বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত স্মরণে

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

অলিন্দ যুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী শহীদ দীনেশ গুপ্তর ফাঁসী হয়েছিল ১৯৩১ সালের ৬ই জুলাই৷ ফাঁসীর পূর্বে কলিকাতা, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে তাঁর মা, বৌদি, ভাইকে লেখা দীনেশের চিঠিগুলি শুধুমাত্র চিঠি নয়৷ জীবন দর্শন--- মাত্র বিশ বছরের এক তরুণের জীবন মৃত্য ধর্ম সম্পর্কে পরিপূর্ণ ভাবনার দার্শনিক নির্দশন তিনটি ঐতিহাসিক পত্র---

মা,

যদিও ভাবিতেছি কাল ভোরে তুমি আসিবে, তবু তোমার কাছে না লিখিয়া পারিলাম না৷

তুমি হয়তো ভাবিতেছ, ভগবানের কাছে এত প্রার্থনা করিলাম, তবুও তিনি শুনিলেন না! তিনি নিশ্চয় পাষাণ, কাহারও বুক-ভাঙা আর্তনাদ তাঁহার কানে পৌঁছায় না৷ ভগবান কি আমি জানি না, তাঁহার স্বরূপ কল্পনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ কিন্তু তবু এ-কথাটা বুঝি, তাঁহার সৃষ্টিতে কখনও অবিচার হইতে পারে না৷ তাঁহার বিচার চলিতেছে৷ তাঁহার বিচারের উপর অবিশ্বাস করিও না, সন্তুষ্ট চিত্তে সে বিচার মাথা পাতিয়া নিতে চেষ্টা কর৷ কি দিয়া যে তিনি কি করিতে চান, তাহা আমরা বুঝিব কি করিয়া?

মৃত্যুটাকে আমরা এত বড় করিয়া দেখি বলিয়াই সে আমাদিগকে ভয় দেখাইতে পারে৷ এ যেন ছোট ছেলের মিথ্যা জুজুবুড়ির ভয়৷ যে মরণকে একদিন সকলেরই বরণ করিয়া লইতে হইবে, সে আমাদের হিসাবে দুই দিন আগে আসিল বলিয়াই কি আমাদের এত বিক্ষোভ, এত চাঞ্চল্য?

যে খবর না দিয়া আসিত, সে খবর দিয়া আসিল বলিয়াই কি আমরা তাহাকে পরম শত্রু মনে করিব ? ভুল, ভুল৷ ‘মৃত্যু’ মিত্ররূপেই আমার কাছে দেখা দিয়াছে৷ আমার ভালোবাসা ও প্রণাম জানিবে৷

                                      - তোমার নসু

                                      (৩০শে জুন, ১৯৩১)

স্নেহের ভাইটি,

তুমি আমাকে চিঠি লিখিতে বলিয়াছ, কিন্তু লিখিবার সুযোগ করিয়া উঠিতে জীবন-সন্ধ্যা হইয়া আসিল৷ যাবার বেলায় তোমাকে কি বলিব? শুধু এইটুকু বলিয়া আজ তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছি, তুমি নিঃস্বার্থপর হও, পরের দুঃখে তোমার হৃদয়ে করুণার মন্দাকিনী-ধারা প্রবাহিত হউক৷

আমি আজ তোমাদের ছাড়িয়া যাইতেছি বলিয়া দুঃখ করিও না, ভাই৷ যুগ যুগ ধরিয়া এই যাওয়া আসাই বিশ্বকে সজীব করিয়া রাখিয়াছে, তাহার বুকের প্রাণস্পন্দনকে থামিতে দেয় নাই৷ আর কিছু লিখিবার নাই৷ আমার অশেষ ভালবাসা ও আশিস জানিবে৷

                                      তোমার দাদা

                                      ৩০. ৬. ৩১.    

বৌদি,

তোমার দীর্ঘ পত্র পাইলাম৷ অ-সময়ে কাহারো জীবনের পরিসমাপ্তি হইতে পারে না৷ যাহার যে কাজ করিবার আছে, তাহা শেষ হইলেই ভগবান তাহাকে নিজের কাছে টানিয়া লন৷ কাজ শেষ হইবার পূর্বে তিনি কাহাকেও ডাক দেন না৷

তোমার মনে থাকিতে পারে, তোমার চুল দিয়া আমি পুতুল নাচাইতাম৷ পুতুল আসিয়া গান গাহিত, ‘‘কেন ডাকিছ আমার মোহন ঢুলী?’’ যে পুতুলের পার্ট শেষ হইয়া গেল, তাহাকে আর স্টেজে আসিতে হইত না৷ ভগবানও আমাদের নিয়া পুতুল নাচ নাচাইতেছেন৷  আমরা এক একজন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে পার্ট  করিতে আসিয়াছি৷ পার্ট করা শেষ হইলে প্রয়োজন ফুরাইয়া যাইবে৷ তিনি রঙ্গমঞ্চ হইতে আমাদের সরাইয়া লইয়া যাইবেন৷ ইহাতে আপশোস করিবার আছে কি?

ভারতবাসী আমরা নাকি বড় ধর্মপ্রবণ৷ ধর্মের নামে ভক্তিতে আমাদের পণ্ডিতদের টিকি খাড়া হইয়া উঠে৷ কিন্তু তবে আমাদের মরণকে এত ভয় কেন? বলি ধর্ম কি আছে আমাদের দেশে? যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, সে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত৷ সবার চেয়ে বড় ধর্ম মানুষের বিবেক৷ সেই বিবেককে উপেক্ষা করিয়া আমরা ধর্মের নামে অধর্মের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিয়াছি৷ একটা তুচ্ছ গরুর জন্য, না হয় একটু ঢাকের বাদ্য শুনিয়া আমরা  ভাই-ভাই খুনোখুনি করিয়া মরিতেছি৷ এতে কি ‘ভগবান’ আমাদের জন্য বৈকুন্ঠের  দ্বার  খুলিয়া রাখিবেন,  না ‘খোদা’ বেহেস্তে স্থান দিবেন?

যে দেশ জন্মের মত ছাড়িয়া যাইতেছি, যার ধূলিকণাটুকু পর্যন্ত আমার কাছে পরম পবিত্র, আজ বড় কষ্টে তার সম্বন্ধে এসব কথা বলিতে হইল৷

আমরা ভাল আছি৷ ভালবাসা ও প্রণাম লইবে৷

স্নেহের ছোট ঠাকুরপো৷

                                                                             (১৮ই জুন, ১৯৩১)

বৌদির কাছে তিনি ‘‘স্নেহের ঠাকুরপো’’৷ ছোট ভাইয়ের কাছে স্নেহশীল দাদা৷ মায়ের কাছে আদরের ‘নসু’৷ আর আমাদের সকলের কাছে বিনয় বাদল দীনেশ এর শেষের জন, মহান বিপ্লবী দীনেশ চন্দ্র গুপ্ত৷