বর্তমান কেন্দ্রীয় কৃষি বিল কার স্বার্থে?

লেখক
এইচ. এন. মাহাতো

কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার ভোটাভুটিতে পরাজয় জেনেই সংসদের উচ্চকক্ষে কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিল অসৎ উপায়ে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে পাস করিয়ে নিল বিরোধী পক্ষকে কোন প্রকারের আলোচনা করার সুযোগ না দিয়ে৷ এভাবে ধাপ্পা দিয়ে একতরফাভাবে কৃষি ও কর্ষকদের বিরুদ্ধে যে বিল পাস করিয়ে নিল তাহা ব্রিটিশ আমলের  নীলচাষের কথা মনে করিয়ে দিল৷

ভারত একটি কৃষি নির্ভরশীল দেশ৷ এই বিল সারা ভারতে গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত সুপরিকল্পিতভাবে ধবংস করার প্রথম পদক্ষেপ৷ কৃষিকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষের রুটি রুজির সংস্থানের ব্যবস্থা হয়৷ এই বিলের ফলে সেই অবস্থা থেকে কৃষিনির্ভর মানুষ বঞ্চিত হবে৷ যেমন--- ক্ষুদ্র চাষী, বর্গা চাষী, ক্ষেত মজুর, এমনকি বৃহৎ চাষীদের সঙ্গে সঙ্গে চাষাবাদকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের ব্যবসা বা কোনো না কোন কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো যারা তারাও কর্মহীনতা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে পৃথিবী থেকে শেষ হয়ে যাবে৷ বিজেপি সরকারের অর্থনৈতিক ভুল নীতি ও করোনা ভাইরাসের জন্য বৃহৎ শিল্পপতিরা যখন নানাভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে ঠিক তখনই কৃষি ও কর্ষকদের মেরুদণ্ড ভাঙতে ধনকুবেরদের কৃষিক্ষেত্রে অবাধলুণ্ঠনের সুযোগ করে দিতে নতুন করে কৃষিনীতি৷ বিজেপি সরকার বুনিয়াদকে নোটবন্দী, জিএসটি, বড় বড় পুঁজিবাদীদের নেওয়া ব্যাঙ্ক লোন মকুব, নেতা মন্ত্রীদের বিদেশে ভ্রমণের নামে কোটি টাকা খরচ,তাদের জন্য নতুন নতুন গাড়ি, বিদেশী হেলিকপ্ঢার কেনার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ, বিশ্বের প্রথম সারির দেশ তৈরী করা নামে বেহিসেবী খরচ, আরো কত কি খরচ করতে গিয়ে দেশের লাভজনক ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশী ও বিদেশী পুজিবাদীদের কাছে বিক্রী করে ভারত আজ নিঃস্ব রিক্ত  সর্বহারাদেশে পরিণত৷ এই মূহূর্তে একমাত্র  কৃষিক্ষেত্রের  বুনিয়াদটা  কিছুটা হলেও বেঁচে ছিলো৷ তাকেও ধবংস করতে নতুন কৃষিনীতি তৈরীর নামে উদ্ভট বিল এনে গায়ের জোরে সংসদের উচ্চকক্ষে পাস করিয়ে কৃষিনির্ভর ভারতের কৃষির সর্বনাশের পথ তৈরী করল৷ ইতিমধ্যে কর্ষকদের মৃত্যুর লম্বা লাইনে ভরত বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে বসেছে৷ ভারতের কর্ষক মৃত্যুর হার মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা, পঞ্জাব, বিহার, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, রয়েলসীমা আরো কয়েকটি রাজ্য লাগাম ছাড়া৷ কোন ব রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের কাছে এর কোন রকমের সমাধান নেই৷ কেন্দ্রীয় সরকারের উচিৎ ছিলো সবগুলো রাজ্য সরকারের সহমত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া৷ বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকার তৈরী করে দিচ্ছে বললে ভুল হবে, উপঢৌকন দিয়েছেন বহুজাতিক সংস্থার কর্মকর্র্তগণ৷ তাই তাদের কথা মাথায় না রাখলে তো পার্টি বা গদী দুটোই গণেশ উল্টোবে৷ এই ভয়েই হোক বা পুঁজিবাদীর করুনায় দিল্লীশ্বর হয়েছেন তাই তাদের প্রতি অনুকম্পা রাখতে গিয়ে ভারতীয় ঐতিহ্যের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে৷

