বিজন সেতুর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে

লেখক
আচার্য ত্র্যম্বকেশ্বরানন্দ অবধূত

পূর্ব প্রকাশিতের পর

এই ধরণের স্বৈরাচারী আক্রমণের সম্মুখীন যে শুধু আনন্দমার্গ হ’ল তাই নয়, যারাই এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে সক্রিয়ভাবে কিছু করতে সচেষ্ট হয়েছিল, তাদের ওপরেই নেমে এসেছিল ওই আক্রমণ৷ কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা এই ঘটনায় মর্মাহত হয়েছিলেন৷ তারা উপলব্ধি করেছিলেন ৩০ এপ্রিলের ওই বীভৎস ঘটনা তাঁদের রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের অধিকার কেড়ে নিয়েছে৷ তাই তাঁরা সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন---‘‘এবারের ২৫শে বৈশাখ হোক অনুশোচনার ও প্রায়শ্চিত্তের ২৫শে বৈশাখ৷’’

‘‘ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতার সাহিত্যিক শিল্পী ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা যখন ২৫ শে বৈশাখের সকালে দেশপ্রিয় পার্ক থেকে একটা শোক মিছিল বার করতে গেলেন, তখন তাদের কাছ থেকে মাইক কেড়ে নেওয়া হ’ল৷ মাইক কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে  তাঁরা গেয়ে উঠলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত --- সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত---  যাতে বেজেছে অগ্ণিবীণা, যাতে ধবনিত হয়েছে বিদ্রোহের  ও  বিপ্লবের সুর৷ পুলিশ তেড়ে এলো--- রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধ না করলে শোকমিছিল ভেঙ্গে দেওয়ার হুমকি দিল৷ এরপর ১৪৪ ধারার অজুহাতে বিজনসেতুর ওপর অর্র্থৎ ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়া হল না ও ১৪৪ ধারার বাইরে বিজন সেতুর পাদদেশে (বালিগঞ্জের দিকে)  সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে কিছু বলারও অনুমতি দেওয়া হ’ল না৷ এখানেই শেষ নয়, জনগনের উপর বুদ্ধিজীবিদের এই শোকপালনের প্রভাবকে খর্ব করার হীন উদ্দেশ্যে প্রমোদ দাসগুপ্তের প্রলাপ---‘‘আমাদের দুঃখ ও ক্ষোভ হয় যখন দেখি আনন্দমার্গীদের জন্যে  বুদ্ধিজীবিদের শোক উথলে উঠছে৷’’ এর দ্বারা আবার  প্রমাণিত হ’ল যে সিপিএম পার্টি এই হত্যাকাণ্ড এত দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছে  নিহতদের প্রতি শোক জ্ঞাপন কারীদের প্রতি তারা ক্ষুদ্ধ না হয়ে পারেন না৷

* ৩০শে এপ্রিলের আগের কার্যাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই ঘটনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে সিপিএম৷

* ঘটনার দিনের সমস্ত দিক বিবেচেনা করলে দেখা যায় যে স্থানীয় থানা থেকে লাল বাজার পর্যন্ত সমস্ত পুলিশ প্রশাসনকে ও সমগ্র মন্ত্রী পরিষদকে পক্ষাঘাত গ্রস্ত করে এই কাণ্ড ঘটানো  একমাত্র সিপিএমের পক্ষেই সম্ভব৷

৩০শে এপ্রিলের পরবর্তী ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে যারাই এই ঘটনার নিন্দা করতে সচেষ্ট হয়েছে তাদেরই ওপর সিপিএম তার পার্টিকে ও  পুলিশ বাহিনীকে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছে৷

হত্যাকারী যে সিপি এম  এ বিষয়ে এরপরও কি কোনো সন্দেহ থাকতে পারে?

