বৎসর, নব বৎসর, তুমি কল্যাণ এনো চারিদিকে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

২০২০ পেরিয়ে ২০২১-এ পা দিলুম৷ শুভ আন্তর্জাতিক নববর্ষে সবাইকে জানাই প্রীতি ও শুভেচ্ছা, আর  প্রভাত সঙ্গীতের ভাষাতেই বলি, বৎসর,নব বৎসর, তুমি কল্যাণ এনো চারিদিকে৷

নোতুন বছরে নোতুন উদ্যম নিয়ে, নোতুন করে সংকল্প নিয়ে সবাইকে যাত্রা শুরু করতে হবে৷ পুরানো বছরের ক্লান্তি ভুলে নোতুন উৎসাহ নিয়ে, নোতুন করে পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের এগুতে হবে৷ তার আগে আমাদের আত্মসমীক্ষা করতে হবে৷ আরও ভালভাবে এগিয়ে চলার জন্যেই এই আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন৷ আসুন আমরা সেই আত্মসমীক্ষা করি৷

প্রথমে ব্যষ্টিগত জীবনে৷Be and make নিজে তৈরী হও, তারপর কিছু তৈরী কর৷ আমরা মানুষ৷ মানুষ আমাদের কাছ থেকে  অনেক কিছু আশা করে৷ প্রভাত সঙ্গীতে বলা হয়েছে, ‘‘মানুষ যেন মানুষের তরে সবকিছু করে যায়’’৷ এই যে কিছু করা, এর আগে নিজেকে তৈরী  করতে হবে৷

আমাদের মনে রাখতে হবে, মানবজীবন ত্রিস্তরীয়৷ শরীর,মন, আত্মা--- এইটাই হ’ল ত্রিস্তর৷ ভৌতিক, মানসিক  আধ্যাত্মিক জগৎ--- এই হ’ল ত্রিভুবন৷ স্বর্গ, মর্ত্য , পাতাল--- এটা কাল্পনিক৷ ‘‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহু দূর৷ মানুষেরই মাঝে স্বর্গনরক মানুষেতে সুরাসুর৷৷’’

মানুষই নিজ প্রচেষ্টার দ্বারা দেবতা হয়, মনুষ্যত্বের বিকাশই দেবত্ব, আর দেবত্বের পূর্ণবিকাশ হ’ল ব্রহ্মত্ব৷ আমরা মানুষ, আমাদের মনুষ্যত্বের পূর্ণবিকাশ ঘটাতে হবে৷ আমাদের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা আছে, প্রতিটি সিদ্ধ মহাপুরুষ আমাদের একথা শুনিয়েছেন৷ কেবল তাঁদের উপদেশ পড়ে মুখস্ত করলেই চলবে না, তাকে কার্যে পরিণত করতে হবে৷

মনে রাখতে হবে, ভাল কাজ বা মন্দ কাজ করে মন, এই মনকে যদি ভাল করে গড়ে নেওয়া যায়, তাহলে মানুষ পৃথিবীতে মহান কাজ করে যেতে পারবে৷ সে তার জীবনকে পূর্ণ বিকশিত করে  সার্থক করে যেতে পারবে৷

কীভাবে করবে ? জগদ্দগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘কর্মই মানুষকে মহান্‌ করে তোলে৷  সাধনার দ্বারা, সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা মহান্‌ হও৷’’ এটা কেবল মুখস্ত করার জন্যে নয়, একটা কার্যে পরিণত করতে হবে৷ হাজারো ভাল উপদেশ মুখস্ত করার চেয়ে একটা ভাল উপদেশ জীবনে কার্যান্বিত করাটাই সবচেয়ে বড় কথা৷

এই বাণীতে বলা হয়েছে, প্রথমে সাধনা প্রয়োজন৷ সাধনা কী? এই যে মনের কথা বললাম--- এই মনে দুটো দিক রয়েছে৷ ‘সু’ ও ‘কু’---ভাল ও মন্দ৷ মনের ভাল দিকটাকে--- ভাল চিন্তা---ভাল সংকল্প ---এগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে৷ আর মন্দ দিকগুলো---মনে যে সব চিন্তা আমাদের  অধোগামী করে, আমার জীবনের প্রগতির পথে অন্তরায় সেই মন্দভাবগুলিকে সংযত করতে হবে৷ আত্মসংযম জীবনে খুব বেশী প্রয়োজন৷ আগুনের বিরাট শক্তি৷ এই আগুনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এ দিয়ে আমরা বহু কিছু ভাল কাজ করতে  পারব, কিন্তু এই আগুন যদি আমার নিয়ন্ত্রণে না থাকে,তাহলে এ আগুন সর্বনাশ ঘটাতে পারে৷

