‘‘আজকের মানব সমাজ বিপর্যস্ত অবস্থায় এসে পৌঁচেছে৷ পরিণাম স্বরূপ, মানব সমাজ আজ অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনা, সামাজিক অস্থিরতা, সাংসৃকতিক অবক্ষয় ও ধর্মীয় কুসংস্কারের ভয়াবহ আবর্তে পড়ে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে৷’’
প্রায় ৩৫ বছর আগে প্রাউট প্রণেতা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার আমাদের যে বিপর্যস্ত অবস্থার কথা বলে গেছেন আজ তা আরও ভয়ঙ্কররূপ ধারন করেছে৷ মানুষের লোভক্ষুধানল স্বার্থবৃত্তি তাকে ধবংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ ভাবজড়তাশ্রয়ী ভ্রান্ত দর্শন, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের আবর্জনায় ভরা তথাকথিত ধর্মীয় মতবাদ ও ভোগবাদ আশ্রিত অশ্লীল অসংস্কৃতিকর প্রবাহ সমাজ জীবনের সামঞ্জস্য ভেঙে দিয়েছে৷ সমাজ জীবনে সামঞ্জস্য নষ্ট হয়ে গেলে সমাজে antisocial elements -এর অধিপত্য বিস্তার হতে থাকে৷ তখন ধর্ম -অর্থ-রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিক সমাজের সর্বক্ষেত্রে এই সমাজ বিরোধীরাই ছড়ি ঘোরাতে থাকে৷ এদেরই প্রতাপে আজ মানবতা বিপন্ন, সমাজ কুশ্রীতার জঞ্জালে অবরুদ্ধ৷ এই আবর্জনার অবরোধ থেকে মুক্তির পথ কি?
মানুষ শুধুমাত্র রক্ত-মাংসের দেহ নয়, দেহ-মন আত্মা তিনের সমন্বয়ে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ
‘‘যে আমার সত্য পরিচয়
মাংসে তার পরিমাপ নয়৷’’
মানব সমাজে দার্শনিকতার সূত্রপাত থেকে আনন্দমার্গ দর্শন আসার আগে পর্যন্ত কোন দর্শনই দেহ-মন-আত্মার সাধন করে মানুষকে সঠিক পথ নির্দেশনা দিতে পারেনি৷ কেউ বা শুধু ভৌত জগত নিয়ে চিন্তা করেছেন, কেউ বা ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা বলে জড় জগতকে উপেক্ষা করেছেন,কেউ বা অলীক সাম্যবাদী সমাজতন্ত্রের ফানুস উড়িয়েছেন৷ তাই আজও মানুষ একটা আদর্শ মানব সমাজ গড়ে তুলতে পারলো না৷
আসলে এ যাবৎ প্রচলিত দর্শনগুলিতে জীবন, জগৎ ও মানুষকে পরিপূর্ণরূপে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতেই থেকে গেছে ফাঁকি৷ তাই ব্যষ্টি মানুষের দেহ-মন-আত্মার সঙ্গে, ব্যষ্টির সঙ্গে সমষ্টির, জীবন ও জগতের সঙ্গে সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়েছে তথাকথিত দর্শনগুলি৷ প্রাউট প্রণেতা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে যোগসূত্র নির্ভুলভাবে নির্ণয় করাই দর্শনের মূল লক্ষ্য কিন্তু দার্শনিকরা আন্তরিক প্রয়াস চালিয়েও আপেক্ষিক জগতের সঙ্গে পারমার্থিক জগতের সেতুবন্ধ রচনা করতে পারেননি৷ দর্শন যেন অধিবিদ্যার গোলক বাঁধায় ঘুরে লক্ষ্য ও পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে৷ দর্শনের ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত দর্শনগুলিকে করে তুলেছে ভাব-জড়তাশ্রয়ী বৌদ্ধিক জঞ্জাল৷’’
তাই আপেক্ষিক জগতের সঙ্গে পারমার্থিক জগতের সেতুবন্ধ তো হয়নি, উপরন্তু আধ্যাত্মিকতার গূঢ় রহস্য না জেনে, প্রকৃত মানবধর্ম না বুঝে উপধর্মের পেছনে ছুটে মানুষে মানুষে বিভেদের বীজ বপন করছে, সাম্রদায়িক সংঘাতে রক্তাক্ত করছে ধরনীকে৷ আধ্যাত্মিকতাকে দূরে সরিয়ে মানবতাকে অবদমিত করে ধর্মের নামে ব্যাভিচারে লিপ্ত তথাকথিত ধর্মের ধবজাধারীরা৷
ভৌতিক জগতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার মানুষ৷ মুষ্টিমেয় কিছু ধনকুবের প্রকৃতির ৯০ শতাংশ সম্পদ গ্রাস করে নিয়েছে আর কোটি কোটি মানুষ নিরন্ন অর্ধ-উলঙ্গ রোগ-জীর্ণ অচেতন৷ অথচ খনিজ, বনজ, কৃষিজ, ভেষজ, জলজ প্রভৃতি অফুরন্ত সম্পদে সমৃদ্ধ প্রকৃতি৷ ভৌতিক জগতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যের অভাবে সমাজে সমাজ বিরোধীদের দৌরাত্ম চলছে৷
সাংসৃকতিক জগতেও চলছে অশ্লীলতার প্রবাহ৷ নিম্নমানের রুচিহীন শিল্প সাহিত্য মানুষের মানসিক শুচিতা নষ্ট করছে, নানারকম কু-অভ্যাসকে উৎসাহিত করছে, তারই কদর্যরূপ সমাজের সর্বস্তরে ফুটে উঠছে, দুর্বৃত্তের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ এমত অবস্থায় মানুষের দৈহিক অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামেই দিন পার হয়ে যায়, মানসিক আধ্যাত্মিক প্রগতির চিন্তারও অবকাশ নেই৷
ভ্রান্ত জীবন ধারা, বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক সাম্প্রদায়িক জাত-পাতের বিভেদ বিদ্বেষ, উপধর্মীয় কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে৷ অন্নাভাব, বস্ত্রাভাব, চিকিৎসার অভাব,শিক্ষার অভাব,বাসস্থানের অভাব--- সর্বস্তরেই নিম্নমুখী জীবনযাত্রার মান মানব সমাজকে করে তুলেছে বিশৃঙ্খল বিপর্যস্ত৷
