বন্ধু হে, নিয়ে চলো.......

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

পূর্ব প্রকাশিতের পর

প্রভাত সঙ্গীতের রচয়িতা ও সুরকার যুগপুরুষ শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার একাধারে অর্থনৈতিক -সামাজিক দর্শন প্রাউট PROUT) বা ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ -এর প্রবর্ত্তক ও আধ্যাত্মিক গুরু রূপে মহাসম্ভূতি, তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী নামে জগৎকল্যাণে অধ্যাত্ম দর্শন ‘আনন্দমার্গের ’ সৃষ্টিকর্তা৷ আনন্দমার্গের অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনার দ্বারা প্রতিটি মানুষকে আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে সাধনা, ত্যাগ ও সেবার আদর্শে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পথনির্দেশনা তিনি দিয়েছেন৷ আনন্দমার্গের মূলনীতি হ’ল ‘‘আত্মমোক্ষার্থম্ জগদ্ধিতায় চ’’৷ মানুষ ব্যষ্টিগত ক্ষেত্রে সাধনার দ্বারা নিজেকে ধর্ম-ন্যায়-সত্যের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করে মুক্তিপথের সন্ধানে এগিয়ে চলবে---আবার সেবা, ত্যাগ ও জনকল্যাণের দ্বারা সমাজের সার্বিক উন্নতি ও শোষণমুক্তির জন্যে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাবে৷ আধ্যাত্মিকতার প্রেরণা না থাকলে নৈতিকতা গড়ে উঠতে পারে না--- আর নৈতিক বলে বলীয়ান না হলে দুর্নীতিমুক্ত শোষণহীণ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব৷ তাই ব্যষ্টিগত ও সামাজিক জীবনের মূল ভিত্তিই হল আধ্যাত্মিকতা---এই আধ্যাত্মিকতার প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রবর্ত্তিত আনন্দমার্গের মূল উদ্দেশ্য৷ অপরপক্ষে বর্ত্তমান পৃথিবীতে পূঁজিবাদের অভ্রংলেহী অর্থলিপ্সা ও সম্পদ সঞ্চয়ের মানসিকতা আর জড়বাদী কম্যুনিজমের মানবিক মূল্যবোধের প্রতি অবিচার ও অবমূল্যায়ণ মানব জাতির অশেষ কষ্টের কারণ৷ মুষ্টিমেয় মানুষের ঘরে সম্পদের পাহাড় ও ভোগবিলাসের উপাদানের প্রাচুর্য বৃহত্তর সমাজে শোষণ ও বঞ্চনার জাল বিস্তার করে চলেছে৷ এই শোষিত, বঞ্চিত নিপীড়িত মানবতাকে মুক্তিপথের সন্ধান দিতেই শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রাউট-দর্শনের প্রবর্ত্তন৷ প্রাউটের প্রথম সিদ্ধান্ত অনুযায়ী --- সামবায়িক সংস্থার (collective body)  অনুমতি ছাড়া কাউকে ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে দেওয়া যাবে না৷ বিশ্বপিতার সৃষ্ট সম্পদে সকলের সমান ভোগ-দখলের অধিকার রয়েছে কিন্তু কারোর ব্যষ্টিগত মালিকানা থাকতে পারে না৷ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমগ্র সৃষ্টিই বিশ্বপিতার সন্তান -সন্ততি ও সকলেরই নূ্যনতম প্রয়োজনের গ্যারান্টি থাকতে হবে৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্বারা ভৌতিক সম্পদের পরিমাণ ও উৎকর্ষ বৃদ্ধির মাধ্যমে নূ্যনতম প্রয়োজনের মান ও মাত্রাকে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে নিতে হবে যাতে সকলেই এই উন্নতির সুবিধা পায়৷ মানুষের চাহিদা অনন্ত কিন্তু ভৌতিক সম্পদ সীমিত৷ মানুষের এই অনন্ত পিপাসাকে অসীম মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি পরিচালিত করার ব্যবস্থা করতে হবে৷ এই আধ্যাত্মিক জগতে চলার পথনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা যোগায় আনন্দমার্গের আধ্যাত্মিক আদর্শ ও যোগসাধনার ক্রমবিন্যাস৷

জীবনের পথে চলতে গিয়ে মানুষকে মাঝে মাঝেই বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়৷ অতীত জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি, আজন্ম লালিত কুসংস্কার, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রতিবন্ধকতা , ভাবজড়তা, অজ্ঞানতা, লজ্জা, আগামী দিনের অজানা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশঙ্কা, সংশয় প্রভৃতি বিষয়গুলি মানুষের সম্মুখবর্তী পদক্ষেপকে বিলম্বিত ও বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে৷ এই সময়েই প্রকৃত বন্ধুরূপে পরমপিতা সদ্গুরু হিসেবে মানুষকে সত্যের পথে এগিয়ে চলার নির্দেশনা ও প্রেরণা দান করেন৷ আর সাধারণ মানুষও তখন ক্রমে ক্রমে সাহস ও বিশ্বাস সঞ্চয় করে সম্মুখ পানে অগ্রসর হয়৷ এই মানস বিবর্তনই সার্থকভাবে ব্যক্ত হয়েছে প্রভাত সঙ্গীতে ---

(২৭৮৮ সংখ্যা)---

‘‘ গান গেয়ে তুমি পথ চলেছিলে, বলেছিলে কন্ঠ মেলাতে৷

দূরে থেকে আমি দাঁড়িয়ে দেখেছি কাছে

আসিনিকো লজ্জাতে৷৷

ছিল লাজ-ভয়, ছিল সংশয়, ভাবিয়াছি তুমি

আপনার নয়৷

ভ্রম সরে গেছে সম্বিৎ এসেছে , আজকে

তোমায়  খুঁজি পথে৷৷

......

আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে আনন্দমূর্ত্তিজী সর্বদাই মানুষকে আশার কথা শুণিয়ে গেছেন৷ কোন অবস্থাতেই মানুষ যেন নিজেকে অসহায় বা দুর্বল মনে না করে, মানুষ যেন স্মরণে রাখে, সে পরমপিতার সন্তান ও তিনি সর্বদাই তার সঙ্গে রয়েছেন৷ --- এই আশ্বাস বাণী তিনি বার বার উচ্চারণ করেছেন তাঁর অজস্র প্রবচন ও প্রভাত সঙ্গীতে৷

আশাবাদের গানগুলির মধ্যে দুটি ঃ

প্রভাত সঙ্গীত সংখ্যা---১৮

 কে যেন আসিয়া কয়ে গেছে কাণে নূতন প্রভাত আসিবে৷

কালো কুয়াশার যবনিকা পারে সোণালী জীবন হাসিবে৷৷

থাকিবে না আর ব্যথা-হাহাকার, বহিবে না আর শুধু আঁখিধার৷

সব বেদনার ঊধর্ব লোকেতে প্রাণের পরাগ ভাসিবে৷৷

স্নেহ-মমতার এই যে ভুবন, আশা-ভালবাসা মধুর স্বপন৷

 সকল মনের মর্মে পশিয়া সব কালো ছায়া নাশিবে৷৷

প্রভাত সঙ্গীত সংখ্যা---৪৬৫৮

আলোকেরই রথে এলে, তমসা সরালে৷

ক্রন্দসী ধরায় আসি’ অশ্রু মোছালে৷৷

শোকে জর্জরিত নিরাশ ভগ্ণ বুকে,

পেলব পরশে তব ভুলাইলে যত দুঃখে৷

শীতল নিথর মৃত্যুর স্তব্ধতাকে অশনি স্বণনে ভাষা দিলে৷৷

তমঃ হতে উদগারিত হতেছিল তমঃ,

বিষজ্বালামুখী হতে বিষবাষ্প সম৷

জ্ঞানাঞ্জনশলাকাতে সেই নির্মম নাশিলে সর্বগ্রাসী গরলে৷৷

কিন্তু মানুষের  অতীত জীবন তাকে প্রতিনিয়ত পিছু ডাকে ও তার চলার পথকে পিচ্ছিল করে দেয়---অনেক সময় তার পদস্খলনও হয়৷ সে কারণেই প্রভাত সঙ্গীতের (৪৮১৬ সংখ্যা) মাধ্যমে অনুজ্জ্বল ও যন্ত্রণাতপ্ত অতীতের দিকে তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে৷

‘‘যে পথ দিয়ে এসেছিলুম, সেপথে ফেরা হবে না৷

সুমুখ পানেই চলতে হবে, পেছনে তাকানো মানা৷৷

চলার পথের হে দিশারী , তোমার রীতি বুঝতে নারি৷

দুঃখ দিয়ে হও দুঃখহারী, লুকিয়ে কিছুই করা যাবে না৷৷.......

পরমপুরুষের কৃপায় ও সদ্গুরুর নির্দেশনার সদুপযোগের ফলে মানুষ ফেলে আসা জীবনের ভুল ত্রুটি শুধরে নিয়ে বাধার উপলখণ্ডগুলোকে পদাঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে এগিয়ে চলার শক্তি অর্জন করে ৷ তার মনের সংশয় সংকোচ ভ্রম, অজ্ঞানতার অন্ধতমিস্রা চেতনা ও সত্যের অত্যুজ্জ্বল অলোকচ্ছ্বটায় দূর হয়ে যায়৷ মানুষ তখন অকুতোভয় হয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে জগতের কল্যাণে সম্মুখপানে এগিয়ে চলার শপথ গ্রহণ করে৷ এই ভাবনাই মূর্তরূপ পেয়েছে প্রভাত সঙ্গীতে (সংখ্যা-৩৪২) ঃ

 সুমুখের পানে চলে যাব আমি তোমারই নামটি সাথে নিয়ে৷

চরণ টলিবে না গো আমার, হিয়া কাঁপিবে না কারো ভয়ে৷৷

ভূধরে সাগরে এই চরাচরে কেহ না পারিবে বাধা দিতে মোরে৷

যে কাজ করিতে এসেছি করিব সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে৷৷

যেদিন চলিয়া গিয়াছে আমার, তাহা নিয়ে

করিবো না হাহাকার৷

যেদিন আসিছে তাহার লাগিয়া ভুগিব না কোন সংশয়ে৷৷

এইভাবে মহান দার্শনিক , আধ্যাত্মিক গুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তথা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার ৫০১৮ টি বহু মাত্রিক প্রভাত সঙ্গীতের ভাব-ভাষা ব্যঞ্জনা ও সুরমূর্ছনার মাধ্যমে বিশ্বপ্রেম, মানবপ্রেম, ঈশ্বর প্রেম ও নব্যমানবতার আদর্শে সকলকে চেতনাদীপ্ত ও উজ্জীবিত করে আলো ঝলমল সুন্দর পৃথিবী রচনার প্রেরণা সঞ্চার করেছেন৷ সমগ্র পৃথিবীর প্রতিটি জীব, জড়, চেতন-অচেতন , উদ্ভিদ-প্রাণী সকলেই মিলে-মিশে একসাথে আননন্দময় পরিবেশে জীবনের পরমলক্ষ্যের পানে এগিয়ে চলবে ও যথাসময়ে সর্বাত্মক মুক্তির পরাগতি প্রাপ্ত হবে---এই বার্র্ত্তই প্রভাত সঙ্গীতের ছত্রে ছত্রে বিধৃত ও ঝঙ্কৃত৷  (সমাপ্ত)