বিষণ্ণ্ ভাবনা---অনির্বাণ এষণা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

(এক)

শীতের আমেজ আর অরুণ আলোর স্নিগ্দতায় ভরা আনন্দনগরের সকাল এক অদ্ভূত মনোরম, মনোমুগ্দকর৷ ধর্মমহাসম্মেলন উপলক্ষ্যে বহু ভক্ত একসঙ্গে সমবেত হয়েছিল৷ ভজন, কীর্ত্তন, কর্মচঞ্চলতায় বেশ ক’দিন কাটল৷ এখন ধর্মসম্মেলন শেষ৷ সব কোলাহল কর্ম চঞ্চলতা থেমে গেছে৷ ভক্তরা ফিরে গেছে ভারাক্রান্ত মনে আবার আসার আশা নিয়ে৷ মুখর আনন্দনগর এখন মৌন তাপস৷ আনন্দনগর ছাড়ার সময় হ’ল৷ থাকা-না-থাকার অদ্ভূত এক অনুভূতিতে মন আচ্ছন্ন৷

পরিবর্তনই প্রকৃতির নিয়ম৷ আনন্দনগরও তার ব্যতিক্রম নয়৷ আনন্দনগরেও অনেক কিছু পরিরবর্তন হয়েছে৷ এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু আনন্দনগরের যিনি প্রাণপুরুষ, মহাবিশ্বের যিনি কারিগর, আমাদের সবার প্রাণের প্রাণ, আত্মার আত্মীয়, তিনি কোথায়! এই তো সেদিন আনন্দনগরে রাঙামাটির পথে পথে তাঁর পদচারণা এখনও চোখে ভাসে৷ মধুমালঞ্চ, মধুকোরক, মধুকর্ণিকায় আজও কানে ভাসে তাঁর স্নেহ-মমতায় ভরা মধু ঝরা কণ্ঠ --- ‘সবাই ভালো আছো তো?’

কাজের প্রতি সামান্য অবহেলায় তার তর্জন-গর্জন তাঁর স্নিগ্দ স্মিত হাসিমাখা মুখের অমৃতবচন এখনও কানে বাজে৷ তুমি তো আছোই, তবু ডি.এম.সি. থেকে যখন ডি.এম. এস. শব্দটা কানে লাগে, তোমার আসনে তোমারই প্রতিকৃতি দেখি....একটা না থাকার অনুভূতি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে৷ জানি, অপার অনন্ত তুমি, অরূপ হয়েও রূপে ধরা দিলে, আবার ফিরেও গেলে!

কিন্তু যাবে কোথায়? এ মহাবিশ্বের সবই যে তুমি৷ রূপময় এ মহাবিশ্বের রূপকার যে তুমিই৷ তাই একে ছেড়ে যাওয়ার উপায়ও তোমার নেই৷ আমার আমিতে যে আছে সেও তো তুমি৷ তোমারই গানের ভাষা পাল্টে বলি---এ যাওয়াকে যাওয়া বলে না৷ ‘ছিলে, আছো, থাকবে তুমি, নিত্যকালের তুমি প্রভু৷’

আবার আসার আশা নিয়ে আনন্দনগর ছেড়ে চলেছি প্রভাত সঙ্গীতেরই সুর ভাঁজতে ভাঁজতে---

‘‘আনন্দ-উচ্ছ্বল পরিবেশে সে এসেছিল মোর ঘরে

আলো-ভরা নীলাকাশে সবার মনের ভিতরে৷’’

(দুই)

সবাইকে ছেড়ে এসে নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ্ মনে যখন ফেলে আসা স্মৃতিগুলো জুড়ে বসে, মন তখন চলে যায় দূরে আরও দূরে পল্লীগ্রামে৷ মনে হয় কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলি৷ সূর্য অস্ত গেছে, গোধূলি পার করে রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে গ্রাস করছে পৃথিবীকে৷ তখনও সন্ধ্যা হলে রাস্তার ল্যামপোষ্টে আর ঘরে ঘরে বিজলী বাতির আলো ছড়িয়ে পড়ত না৷ মা, কাকিমারা তুলসী তলায় দীপ জ্বেলে দিত, বাজত শঙ্খ, ঘণ্টা৷ একটু দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসত আজানের সুর৷ কোন বিবাদ, বিদ্বেষ ছিল না৷ অদ্ভূত এক ভাল লাগার জীবন ছিল সেটা৷

