বিশ্ব উষ্ণায়ন

লেখক
নাতাশা ইসলাম

পৃথিবী ক্রমশ তেতে উঠছে৷ এই উত্তপ্ত পৃথিবীর বাসিন্দা আমরা–অসংখ্য পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, গাছপালা ও সর্বোপরি মানুষ৷ যে মানুষ আজকের এই সংকটজনক পরিস্থিতির জন্যে অনেকটাই দায়ী বিজ্ঞানীদের মতে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির মূল কারণ গ্রীনহাউস গ্যাস৷ বায়ূ মণ্ডলের প্রধান গ্রীনহাউস গ্যাসগুলি হল–জলীয়বাষ্প, কার্বন–ডাই–ক্সাইড •CO2—, নাইট্রাস অক্লাইড •N2O—, মিথেন •CH2— ও ওজন •O3—, আর আছে ক্লোরিন যুক্ত কয়েকটি গ্যাস–পার ফ্লুরোকার্বন্স্ •PFCS—, হাইড্রো ফ্লুরোকার্বন •HFCS— ও সালফার হেক্সাফ্লুরাইড •SF6—, মন্ড্রিল প্রোটোকল৷ ১৯৮৭–এর সিদ্ধান্তে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন–এর্ ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যায় ও বিকল্প হিসাবে এই গ্যাসগুলি ব্যবহার হয় রেফ্রিজারেশান ও সেমি কন্ডাক্টর নির্মাণে৷ ক্লোরোফ্লুরোকার্বন নিষিদ্ধ করা হয় ওজন স্তর ক্ষয়ের জন্যে, তার বিকল্প হিসাবে ব্যবহূত এই গ্যাসগুলিও কম ক্ষতিকারক নয়৷

সূর্য থেকে আমরা যে তাপ পাই তা প্রাণীজগৎকে বাঁচায়৷ এই তাপই আবার আংশিকভাবে বায়ুমণ্ডলে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায় ইনফ্রারেড রশ্মি হয়ে৷ এই বায়ু মণ্ডলের গ্রীনহাউস গ্যাস যা এই ইন্ফ্রারেড রশ্মিগুলিকে পুরোপুরি বায়ুমণ্ডলে ফেরত যেতে দেয় না৷ এর খানিক তারা প্রতিফলিত করে পৃথিবীতে৷ এভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রার ভারসাম্য বা ব্যালান্স বজায় থাকে৷

সত্যি কথা বলতে কি, এই গ্রীন হাউস গ্যাস না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণই থাকত না৷ তার কারণ পৃথিবীর তাপমাত্রা নেমে

যেত –১৮০ সেন্টিগ্রেডে৷ এই গ্রীনহাউস গ্যাসই কম্বলের মতো কাজ করে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাকে ১৮০ সেন্টিগ্রেডে বজায় রাখতে সাহায্য করে৷

কিন্তু বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাসের মাত্রা হঠাৎই খুব বেড়ে গিয়েছে, আর তা এতটাই যে তার ফলে সূর্যের তাপ প্রবেশ ও প্রতিফলনের ভারসাম্যটা বজায় থাকছে না৷ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে৷

মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে যে সব গ্রীনহাউস গ্যাস বের হয় তার মধ্যে প্রধান ৫টি গ্যাস হল–কার্বন–ডাই–ক্সাইড ও মিথেন৷ কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, সিমেন্ট, স্টিল ও সার কারখানা থেকে বের হয় কার্বন–ডাই–ক্সাইড, এছাড়া কার্বন–ডাই–ক্সাইড উৎপাদিত হয় যানবাহনের ধোঁয়া ও গেরস্থালির জ্বালানি থেকেও৷ শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে বাতাসে কার্বন–ডাই–ক্সাইডে মাত্রা ৩৭ক্ম পর্যন্ত বেড়ে গেছে৷ ধান চাষ ও গবাদিপশুর পচন, নানা ধরনের আবর্জনা, কয়লা খনন, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের কূপ বারোমাস পোড়ানোর ফলে মিথেন উৎপন্ন হয়৷ কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন কাজের ফলে ২২ক্ম মিথেন গ্যাস নির্গত হয়৷ বিশ্বজুড়ে অন্যান্য গ্রীনহাউস গ্যাসের তুলনায় মিথেন বেশি ক্ষতিকারক৷ যার প্রভাব কার্বন–ডাই–ক্সাইডে থেকে ২০ গুণ বেশি৷ গ্রীনহাউস এফেক্টের ফলে গত একশো বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৯৮০ সেন্টিগ্রেড৷