এই হত্যাকাণ্ডে সিপিএম তৃপ্ত নয়, আরো হত্যাকাণ্ডের চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে৷ এবারেও সেই একই পদ্ধতি আর বড় আকারে৷ এবারেও প্রথমে গুজব  তৈরীর ক্ষেত্র  প্রস্তুতির  জন্যে গত ৩রা জুলাই  ঐ কসবা -তিলজলার  চিত্তরঞ্জন  হাই-স্কুলে একটা মিটিং  হয়ে গেছে৷ উদ্যোক্তা ছিলেন  সি.পি.এম পার্টির নেতৃবৃন্দ  আর প্রধান বক্তা ছিলেন সি.পি এম   পার্টির রাজ্য কমিটির অন্যতম সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ ওরা বুঝেছে যে ছেলেধরার গুজব আর ধোপে টিকবে না, তাই  এবারে আমদানি হয়েছে নোতুন গুজব---‘‘আনন্দমার্গ দেশের শত্রু, আনন্দমার্গ বিদেশের চর৷’’ এই মিটিংয়ের বেশ কিছুদিন আগে ‘‘আনন্দমার্গ ভারত বিদ্বেষী’’ এই বিবৃতি দিয়ে গুজবটির  উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন, প্রমোদ দাশগুপ্ত৷

ভারত বিদ্বেষের এই যে অভিযোগ উঠেছে আনন্দমার্গের প্রতি, দেখাই যাক এই গুজবের সত্যতা কতটুকু৷

* আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী৷  তাঁর লৌলিক নাম শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার৷ ইনি বাংলার সন্তান৷ ইনি ভারতবাসী৷

*ভারতের হাজার হাজার বছরের সভ্যতা, সংসৃকতি ও আধ্যাত্মিকতার  যে ঐতিহ্য, সেই ঐতিহ্যকে স্বীকার করে, তার মধ্যের কুসংস্কারের আবর্জনাকে নির্মমভাবে দূরে সরিয়ে দিয়ে, যুক্তি ও বিজ্ঞানের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে আনন্দমার্গের দর্শন৷ অর্র্থৎ আনন্দমার্গের দর্শন, ভারতীয় দর্শন৷

*১৯৩৯ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমায় কলকাতার কাশীমিত্র ঘাটে  আনন্দমূর্ত্তিজী প্রথম দীক্ষা দেন৷ অর্র্থৎ কাজ শুরু হয়েছে কলকাতা থেকে, বীজবপন হয়েছে ভারতে৷

* আনন্দমার্গ আজ  কোলকাতা ছাড়িয়ে, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে, ভারত ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে৷  আনন্দমার্গ আজ বিশ্বসংঘটন৷ ১৮২টি দেশে আনন্দমার্গের কাজ চলছে৷ যারা এই আদর্শ সংঘটনকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে তারা সবাই ভারতের সন্ন্যাসী৷  ---তাহলে আনন্দমার্গ কোন যুক্তিতে ভারত বিদ্বেষী?

এবার অভিযোগকারী সিপিএমের দিকে তাকান৷

* ওদের আদর্শ মার্কসইজিম ভারতের মাটিতে জন্ম নেয়নি৷

* আদর্শের প্রবক্তা কার্লমার্কস যে ভারতের লোক ছিলেন না শুধু তাই নয় তাঁর দর্শনে তিনি ভারতের ইতিহাসকে মর্যাদা দেননি৷

* লেলিন, স্ট্যালিন, মাওসেতুং, হোচিমিন ওদের নেতা৷ কেউ ভারতবাসী নয়৷

এই সমস্ত কারণে কি ওদের ভারত বিদ্বেষী বলবেন, নাকি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস History of freedom movement of india) গ্রন্থে কম্যুনিষ্টদের যে কীর্তিকাহিনী ফাঁস করে দিয়েছেন, সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে ওদের ‘ভারতপ্রেমী’ বলে সম্বোধন করবেন?

  ‘*During the period of 1930-33 when the civil disobedience movement swept the country and the nationalist movement reached the highest peak the C.P.I. instead of joining the fight for freedom, did it best to weaken and sabotage the greatest mass movement “History of freedom movement of India Vol--III Page no.689.)

অর্থাৎ ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ এই সময়টাই  অসহযোগ আন্দোলনে সমগ্র ভারত যখন উত্তাল হয়ে উঠেছিল তখন কম্যুনিষ্টরা (তখন একটাই কম্যুনিষ্ট পার্টি ছিল সিপি আই) সেই আন্দোলনে যোগ দেওয়া তো দূরের কথা সেই আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রকার অপচেষ্টায় রত ছিল ও সেই মহান গণআন্দোলনের সমূহ ক্ষতি করেছিল৷

* The conferences of the communist  students in December, that year (1940) led by Sri Hiren Mukherjee and K.M. Asharaf passed a resolution  declaring that  the future India should be  a voluntary federation of regional states based on mutual confidence. This resolution was a clear bid to enlist the support of the Muslims be conceding the claim of Pakistan. (page 687)