তাই মনকে সংযত করতে হবে, মনের চিন্তাকে সংযত করতে হবে৷ মনের চঞ্চলতা, অস্থিরতা দূর করতে হবে৷ মনের একাগ্রতা অর্জন করতে হবে৷ শুভভাবনা, ব্রাহ্মী ভাবনার সঙ্গে মনকে সংযুক্ত করতে হবে৷ ‘‘বলা হয়ে থাকে, ‘As you think, so you become’’--- তুমি যেমন চিন্তা করবে, তেমনি হবে৷ তাই মনে সদা শুভভাবনা থাকলে মনও পবিত্র হবে, কলুষতামুক্ত হবে, দূষণমুক্ত হবে৷ আমরা পরিবেশ দূষণ নিয়ে বড় বড় ভাষণ দিই বা ভাষণ শুনি, সামাজিক দূষণ নিয়ে গবেষণা করি, তত্ত্বলিখি, কিন্তু এসবের আগে দরকার মানসিক  দূষণ দূর করা৷ মানসিক দূষণ দূর না করলে বড় বড় তত্ত্ব, বড় বড় পরিকল্পনায় কোনো কাজ হবে না৷ সবটাই ফাঁকিতে পরিণত হবে৷

এবার একটু Practical কথা বলি৷ আপনি বলবেন, মানসিক দূষণ দূর করা তো থিওরিটিক্যাল ব্যাপার, কীভাবে দূর করব৷ এজন্যে বনে বাদাড়ে হাতড়ালে চলবে না৷ আলু ব্যাপারীর কাছে পুস্তক খুঁজতে গেলে কোনো কাজ হবে না৷ মনকে সংযত করতে চান, মনের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করতে চান, তাহলে এই মন ও আত্মা সম্পর্কীয় যে বিজ্ঞান--- এই অধ্যাত্মবিজ্ঞানীদের পরামর্শ বা উপদেশ নিতে হবে৷ ‘বায়োলজি’র প্রফেসরের কাছে নয়, ‘বায়োসাইকোলজি’ অর্থাৎ জৈবমনোবিজ্ঞানের  বিশেষজ্ঞর কাছে যেতে হবে৷ ‘‘জৈব মনোবিজ্ঞান’ কী? শরীর, মন ও আত্মার বিজ্ঞান৷ এ ব্যাপারে যাঁরা বিশেষজ্ঞ এঁরাই অধ্যাত্মবিজ্ঞানী৷ আত্মা হচ্ছে মনে সুউচ্চ-স্তরের অনুভূতি৷

‘যোগসাধনা’ হচ্ছে অধ্যাত্মবিজ্ঞান৷ সচরাচর ‘যোগ’ বা ‘যোগা’ বলতে লোকে কেবল নানারকম যোগাসন করাকে বোঝেন৷ রোগ নিরাময়ের জন্যে যোগাভ্যাস৷ যোগ বলতে কেবল শরীরকে সুস্থ রাখার জন্যে আসন অভ্যাস করা নয়, পক্ষান্তরে শরীর, মন আত্মা নিয়ে যে আমাদের সমগ্র জীবন এই সমগ্র জীবনকে সুস্থ ও সুন্দর করার জন্যেই যোগ বা অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনা--- যার মধ্যে যম-নিয়ম, আসন,  প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা ধ্যান প্রভৃতির কথা বলা হয়েছে৷

আসনের পাশাপাশি মেডিটেশনও করতে হবে, শরীরের চক্রশোধনও গ্রন্থিশোধণ ও করতে হবে৷ তার পাশাপাশি আমাদের আচরণকেও সুন্দর সুনিয়ন্ত্রিত করতে হবে (তাই বলা হয়েছে ‘যম-নিয়মে’)৷ এ যে পুরোপুরি প্র্যাকটিক্যাল-বৈবহারিক৷

‘প্র্যাক্টিস মেকস্‌ এ ম্যান পারফেক্ট’৷ এ জন্যে উপযুক্ত  শিক্ষকের সাহায্য নিতে হবে৷