আজ বিজ্ঞান তো অঞ্জলী ভরে কত কিছুই দিয়েছে৷ কিন্তু ছেলেবেলার সেই ভাল লাগাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে৷ ছেলেবেলার একটা স্মৃতি খুব মনে পড়ে৷ মা-কাকিমা-জেঠিমা ঘরের ও পাড়ার সম্পর্কে সকলেই দুপুরের খাওয়ার পর রাস্তার ধারে বাড়ির দালানে বসে গল্প-গুজব করত, আর মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখত পাঁচকড়ি পিওন আসছে কি না৷ একটু দেরী হলে কারো কারো গল্পে মন বসত না৷ বিশেষ করে নতুন বৌদী, কাকিমা হলে তো কথাই নেই৷ অস্থির মনে ঘন ঘন রাস্তার দিকে তাকাত৷ এই নিয়ে রঙ্গ-রসিকতাও চলত৷ তখন তো বাপের বাড়ীর খবর নিতে পাঁচকড়ি পিওনই ভরসা ছিল৷ ওই পিওনকে কেন্দ্র করে একটা সমূহিক জীবন গড়ে উঠেছিল৷ সকলেই পড়তে জানত না৷ তাই একের চিঠি অন্যে পড়ে দিত৷ এখনকার মত একান্ত ব্যষ্টিগত বলে কিছু ছিল না৷ বেশ একটা মজার জীবন ছিল৷ একে অপরের সুখ-দুঃখের ভাগীদার ছিল৷

বিজ্ঞান যেমন আমাদের অঞ্জলি ভরে দিয়েছে,আবার হৃদয় নিঃস্ব করে নিয়েওছে৷ আজ ঘরের কোনে বসে শ্বশুর বাড়ীর বউমা সেল ফোন কানে কতবার যে বাপের বাড়ীর মেয়ে হয়ে যায়! পাঁচকড়ি পিওনদের আজ আর প্রয়োজন হয় না৷ পাঁচকড়ি পিওনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সেই সামূহিক জীবনটাও হারিয়ে গেছে৷ মানুষ দিন দিন আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে৷ স্বার্থ-লোভ আর সীমাহীন বাসনা তাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে আপাত-মধুর তমোগুণি মরীচিকার দিকে৷

বিজ্ঞানের এটাই অবগুণ৷ রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই সতর্ক করে লিখেছেন---

যে প্রশান্ত সরলতা জ্ঞানে সমুজ্জ্বল,

স্নেহে যাহা রসসিক্ত সন্তোষে শীতল

ছিল তাহা ভারতের তপোবন তলে৷

বস্তুভারহীন মন সর্ব জলে স্থলে

পরিব্যাপ্ত করে দিত উদার কল্যাণ৷

জড়ে জীবে সর্বভূতে অবারিত ধ্যান

পশিত আত্মীয়রূপে৷  আজি তাহা নাশি

চিত্ত যেথা ছিল সেথা এল দ্রব্যরাশি,

তৃপ্তি যেথা ছিল সেথা এল আড়ম্বর,

শান্তি যেথা ছিল সেথা স্বার্থের সমর৷

এইভাবে বিজ্ঞান মানুষকে সভ্যতা বিমুখ করে দিচ্ছে৷ প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা সর্বজন শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাত রঞ্জন সরকার বিজ্ঞানের অগ্রগতি রোধ না করেও সুনির্দিষ্ট পথ নির্দেশনা দিয়েছেন৷ বিজ্ঞানের অগ্রগতির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক চর্চা, অনুশীলন একান্ত প্রয়োজন৷ নতুবা বিজ্ঞান অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে---যার প্রতিফলন আজ সমাজে দেখা দিয়েছে৷ তাই বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন দুইয়ের সমন্বয়ে সভ্যতা এগিয়ে যাবে৷ নতুবা সভ্যতার বিপদ অনিবার্য৷ রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করে গেছেন, শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার পথ দেখিয়েছেন৷ মানুষ যদি সতর্ক না হয়, সঠিক পথে না চলে তবে মানব সমাজের দুর্দিন ঘনিয়ে আসবে৷

(তিন)

মেঘলা আকাশ, বিষণ্ণ্ বেলা, জীবনের পাণ্ডুলিপী বিবর্ণ ধূসর৷ বিস্মৃত স্মৃতি যত ভীড় জমায় অবসন্ন মনে৷ খুঁজে বেড়ায় ফেলে আসা জীবনের মানে---এ পৃথিবীতে এসে কী পেলে!

