের সমস্যা’ পুস্তকে বলেছেন, ‘‘মানুষের ক্ষুধা অনন্ত৷ এই ক্ষুধাকে সে যদি জাগতিক ভোগ্য বস্তুর দিকে ছুটিয়ে দেয়, তাহলে মানুষে মানুষে সংঘর্ষ বাধবেই৷ কারণ জাগতিক সম্পদ সীমিত৷ একজনের প্রাচুর্য ঘটলে অন্যের অভাব দেখা দেবে৷ মানুষের এই ক্ষুধা মানস তথা অধ্যাত্ম সম্পদেই মেটাতেই হবে৷ ব্রহ্ম অকৃপণভাবে অনন্ত মানস তথা অধ্যাত্ম সম্পদ মানুষের সামনে সাজিয়ে রেখেছেন৷ মানুষকে সেই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে হবে৷  আর এই যে মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ অর্জনের জন্যে প্রয়াস করা এটাই মানুষের জীবনকে যথার্থ সমৃদ্ধ করে৷ তার মনুষত্বের বিকাশ ঘটায়৷

তাছাড়া যে কোন অভাব মিটলে মানুষ পায় সুখ৷ আমি যদি মিষ্টান্ন খেতে ভালবাসি , মিষ্টান্ন পেলে আমি সুখী হই৷ কিন্তু এই সুখ সীমিত ও ক্ষণিক৷ মন যা ভোগ করে বা ভোগ করতে চায়, তা স্থূল হোক বা সূক্ষ্ম হোক, তাকে বলা হয় আভোগ৷ সূক্ষ্ম বলতে কী বোঝায়? যেমন জ্ঞান, এও মানুষের মনের ক্ষুধা মেটায়৷ যাইহোক, সীমিত আভোগ মানুষকে সীমিত সুখ দেয়৷ প্রতিটি মানুষ চায় অনন্ত সুখ৷ মানুষ অনন্ত সুখ পেতে পারে অনন্ত আভোগ থেকে৷ এমন কী আভোগ রয়েছে যা অনন্ত? একমাত্র আধ্যাত্মিক আভোগ ব্রহ্মই হচ্ছে অনন্ত৷ উপনিষদে বলা হয়েছে, আনন্দং ব্রহ্ম ইত্যাহুঃ৷ কবিগুরু বলেছেন, ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’৷ ‘আনন্দসূত্রমে’ জগৎগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন,‘সুখমনন্তমানন্দম্’, আনন্দম্ ব্রহ্ম ইত্যাহু, (২/৩,২/৪)---অর্থাৎ মানুষ চায় অনন্ত সুখ, আর এই অনন্ত সুখকে বলা হয় আনন্দ৷ যা একমাত্র ব্রহ্ম সম্প্রাপ্তির মাধ্যমেই মানুষ পায়৷ তাই প্রতিটি মানুষই যখন আনন্দ পেতে চায়, তাঁর অর্থ প্রকৃতপক্ষে তাঁর অন্তর অনন্ত পরমব্রহ্মকেই চায়৷ তাই ব্রহ্ম সাধনা প্রতিটি মানুষের করণীয়৷ একেই বলে আধ্যাত্মিক সাধনা৷ তাছাড়া, আধ্যাত্মিক সাধনা মনকে শুভপথে পরিচালিত করে৷ আধ্যাত্মিক সাধনা মানুষের নৈতিকতার ভিতকে সুদৃঢ় করে৷ আধ্যাত্মিকতা ছাড়া নৈতিকতাতেও দৃঢ়তা আসে না৷ আধ্যাত্মিক ভিত ছাড়া নৈতিকতা যেকোনো সময়ে বড় কোন প্রলোভনের কাছে হার মেনে যায়৷ এই কারণে প্রতিটি মানুষের জীবনে জাগতিক জ্ঞান সাধনার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনেও বিশেষভাবে যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন৷ প্রকৃত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা ছাড়া মানুষের জীবনকে তথা সমাজকে কলুষতা থেকে মুক্ত রাখার আর কোন উপায় নেই৷