এতক্ষণ বললাম, নিজেকে তৈরীর করার কথা৷ অনেকে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ---এসব গুরুতর সমস্যার আলোচনা করতে বসে আধ্যাত্মিক আলোচনাকে অর্থহীন ভাবেন৷ তাদের বলি, আজকে সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী বলুন তো! আমি তো বলি ‘দুর্নীতি’৷  দুর্নীতি ? সমস্ত সমাজব্যবস্থাকে ফোঁপরা করে  দিয়েছে৷ এরোগ  করোনার চেয়ে সংক্রামক ক্যানসারের চেয়ে মারাত্মক৷ দার্শনিক তাত্ত্বিক, বিশেষজ্ঞ, নেতা-নেত্রী--- সবার মুখনিসৃত অমৃতবাণী গরল হয়ে দেখা দিচ্ছে--- এই দুর্নীতির কারণে৷ এই দুর্নীতির কারণে একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে  বলতে হয় কেন্দ্র জনসাধারণের জন্যে ষোল আনা বরাদ্দ করলে, জনসাধারণের কাছে পৌঁছে এক আনা৷ এই দুর্নীতির কারণেই যত্রতত্র বলতে শোনা যায় ‘যেই যায় লংকায় সেই হয় রাবণ৷’ আমাদের দেশের  বিশাল বিশাল কারখানায় বা বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কত কিছু না তৈরী করা হয়, কিন্তু আজ মানুষ গড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই, কোনো প্রকল্পও নেই৷ মূল সমস্যাটা কিন্তু এটাই৷ তাই আজকের সমস্যার সমাধানের জন্যে চাই- ‘‘নোতুন মানুষ ও নোতুন পরিকল্পনা’’ New man and New Plan) দুটোই৷

হ্যাঁ, এবার পরিকল্পনা সম্পর্কে দু-চারটা কথা বলি৷ এটা কারও অজানা নয়, যে বর্তমানে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুটো তত্ত্ব কাজ করছে৷ একটা ধনতান্ত্রিক সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অপরটা মাক্‌স্‌বাদী ব্যবস্থা৷ আজ মোটামুটি গোটা পৃথিবী জুড়ে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে, কিন্তু সর্বত্র দেখা যাচ্ছে সমাজে সমস্ত সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের ভাণ্ডারে৷

যদিও জগতের কোনো সম্পদের প্রকৃত মালিক ওইসব পুঁজিপতিরা নয়৷ এই সমস্ত সম্পদের মালিক তিনিই--- যিনি এই সম্পদের স্রষ্টা৷ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ তাঁরই সন্তান৷ তাই বিশ্বের সমস্ত সম্পদে প্রতিটি মানুষেরই অধিকার রয়েছে৷

প্রাউট-প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন৷ ‘‘এ বিশ্বজগৎ আমাদের সকলের পৈত্রিক সম্পত্তি৷ আমরা সকলে এক বিশ্বভিত্তিক যৌথ পরিবারের সদস্য৷ পরমপুরুষ আমাদের পিতা৷ যৌথ পরিবারের সদস্যদের মতই আমাদের উচিত সবাই ‘নিজে বাঁচ ও অপরকে বাঁচাও’ এই নীতি নিয়ে চলা৷ কিন্তু আজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়, একদিকে  মুষ্টিমেয় মানুষ বিপুল সম্পদ সঞ্চয় করে বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে কোটি কোটি দরিদ্র-বেকার মানুষ জীবনের ন্যূনতম চাহিদা জোটাতে না পেরে শুকিয়ে মরছে বা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে৷

এ ব্যবস্থা মেনে নিতে পারা যায় না৷ কোনো বিবেকবান মানুষের উচিত নয় এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া৷

অপরদিকে, মার্কসবাদও ত্রুটিপূর্ণ দর্শনের কারণে সর্বত্র প্রত্যাখ্যাত৷ যে সমস্ত দেশে বলা হচ্ছে কম্যুনিষ্ট সরকার, আসলে একদলীয় সরকার  রয়েছে (তাতে শাসকদলের সুবিধা), কিন্তু অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রে সেই পুঁজিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ৷ ওই সব দেশে প্রকৃতপক্ষে জনসাধারণের শোষণমুক্তি ঘটেনি৷

তাই মহান্‌ দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার দিয়েছেন, নোতুন যুগের জন্যে নোতুন দর্শন---‘প্রাউট’---যাতে রয়েছে ‘নোতুন মানুষ’ তৈরীর ব্যবস্থার সঙ্গে  সঙ্গে সর্বাত্মক শোষণমুক্ত পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা৷ সেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলে থেমে থাকা হয়নি বলা হয়েছে জনগণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তথা অর্থনৈতিক  গণতন্ত্রের গ্যারান্টী৷ এখানে রয়েছে, জাত-পাত-সম্প্রদায়ের সমস্ত প্রাচীর ভেঙ্গে সর্বমানব সহ সমস্ত জীবকে পরমাত্মার  বিকাশ হিসেবে ভেবে সবার  কল্যাণের ব্যবস্থা--- এক কথায়  নব্যমানবতাবাদের প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি৷