নিত্য নোতুন কতই না সরকারী নিয়ম-কানুন! আধার কার্ড, প্যান কার্ড থেকে শুরু করে নানান্ বেড়া পার হতে হয়৷ তবে লোন, অনুদান মায় যে কোনো সরকারী পরিষেবা পাওয়া যাবে৷ গরীব মধ্যবিত্ত মানুষ- সবার অতশত জ্ঞানগম্যিও নয়, এই জটিলতা বোঝবার মত সময় নেই৷ অধিকাংশের সামর্থ্যও নেই৷ তবু আইনের কড়াকড়ি৷ না হলে যে সবাই সরকারকে ফাঁকি দেবে! দুর্নীতিতে ছেয়ে যাবে দেশ৷ তাই সদা সতর্ক প্রহরী , নোতুন নোতুন নিয়মের বজ্রবন্ধন৷
কিন্তু এইসব নিয়মকানুুন--- সব কি গরীব, নিম্নমধ্যবিত্ত--- সাধারণ মানুষের জন্যে? দেখে শুনে তো তা-ই মনে হচ্ছে৷ ৫০০ টাকা, ১০০০ টাকার নোট বাতিল হ’ল৷ সাধারণ মানুষের দুর্র্ভেগের অন্ত নেই, কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মারাও গেলেন এই দুর্র্ভেগের কারণে৷ কিন্তু ধনী ব্যবসায়ী, বড় বড় শিল্পপতি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সহ নানান্ সরকারী হোমরা-চোমরাদের সঙ্গে লাইন করে লাখ লাখ পুরোনো টাকা বদলে নিল, কালো টাকা শাদা করল৷
তাই তো বলা হয়, বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো৷ গরীব জনসাধারণের জন্যে বজ্র আঁটুনি আর ধনকুবেরের জন্যে ফস্কা গেরো৷
সবক্ষেত্রেই তো তা-ই হচ্ছে৷ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধ করি সাম্প্রতিক মামা-ভাগ্ণের কিস্সা৷ ভাগ্ণে নীরব মোদী আর মামা মেহুল চোকসি৷ দু’জন মিলে অন্ততঃ ১১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পঞ্জাব ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেলেন৷ কার টাকা? জনসাধারণের ব্যাঙ্কে জমানো টাকা জালিয়াতি হয়ে গেল৷ জানা যাচ্ছে, এর সঙ্গে ব্যাঙ্কের বেশ কিছু কর্মী, এমনকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কিছু কর্মীও যুক্ত আছে৷ তাহলে এত যে নিয়ম কানুন, এত যে নিয়মিত ইনস্পেকসন, --- এইসব বেড়া অতিক্রম করে বছরের পর বছর কী করে এঁরা জনগণের জমানো টাকা দেদার লুঠ করলেন? হঠাৎ করে এটা হয় নি৷ দীর্ঘকাল ধরে ঋণ শোধ করা হচ্ছে না, অথচ পর পর ঋণ মঞ্জুর হয়ে যাচ্ছে৷
কী করে হচ্ছে? এটাই তো রহস্য! প্রতিদিন এত আইনের সুক্ষ্ম টানা জাল বিছানো হচ্ছে, তাহলেও কী করে রাঘব বোয়ালেরা বেরিয়ে যাচ্ছে? জালের ছিদ্র দিয়ে না জাল কেটে?---এ প্রশ্ণের উত্তর তো মিলছে না!
শুধু এই দুই মামা-ভাগ্ণের ম্যাজিক নয়! খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৮,৬৭০ টি ব্যাঙ্ক জালিয়াতি হয়েছে৷ যার আর্থিক পরিমাণ ৬১,২৬০ কোটি টাকা৷ ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল পরিমান টাকা ঋণ শোধ না করে ওই টাকা অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ প্রায় সবক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম মেনে ঋণ দেওয়া হয়নি৷ ব্যাপক দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে৷ এ ব্যাপারটা কেবল যে পঞ্জাব ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেই হচ্ছে তা নয়, বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেই একই চিত্র৷ বলা হয়েছে , এ বিষয়ে পঞ্জাব ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্কের স্থান শীর্ষে হলেও তারপরে আছে ব্যাঙ্ক অব বরোদার স্থান, তারপর ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার স্থান৷ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণ সমস্যা মিটাতে গত বছর সরকার ব্যাঙ্কগুলিকে ২,১২০০০ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এইভাবে জনগণের কর থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে সরকার ব্যাঙ্কের মাধ্যমে পুঁজিপতিদেরই যোগান দিচ্ছে৷
গলদটা কোথায়? আসলে গোড়ায় গলদ৷ তাত্ত্বিকভাবে বলা হয়, গণতন্ত্র হল জনগণের দ্বারা জনগণের জন্যে, জনগণের শাসনব্যবস্থা৷ বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে৷ দেখা যাচ্ছে জনগণের স্থলে এসে গেছে পুঁজিপতিরা৷ অর্থাৎ গণতন্ত্র মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে, পুঁজিপতিদের দ্বারা, পুঁজিপতিদের জন্যে, পুঁজিপতিদের সরকার৷
এ কেমন কথা? জনগণের দ্বারা যে সরকার তৈরী হচ্ছে, তা তো আমরা বিগত নির্বাচন প্রক্রিয়াগুলিতে দেখেছি৷ দেখেছি, রোদে জল বৃষ্টিতে জনগণ ভোটার কার্ড হাতে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের পছন্দমত প্রার্থীকে বোট দিচ্ছে৷ খবরের কাগজে তার বড় বড় ছবিও প্রকাশিত হতে দেখেছি৷ কিন্তু, এই ছবির পেছনে আর একটা ছবি আছে, তা পত্রিকায় ছাপা হয় না৷
সেটা বস্তা বস্তা টাকা দিয়ে বোট কিনে নেওয়া হচ্ছে৷ তার সঙ্গে হুমকিও রয়েছে৷ ব্যস, বাকিটা রিহার্স্যাল করা অভিনয়ের মতই দৃশ্যপটে দেখা যাচ্ছে৷
হ্যাঁ, এক্ষেত্রেও দুর্নীতি রুখতে নানান্ নিয়ম-কানুন রয়েছে৷ কিন্তু অর্থশক্তির তরবারি দিয়ে পুঁজিপতিরা সব নিয়ম-কানুনের জালকে কেটে তাদের কাজ হাসিল করে নিচ্ছে৷
তাই গোড়ায় গলদ হলে সব নিয়ম-কানুনের ক্ষেত্রেই এই ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’ ব্যাপারটা হতেই থাকবে৷
- Log in to post comments