মানুষ এই পৃথিবীতে আসে আবার চলেও যায়৷ মাঝের ক’দিন খাওয়া-বংশ বিস্তার, কলহ, ভাব-ভালবাসা৷ শুধু কি এই জন্যেই পৃথিবীতে আসা! পশুরাও তো আসে! এমনি করেই চলে যায়৷ উদ্ভিদও তাই৷ তাদেরও বেদনাবোধ আছে৷ তবু মানুস কেন সবার শ্রেষ্ঠ?

মানুষের মন আছে, বিবেক আছে, বুদ্ধি আছে, বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আছে৷ ঈশ্বরই তাকে এই সকল ক্ষমতা দিয়েছেন৷ পশুপক্ষী, গাছপালার এসব কিছু নেই৷ তাই প্রকৃতির নিয়মেই তারা চলে৷ মানুষ ও প্রকৃতির নিয়মের বাইরে নেই৷ তবু তাকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে ভালমন্দ বিচার করে চলতে হয়৷ বস্তু জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে জীবনের পরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলাই তার প্রাণধর্ম, তার সাধনা৷ মানুষ যখন সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তখনই সমাজে নেমে আসে বিপর্যয়৷ আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অবক্ষয় তার কারণ এটাই৷ মানুষ তার প্রাণধর্ম থেকে, আধ্যাত্মিক জীবন চর্চা থেকে আজ সরে এসে ভোগ সর্বস্ব জীবনের দিকে ছুটে চলেছে৷ পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন---‘‘মানুষ তুমি ওঁ ওঙ্কারের পথ ধরে সূক্ষ্মত্বের দিকে এগিয়ে চলো৷ ছুটো না তুমি আপাত মধুর তমোগুণী মরীচিকার দিকে৷ সত্ত্বগুণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর ব্রহ্মত্বে লীন হও৷ ওঙ্কার যেখান থেকে এসেছে সেখানে গিয়ে পৌঁছাও৷

সাধনায়, নিষ্ঠায় জাগিয়ে তোল নিজের সুপ্ত মনুষ্যত্বকে৷ উদ্বোধন কর দেবত্বের মনীষাকে৷ আর সেই সাধনা লব্ধ শুচিশুভ্র দেবত্বকে বিলিয়ে দাও ব্রাহ্মী মহিমার অখণ্ড স্রোতে৷ অর্জন কর সেই পরমাস্থিতি যার জন্যে অনাদিকাল থেকে তুমি অনেক  কষ্টে এগিয়ে এসে আজ নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দেওয়ার সুযোগ পেয়েছো৷’’

এক পলক দমকা হাওয়া, ঝিরঝিরে বৃষ্টির পর মেঘলা বিষণ্ণ্ ভাবটা আর নেই৷ বৃষ্টি ধোওয়াা প্রকৃতির অঙ্গে পশ্চিমী সূর্যের স্নিগ্দ আলো ছড়িয়ে পড়েছে৷ অবসন্ন মনটাও পাওয়ার আনন্দে উৎফুল্ল৷ জীবনের মানে সে বুঝতে পেরেছে৷ পথ সে খুঁজে পেয়েছে৷

এ জগৎ নয়, তার মনের এষণা লোকত্তর৷ অনির্বান আনন্দের সন্ধানে সে ছুটে চলেছে৷ তার চাই অমৃতত্ত্বের অধিকার৷ তার সাধনা দিব্য স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, পরমাস্থিতি লাভ করা৷ তবে এই জগতকে উপেক্ষা করে নয়৷ বৈষয়িক সামঞ্জস্য বজায় রেখেই তাকে এগিয়ে যেতে হবে বিষয়ের দিকে সাধনার দ্বারা, সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা৷

এক অনির্বাণ এষণাই মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে অনির্বান আনন্দপ্রাপ্তির পথে৷ জীবনের অন্য মানে নেই, অন্য পথও নেই৷