বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো

লেখক
অাচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

নিত্য নোতুন কতই না  সরকারী নিয়ম-কানুন! আধার কার্ড, প্যান কার্ড থেকে শুরু করে নানান্ বেড়া পার হতে হয়৷  তবে লোন, অনুদান মায় যে কোনো সরকারী পরিষেবা পাওয়া যাবে৷ গরীব মধ্যবিত্ত মানুষ- সবার  অতশত  জ্ঞানগম্যিও  নয়,  এই জটিলতা  বোঝবার  মত সময় নেই৷  অধিকাংশের সামর্থ্যও  নেই৷ তবু আইনের কড়াকড়ি৷ না হলে  যে সবাই  সরকারকে ফাঁকি  দেবে! দুর্নীতিতে ছেয়ে যাবে দেশ৷ তাই সদা  সতর্ক  প্রহরী , নোতুন নোতুন নিয়মের বজ্রবন্ধন৷

কিন্তু এইসব নিয়মকানুুন--- সব কি গরীব, নিম্নমধ্যবিত্ত--- সাধারণ  মানুষের  জন্যে?  দেখে শুনে তো তা-ই  মনে হচ্ছে৷  ৫০০ টাকা,  ১০০০ টাকার  নোট বাতিল  হ’ল৷  সাধারণ  মানুষের দুর্র্ভেগের  অন্ত নেই,  কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মারাও গেলেন এই দুর্র্ভেগের কারণে৷  কিন্তু ধনী ব্যবসায়ী, বড় বড়  শিল্পপতি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার  সহ নানান্ সরকারী হোমরা-চোমরাদের  সঙ্গে লাইন করে লাখ  লাখ  পুরোনো টাকা বদলে  নিল, কালো  টাকা শাদা করল৷

তাই তো বলা হয়, বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো৷ গরীব জনসাধারণের  জন্যে বজ্র আঁটুনি আর ধনকুবেরের জন্যে ফস্কা গেরো৷

সবক্ষেত্রেই  তো তা-ই হচ্ছে৷ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধ করি  সাম্প্রতিক  মামা-ভাগ্ণের কিস্সা৷  ভাগ্ণে  নীরব  মোদী আর মামা মেহুল চোকসি৷ দু’জন  মিলে অন্ততঃ  ১১ হাজার  ৪০০ কোটি  টাকা  পঞ্জাব ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে  পালিয়ে গেলেন৷ কার টাকা?  জনসাধারণের  ব্যাঙ্কে  জমানো টাকা  জালিয়াতি  হয়ে গেল৷ জানা যাচ্ছে, এর সঙ্গে ব্যাঙ্কের বেশ কিছু কর্মী, এমনকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কিছু কর্মীও যুক্ত আছে৷ তাহলে এত যে নিয়ম কানুন, এত যে নিয়মিত ইনস্পেকসন, --- এইসব বেড়া অতিক্রম করে বছরের পর বছর কী করে এঁরা জনগণের জমানো টাকা  দেদার লুঠ করলেন?  হঠাৎ করে এটা  হয় নি৷ দীর্ঘকাল ধরে ঋণ শোধ করা হচ্ছে না, অথচ  পর পর ঋণ মঞ্জুর হয়ে যাচ্ছে৷

 কী করে হচ্ছে?  এটাই তো  রহস্য! প্রতিদিন  এত আইনের সুক্ষ্ম টানা  জাল  বিছানো  হচ্ছে, তাহলেও  কী করে  রাঘব বোয়ালেরা বেরিয়ে যাচ্ছে?  জালের ছিদ্র দিয়ে না জাল  কেটে?---এ প্রশ্ণের উত্তর তো মিলছে  না!

শুধু এই দুই মামা-ভাগ্ণের ম্যাজিক নয়! খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের  রিপোর্ট, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত  মোট ৮,৬৭০ টি ব্যাঙ্ক জালিয়াতি হয়েছে৷ যার আর্থিক পরিমাণ ৬১,২৬০ কোটি টাকা৷ ব্যাঙ্ক থেকে  বিপুল পরিমান  টাকা ঋণ শোধ না করে  ওই  টাকা  অন্যত্র  সরিয়ে  দেওয়া হয়েছে৷ প্রায় সবক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম মেনে ঋণ দেওয়া হয়নি৷  ব্যাপক  দুর্নীতির  গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে৷ এ ব্যাপারটা কেবল যে  পঞ্জাব ন্যাশন্যাল  ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেই  হচ্ছে তা নয়, বিভিন্ন ব্যাঙ্কের  ক্ষেত্রেই একই চিত্র৷  বলা হয়েছে , এ বিষয়ে   পঞ্জাব ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্কের স্থান শীর্ষে হলেও তারপরে আছে ব্যাঙ্ক অব বরোদার স্থান, তারপর ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার স্থান৷ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণ সমস্যা মিটাতে গত বছর সরকার  ব্যাঙ্কগুলিকে ২,১২০০০ কোটি টাকা  দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এইভাবে জনগণের কর থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে সরকার ব্যাঙ্কের মাধ্যমে  পুঁজিপতিদেরই যোগান দিচ্ছে৷

গলদটা কোথায়? আসলে গোড়ায় গলদ৷ তাত্ত্বিকভাবে বলা হয়, গণতন্ত্র হল জনগণের দ্বারা জনগণের জন্যে,  জনগণের শাসনব্যবস্থা৷ বাস্তব কিন্তু  অন্য কথা বলছে৷ দেখা যাচ্ছে জনগণের  স্থলে এসে গেছে পুঁজিপতিরা৷ অর্থাৎ গণতন্ত্র মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে, পুঁজিপতিদের দ্বারা, পুঁজিপতিদের জন্যে,  পুঁজিপতিদের সরকার৷

এ কেমন কথা? জনগণের দ্বারা যে সরকার তৈরী হচ্ছে, তা তো  আমরা  বিগত নির্বাচন প্রক্রিয়াগুলিতে দেখেছি৷ দেখেছি, রোদে জল বৃষ্টিতে জনগণ ভোটার কার্ড  হাতে নিয়ে লাইনে  দাঁড়িয়ে  তাদের পছন্দমত প্রার্থীকে  বোট দিচ্ছে৷ খবরের কাগজে  তার বড় বড় ছবিও  প্রকাশিত হতে দেখেছি৷ কিন্তু, এই ছবির পেছনে  আর একটা ছবি আছে, তা পত্রিকায় ছাপা হয় না৷

সেটা বস্তা বস্তা টাকা  দিয়ে বোট কিনে নেওয়া হচ্ছে৷ তার সঙ্গে হুমকিও রয়েছে৷ ব্যস, বাকিটা রিহার্স্যাল করা অভিনয়ের মতই  দৃশ্যপটে  দেখা যাচ্ছে৷

হ্যাঁ, এক্ষেত্রেও দুর্নীতি রুখতে নানান্ নিয়ম-কানুন রয়েছে৷ কিন্তু অর্থশক্তির  তরবারি  দিয়ে পুঁজিপতিরা  সব নিয়ম-কানুনের জালকে  কেটে তাদের  কাজ হাসিল করে নিচ্ছে৷

তাই গোড়ায় গলদ হলে সব নিয়ম-কানুনের ক্ষেত্রেই এই ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’ ব্যাপারটা হতেই থাকবে৷