এই বিলটির সারবর্র্ত্ত হলো কর্ষক জমির মালিক হয়েও তার ইচ্ছে  মত ফলন ফলাতে পারবে না৷ কারণ বহুজাতিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তাদের মর্জি মতন ফসল কর্ষকদের ফলাতে বাধ্য করবে৷ বীজ, সার আনুষঙ্গিক যাহা কিছু লাগবে উক্ত সংস্থার মর্জি মতন কিনতে হবে তাদের নির্দ্ধারিত দামেই৷ কোনকিছু বিক্রয় করতে হবে তাদের  মর্জিতেই৷ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, অতি বৃষ্টি  বা অনাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্থ হলে সংস্থা দায়ী হবে না৷ বহুজাতিক সংস্থাগুলি ফসলের মূল্য নিজেদের ইচ্ছে মত ঠিক করবেন৷ কর্ষকের খরচের  সঙ্গে বিক্রয় মূল্য তফাৎ হলে তাঁরা উক্ত কয়েকটি সংস্থা ছাড়া ফসল বিক্রি করতে পারবে না৷ আজ কিছু কিছু কর্ষক ফসল ঘরে মজুত রেখে দাম অনুযায়ী পরবর্তী অবস্থায় বিক্রি করতে সক্ষম হতো৷ কিন্তু কর্ষক বিল আইনে পরিণত হলে সেটা সম্ভব হবে না৷ কারণ খোলা বাজারও ওই সংস্থাগুলির দ্বারা পরিচালিত হবে৷ যেমন এখন বড় বড় শহরে দেখতে পাই বহিরাগত স্থানীয় কাঁচা মাল নিয়ন্ত্রণ করেন৷ তাই স্থানীয় কর্ষক তাদের কাঁচা মালকে বিক্রয় করতে গেলে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়৷ সেই প্রকার বহুজাতিক সংস্থাগুলি উক্ত বাজারে তাদের প্রতিনিধি ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেবে না৷ এই নতুন নিয়মে আগামী কিছুদিনের মধ্যেই বাজারের সব কিছুই বহুজাতিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে আসা মাত্রই ক্ষুদ্র, মধ্যবিত্ত ব্যবসায় জড়িত সকলে পথে বসতে বাধ্য হবে৷ আগামীতে এর পরিণতি হাজার হাজার কর্ষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবে অথবা কৃষি ভূমি থেকে মুক্তি পেতে ওই বহুজাতিক  সংস্থার কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হবে৷ কর্ষকদের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছে যেমন শেষ হয়ে যাবে, তেমনি তার পরবর্তী প্রজন্মকে একটি অন্ধকার জগতের দিকে  ঠেলে দেবে৷ বর্তমান বিলে বাজারের কৃষিজাত পণ্যের ক্রয় ও বিক্রয় বহুজাতিক সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে৷ এর দরুণ নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্ণের মানুষের বাজারের পণ্য ক্রয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না৷

আজকের বিজেপি সরকারের নতুন কৃষি সম্পর্কে যে বিল পাস হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ স্থানীয় কর্ষক কুলের ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে স্থানীয় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের হতে আপাতত দৃষ্টিতে চলে গেলেও আগামীতে স্থানীয় বহুজাতিক সংস্থার শেয়ারের বাজারমূল্য বাড়তে থাকবে৷ পরবর্তী পর্যায়ে বহিরাগত বা বিদেশী বহুজাতিক সংস্থাগুলো সেই শেয়ারগুলি কেনা বেচা করতে করতে পুরোপুরি বিদেশী নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে৷ ভারতের নাগরিক রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিকভাবে বিদেশীদের নিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য হবে৷ অর্র্থৎ ব্রিটিশ আমলের  নীল চাষের মতো আমরাও কী বিদেশীদের হাতের পুতুল হয়ে যাবে৷