 অর্র্থৎ ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে হীরেণ মুখার্জী ও কে.এম.আশরফের নেতৃত্বে  কম্যুনিষ্ট ছাত্রদের এক সভায় ভারতকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল৷  অর্র্থৎ ভারত ভাগের যে ধূয়ো তুলেছিল মুসলিম লীগ, ভারতপ্রেমী (?) কম্যুনিষ্টরা  তা সমর্থন করেছিল৷

“During the great national  upsurge of 1942 the comminists acted as stooges and spies of the British  Goverment” (page 689)

অর্র্থৎ ১৯৪২ সালের জাতীয় অভ্যুত্থানের  মহান দিনগুলিতে কম্যুনিষ্টরা ব্রিটিশের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছিল৷  ছিল৷

* “ The communist were puzzled by Stalin-Hitler pact  in August 1939. But they had to obey  instruction from Moscow. Hitler ceased to be a Fascist menace, and became a friend of peace, while England and France were the imperialist war-mongers. But  as soon  as Germany  invaded Russia on 2nd June. 1941, all these were changed as If by the wand of magician. Joshi had as General Secretary of the party, written a letter in which he offered unconditional help to  the then  Govt. of India and the army G.H.Q to fight the 1942 underground workers and the Azad Hind Fouz... These men were characterized as “traitors” and  “fifth  communist”. Joshi’s  letter  also revealed that  the C.P.I was  receiving financial  aid from the Government” (page 689-690).

 

অর্র্থৎ ১৯৩৯ সালের ষ্টালিন-হিটলার চুক্তিতে কম্যুনিষ্টরা  স্তম্ভিত হলেও রাশিয়ার নির্দেশে ফ্যাসিষ্ট হিটলার তাদের কাছে হয়ে উঠলো শান্তির দূত এবং ইংরেজ ও ফ্রান্স যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী৷ কিন্তু ১৯৪১-এর ২রা জুন হিটলার যখন রাশিয়া আক্রমণ  করে বসলো  তখন কম্যুনিষ্ট  যাদুদণ্ডের  ভেল্কিতে ‘যুদ্ধবাজ ইংরেজরা হয়ে গেল বন্ধু ও  শান্তির দূত’  হিটলার হয়ে গেল আবার ফ্যাসিস্ট হিটলার তৎকালীন ভারতের ইংরেজ সরকারের কাছে ও সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় দপ্তরে কম্যুনিষ্ট পার্টি জেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে যোশী এক পত্রে ১৯৪২-এর  আত্মগোপনকারী কর্মীদের ও আজাদহিন্দ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে  নিঃশর্ত সাহােেয্যর প্রতিশ্রুতি জানালেন৷ ১৯৪২-এর আন্দোলনের  আত্মগোপনকারী কর্মীরা ও আজাদহিন্দ বাহিনীর সৈন্যরা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত হলো৷  কম্যুনিষ্টরা যে এই কাজের জন্যে ইংরেজদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পেত,  যোশীর চিঠিতে তারও পরিষ্কার উল্লেখ ছিল৷

এই কম্যুনিষ্টরাই নেতাজীকে বলে ছিল, তোজোর অর্থাৎ জাপানের) পোষা কুকুর৷ নেতাজীর অপরাধ তিনি জাপানের সাহায্যে আজাদহিন্দ বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের আক্রমণ করে ভারত স্বাধীন করার কাজে নেমে পড়েছিলেন৷ কিন্তু ভারত স্বাধীন হলে ইংরেজরা দুর্বল হবে, আর ইংরেজরা দুর্বল হলে হিটলার মস্কো দখল করে ফেলবে৷ তাই কম্যুনিষ্টদের তীর্থক্ষেত্র মস্কোর মাটিতে যাতে হিটলারের বাহিনী পৌঁছাতে না পারে সেইজন্যে ভারতের মাটিতে ইংরেজরা থাকুক৷ আর ওই যে নেতাজীর আজাদহিন্দ বাহিনী ইংরেজদের তাড়াতে আসছে, তারা যাতে সফল হতে না পারে তাদের যাতে কোন ভারতীয় সাহায্য সহযোগিতা না করতে পারে, সেই জন্যে ভারতীয়দের ওরা বোঝালো নেতাজী এখন তোজোড় পোষা কুকুর, নেতাজীর আসা মানে জাপানের ভারত দখল৷       (ক্রমশঃ)