বর্তমানে আমাদের সুকল-কলেজের সিলেবাসে ‘যোগ’-কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ যোগসাধনা মানুষের জীবনে একান্ত প্রয়োজন ,অন্ন-বস্ত্রের মতোই জরুরী৷ হ্যাঁ, শিক্ষাও তো নূ্যনতম চাহিদার অন্তর্ভুক্ত৷ তাই যোগশিক্ষাও শিক্ষার অচ্ছেদ্য ও অতিপ্রয়োজনীয় অঙ্গ৷ এর কারণ মানুষের শরীর মন ও আত্মা এই তিনের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশের জন্যে যোগ অপরিহার্য৷ যোগ মুখ্যতঃ বৈবহারিক৷ খেলাধূলায় যেমন, কেবল খেলাধূলা ব্যাপারে বই পড়লে চলে না, খেলাধূলা করতে হয়--- তেমনি যোগাভ্যাস নিয়মিত অনুশীলন করতে হয়৷ তবেই শিক্ষাপূর্ণ হয়৷ এক্ষেত্রে এটা মনে রাখা দরকার, যোগ মানে সাধারণতঃ কিছু আসন বা প্রাণায়াম নয়৷ শরীর সুস্থ রাখার জন্যে আসনের প্রয়োজন৷ আর ধ্যানাভ্যাস না করে ঠিকভাবে আধ্যাত্মিক ভাবগ্রহণ ব্যতিরেকে প্রাণায়ামও ক্ষতিকর৷ প্রকৃতপক্ষে যোগ হল অষ্টাঙ্গিক যার আটটা অঙ্গ৷ এই আটটি অঙ্গ হ’ল---যম,নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম,প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি৷ যম নিয়মের মধ্যে নীতিশিক্ষা ও তৎসহ ঈশ্বর প্রণিধান রয়েছে৷ এটা যোগের গোড়া৷ যম নিয়ম বাদ দিয়ে আসন প্রাণায়াম করা মানে, গাছের গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া৷ গাছের শাখায় ফুল ফল হয় দেখে কেউ যদি গাছের শাখায় জল দেয় আর মূলে জল না দেয়, সে যেমন নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়---যারা আধ্যাত্মিক বা ধ্যানকে বাদ দিয়ে আসন, প্রাণায়াম শেখায়ে বা অভ্যাস করে তারাও সেইরূপ নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়৷

বিদ্যাশিক্ষার আরেকটা বড় কথা হল, যা আগেই কিছুটা বলেছি, মনকে প্রসারিত করা৷ একজন কেবল নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করছে বা তার নিজের পরিবারের ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের স্বার্থ চিন্তা করছে, সমাজের অন্যের কথা ভাবছে না, এটা মনুষ্যত্বের পরিচয় নয়৷ পশু তো নিজের সুখের কথা চিন্তা করে, বহু ক্ষেত্রে নিজের সন্তানের জন্যেও ভাবে৷ মানুষকে তো আর পশুর মত হয়ে থাকলে চলবে না! তাহলে মানুষের সমাজ ধবংস হয়ে যাবে৷ সবাইকে সাথে নিয়ে চলার নাম সমাজ--- সমানম এযতে ইতি৷ ‘এজ’ মানে চলা, তাই এখানে আত্মসুখকে প্রাধান্য দিলে চলবে না, সম-সমাজতত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে৷ অর্থাৎ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে, সাময়িক স্বার্থের কথা চিন্তা করতে হবে৷ শুধু এখানেই থেমে থাকলে চলবে না---মানুষ যদি কেবল মানুষের কথাই ভাবল, অন্যান্য পশুপক্ষী তরুলতার কথা ভাবল না, তাহলে তাও স্বার্থপরতা হয়ে যাবে৷ মনে রাখতে হবে মানুষ সৃষ্টির মুকুটমণি৷ প্রকৃতি তাঁকে উন্নত বুদ্ধি দিয়েছে, মানুষের উচিত অন্যান্য সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতকে রক্ষা করা৷ মানুষ, পশুপক্ষী, তরুলতা সবাইকে নিয়ে এই বিশ্ব পরিবার এই পরিবারের পিতা পরমপুরুষ- ঈশ্বর৷ মানুষ যদি পরিবেশের কথা না ভাবে, অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতকে রক্ষার কথা না ভাবে, তাহলে গোটা পৃথিবীটাই আর মানুষেরও বসবাসযোগ্য থাকবে না৷ এব্যাপারে বৈজ্ঞানিকরাও বারে বারে আমাদের সচেতন করছেন৷

তাই মানুষকে অন্যান্য সমস্ত মানুষ, পশুপক্ষী, তরুলতা সবার জন্যে ভাবতে হবে৷ সবাইকে ভালবাসতে হবে৷ মানবতার মাধুর্যকে এইভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে--- একেই বলে নব্যমানবতাবাদ৷ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন , ‘‘নব্যমানবতাবাদই শেষ আশ্রয়’’৷ একমাত্র নব্যমানবতাবাদই আজকের উন্মার্গগামী মানবসমাজকে বাঁচাতে পারে,মানুষের হৃতসমস্ত মূল্যবোধকে ফিরিয়ে দিতে পারে৷ তাই একমাত্র নব্যমানবতাবাদী শিক্ষাই প্রকৃত বিদ্যাসাধনা ও প্রতিটি বিদ্যার্থীকে এই বিদ্যা সাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করতে হবে৷ তবেই বিদ্যার্থীর বিদ্যাসাধনা সার্থক হবে৷