মানবসমাজকে কলুষিত করে এইস্তরে নামিয়ে আনার পশ্চাতে রয়েছে ফ্যাসিস্ট শোষকের কুটিল চক্রান্ত৷ আর্থিক শোষনের চূড়ান্ত ভয়াবহরূপ এই ফ্যাসিস্ট শোষণ৷ ফ্যাসিস্ট শোষক তার শোষনের কৌশল হিসেবে প্রথমেই যে জনগোষ্ঠীর ওপর শোষকের ক্ররদৃষ্টি পড়ে সেই জনগোষ্ঠীর উন্নত ভাষা কৃষ্টি সাহিত্য সংস্কৃতিকর পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিম্নমানের ভাষা সংস্কৃতিকর অনুপ্রবেশ করিয়ে ওই জনগোষ্ঠীকে মানসিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে দেওয়া ও বিকৃত উপধর্মের প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক চেতনা লুপ্ত করে দেওয়া হয়৷ সংগ্রামশীল মানসিকতাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দেওয়া হয়৷
এই ফ্যাসিষ্ট শোষণের কবলে পড়েই বাঙলার আজ বিপর্যস্ত অবস্থা৷ নির্দয় নিপীড়ন ও শোষনের শিকার বাঙালীর কাছে তার উন্নতির সব দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, সব দিক দিয়েই সে আজ পিছিয়ে পড়ছে৷ এই শোষণ ও নিপীড়ণের হাত থেকে বাঙলাকে মুক্ত করতে হলে গড়ে তুলতে হবে দুর্বার আন্দোলন৷ যে আন্দোলনে মূল লক্ষ্য হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন৷ এই আন্দোলন প্রাউটের নব্যমানবতাবাদকে ভিত্তি করেই গড়ে তুলতে হবে৷ যদিও প্রাউট বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক, সাংসৃকতিক সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট পথ দেখিয়েছে, তবুও বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্যই এখন প্রধান সমস্যা, তাই প্রাথমিক পর্যায় অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ ধাপে ধাপে সামাজিক, সাংসৃকতিক সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন শুরু করতে হবে৷
তবে শুধু আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না৷ জনগণের সর্বাত্মক কল্যাণের দিকে দৃষ্টি রেখে বাস্তবমুখী কর্মসূচী নিতে হবে আদর্শ সমাজ সংরচনার জন্যে প্রাউটের দৃষ্টিতে শোষণমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ সংরচনার জন্যে ছয়টি বিষয়ের ওপর নজর দিতে হবে৷ এই ছয়টি বিষয় হলো-১) স্থানীয় জনসাধারণের সার্বিক কর্মসংস্থান (২) সার্বিক শিল্প বিকাশ ৩) বহির্পণ্যের আমদানি এড়িয়ে চলা ৪) স্থানীয় ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ ৫) যোগাযোগের প্রাথমিক মাধ্যম হবে স্থানীয়ভাষা ৬) স্থানীয় সামাজিক অর্থনৈতিক দাবী৷ (এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী পাঠক অবশ্যই পড়বেন শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার রচিত ‘প্রাউটের অর্থনীতি’ গ্রন্থটি৷
স্থানীয় জনসাধারণ বলতে বোঝান হয়েছে--- ‘‘স্থানীয় মানুষ তাদেরই বলব যারা তাদের ব্যষ্টিগত সামাজিক -অর্থনৈতিক স্বার্থকে, যে সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে তারা রয়েছে ওই অঞ্চলের স্বার্থের সঙ্গে মিশিয়ে দেবে৷ অর্থাৎ এ ব্যাপারে প্রাথমিক বিচার্য বিসয় হলো, তারা তাদের নিজস্ব স্বার্থকে ওই সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্বার্থের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে কিনা, তাদের জাতি-বর্ণ-ধর্মমত-মাতৃভাষা-জন্মস্থান যাই হোক-না-কেন সেটা এখানে বিচার্য নয়৷’’ আজ মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বহিরাগত পরিযায়ী শব্দগুলো নিয়ে সুবিধাবাদী ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতারা বাজার গরম করছে শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের জন্যে জনগণের কল্যাণের জন্যে নয়৷ তাই সৎ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সচেতন নাগরিকের উচিত অবিলম্বে শোষণমুক্ত কলুষমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে প্রাউটের পথে সামাজিক অর্থনৈতিক আন্দোলন শুরু করা৷ পরিযায়ী নয়, বহিরাগত নয়, প্রাউটের সংজ্ঞা মেনে প্রকৃত স্থানীয় মানুষের কল্যাণের স্বার্থে৷
২০২১ এর প্রথম প্রাতঃসূর্যকে বরণ করে প্রাউটিষ্টদের শপথ হোক--- এ বিশ্বকে সর্বপ্রকার শোষণের হাত থেকে মুক্ত করে মানুষের বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতেই হবে৷
- Log in to post comments