এই অশনি সংকেত থেকে মুক্তি পেতে হলে বা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ঐতিহ্যকে বাঁচাতে গেলে সকল ভারতীয়কে একটাই মূলমন্ত্র নিতে হবে তা হলো শোষণমুক্ত মানবসমাজ গড়া৷ আর এই শোষণমুক্ত মানব সমাজ গড়তে হলে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে সামনে রেখে তাঁর সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন ‘প্রাউট’ বা প্রগতিশীল উপযোগী তত্ত্বকে সামনে আনতে হবে৷ তিনি বলেছেন ‘আঞ্চলিকতার শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদে প্রতিষ্ঠা৷

তিনি আরো বলেছেন ‘নীতিবাদের স্ফুরণ থেকে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা তার মাঝে যে অবস্থান তাকেই বলব সমাজ৷ আর এই সমাজকে নেতৃত্ব দিতে হলে, যম ও নিয়মে--- এ প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে৷ তৎসহ সেই নেতৃত্বকে অন্তর্মুখী সাধনার সঙ্গে  শারীরিক সুস্থতার, মানসিক বিকাশ ও আত্মিক জগতে আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বৈকতাবাদের ভাবনা৷ সেখানে সৃষ্টির সবকিছুকে দেখার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন করে মানবিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করে সমাজ জীবনকে নব্য মানবতায় প্রতিষ্ঠা করা৷

ভারতের মাটিতে কৃষি ও কর্ষকদের বাঁচাতে স্বদেশী বা বিদেশী পুজিবাদী বা বহুজাতিক সংস্থার প্রয়োজন নেই৷

সরকারের দরকার কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া, প্রতি ইঞ্চি জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করা, কৃষি জমিতে শিল্পক্ষেত্রে তৈরী না করা৷ কর্ষকদের শারীরিক সুস্থতা, মানসিক বিকাশ ও আধ্যাত্মিক উন্নত করতে সাহায্য করা৷ কর্ষকদের উন্নত বীজ, সার ও আনুষাঙ্গিক স্বল্প মূল্য সরবরাহ করা৷

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝড়-ঝঞ্চা, বন্যা  বা খরায় কর্ষকেরা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তার ব্যবস্থা নেওয়া৷

কর্ষকদের স্বাধীনভাবে রক্ষা করতে হলে স্থানীয়দের নিয়ে সমবায় প্রথাকে সামনে রেখে, উৎপাদক সমবায়, তৈরী করে জমির মালিকানা ঠিক রেখে জমির মধ্যবর্তী আল বা বাউন্ডারি ভেঙে বৃহৎ প্লট তৈরী  করে জমির পরিমাণ বাড়ালে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ও খরচ কম করে আয় বাড়িয়ে তোলা৷ অন্যদিকে উৎপাদন সামগ্রী তৎক্ষণাৎ বিক্রি না করে উপভোক্তা সমবায়ের মাধ্যমে গুদাম জাত করলে কর্ষকরা বেশী লাভবান হবে৷ কর্ষকদের তৎকালীন সাহায্যের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে মিনিমাম গ্যারান্টির ব্যবস্থা করা৷ এরজন্য  স্থানীয় সরকারকে নজর দিয়ে সাহায্যের হাত এগিয়ে  দেওয়া৷ সমবায় যাদের মাধ্যমে তৈরী হবে সেই নেতৃত্বকে আধ্যাত্মিক উন্নত করতে যম ও নিয়মে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে তৎসহ অন্তত নিহিত ধর্মবোধের ও সেবার ভাবনা বাধ্যতামূলক৷

কর্ষকদের বাঁচাতে---কৃষিভিত্তিক শিল্প ও কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সাথে সাথে জনগণেরে ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর নজর দেওয়া৷

দেশকে আর্থিক উন্নত  ও শ্রেষ্ঠত্বের  শিখরে পৌঁছোতে হলে কৃষিক্ষেত্রে  সৃজনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে আরো মজবুত করতে সাহায্য করা৷