আঞ্চলিক স্তরেও আবহাওয়া ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে৷ গত ১০ বছরে পৃথিবীর উষ্ণতা ছিল সবচেয়ে বেশি৷ ২০০৩ সালের ভয়াবহ তাপপ্রবাহে ইউরোপে প্রায় ২০০০ ও ভারতে প্রায় ১৫০০ লোক মারা যায়৷ হিমালয়ের চূড়ার বরফ গলছে, গলছে মেরু অঞ্চলের বরফও (পোলার আইস ক্যাপ)৷ উত্তর দক্ষিণ মেরুর বরফ গলছে প্রতি দশকে ৯ক্ম হারে৷ এরকম চললে ২০৪০ সালের মধ্যে মেরু অঞ্চল বরফ শূন্য হবে৷ হিমালয়ের ২/৩ অংশ বরফ গলে গিয়েছে৷ ১৯১২ সালের পর থেকে পূর্ব আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারোর ৮২ক্ম বরফ গলে গেছে৷ ইউরোপের আল্পস ও ককেশাসের বরফও গত শতকের মধ্যে অর্ধেক শেষ এই হারে বরফ গললে সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়বে, ফলে দেখা দেবে বন্যা৷ সমুদ্রের জলস্তর বাড়ার ফলে মোট ৪০ক্ম মানুষের জীবন বিপন্ন হবে৷ অনুমান করা হচ্ছে ২১০০ সালের মধ্যে ১৮–৫৯ সেমি. পর্যন্ত বেড়ে যাবে সমুদ্রতলের এই উচ্চতা৷

এখন আমাদের মনে প্রশ্ণ জাগতে পারে এই বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্যে কোন ধরণের মানুষ তথা দেশ বেশি দায়ী? বিশ্ব উষ্ণায়নে কার কতটা দায় তা মাপা হয় কে বায়ুমণ্ডলে কতটা গ্রীনহাউস গ্যাস ছাড়ছে তার হিসেবে৷ এই হিসাবটি করা হয় ওই সব গ্যাসের সমপরিমাণ কার্বনের ওজনের ওপর৷ তালিকার প্রথমে রয়েছে আমেরিকা, দ্বিতীয় চীন, তৃতীয় রাশিয়া ও চতুর্থ ভারত৷ কিন্তু এইসব দেশের জনসংখ্যার হিসাব ধরে জনপ্রতি গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ ধরলে হিসেব নিকেশটা আমূল পাল্টে যায়৷ ভারতের মতো দেশের স্থান তালিকার ৪নং থেকে একেবারে নীচে ১২৯–এ চলে যায়৷ একেবারে সোজা সাপ্ঢা বললে–এই বিশ্ব উষ্ণায়নের সব দায়িত্ব একান্ত উন্নত দেশগুলির৷ ১৮৫৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়কালে অর্থাৎ উন্নত দুনিয়ার দ্রুত শিল্পায়নের যুগে বায়ুমণ্ডলের মোট কার্বন–ডাই–ক্সাইডে ৩০ক্ম জন্যে আমেরিকা, ২৯.২ক্ম জন্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ৭.৩ক্ম জন্যে চীন আর মাত্র ২ক্ম জন্যে ভারত দায়ী৷ তাই পৃথক দায়িত্বে নীতি মেনে ক্ষতিকর গ্যাসগুলির মাত্রা কমাতে উন্নত দেশগুলিকেই এগিয়ে আসতে হবে৷

বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা ও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে একত্রিত হয়ে এই গ্রীনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিভিন্ন সম্মেলনে মিলিত হন৷ এভাবে একে একে রিও সম্মেলন, কিয়েটো প্রোটোকল, বালি সম্মেলন ইত্যাদিতে যোগ দিয়ে তাঁরা এ বিষয়ে মতৈক্য পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন৷ তবে সুদূর প্রসারী ও সর্বসম্মত নীতি নির্ধারিত না হলে মানব জাতির পক্ষে তা মঙ্গলকর হবে না৷

পরিশেষে বলা যায় জলবায়ূর পরিবর্তনের জন্যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় কোন অংশে কম হবে না৷ সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নোবেল জয়ী অ্যাশ গোরে ও আইপিসিসি–র চেয়ারম্যান রাজেন্দ্রকুমার পার্চারী৷ গাছপালা, পশুপাখি ও মানুষ সমেত আমাদের এই অসাধারণ নীল গ্রহটিকে যদি বাঁচাতেই হয় তবে এই মুহূর্তে সমস্ত স্বার্থ ভুলে গিয়ে আমাদের সবাইকে, বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকে, প্রতিটি মানুষকে কোমর বেঁধে নামতে হবে একটাই মন্ত্র নিয়ে–‘‘আমাদের গ্রহটিকে বাঁচাও’’৷