ভারত-সরকার ও ভারতবাসী

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

২৬শে জানুয়ারী দিনটি আমাদের জাতীয় সরকার খুবই ঘটা  করে প্রতি বছর ‘রিপাবলিক ডে’ তথা ‘‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ -রূপে পালন করে আসছেন৷ এবারেও যথারীতি পালিত হয়েছে৷ সারা বছরে পনের আগষ্টে ‘স্বাধীনতা দিবস’ আর ছাবিবশে জানুয়ারীতে ‘‘প্রজাতন্ত্র দিবস’--- এ দু’টো দিনই তামাম ভারতবাসীর জনমানসে অতি স্মরণীয় দিবস--- তবে পরিস্থিতি নিরিখে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ভারতে গেলে মননশীলতা ও বিচার-বিবেচনায় খুবই হোঁচট খেতে হয় অতি স্বাভাবিক কতিপয় কারণে৷ এর কারণ খুঁজতে গিয়েই এই নিবন্ধটির অবতারণা৷ কারণসমূহ একে একে তুলে ধরাই নিবন্ধকারের মূল উদ্দেশ্য৷ আশা রাখছি,এ আলোচনা থেকে কিঞ্চিৎমাত্রায় হলেও আঁচ পাওয়া যাবে, আমাদের দেশ বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভারত যুক্তরাষ্ট্র কোন্‌ দিশা নিয়ে আর কোন্‌ লক্ষ্যের  পানে এগিয়ে চলেছে৷ বলতে মোটেই দ্বিধা নেই যে ভারতবর্ষের সুখ-সুবিধা-সুযোগ স্বার্থোদ্ধার ইত্যাদি দেশীয় পুঁজিপতিদেরই কুক্ষিগত রয়েছে৷  উচ্চনিনাদে সরকারী  ঘোষণা প্রচারণা  সবই যে ধোঁকাবাজি ও ভণ্ডামি--- তারও আভাস ফুটে উঠছে বলে প্রমাণও রয়েছে৷ আরও আশা রইল, যাঁরা প্রকৃত অর্থেই দেশ, তথা দেশবাসীকে ভালবাসেন, দেশ ও দেশবাসীর সর্র্বেপরি মানবতার কল্যাণ কামনা  করেন, তাঁদের পক্ষেও বুঝে নেওয়া সহজতর হয়ে উঠবে--- সেইসব কামনা ও  প্রত্যাশা ইত্যাদি পূরণ হবার পথে আসল দুষমণ কোথায় মুখোশ পরা অবস্থায় যাবতীয় ঠগবাজির প্লান ও প্রজেক্ট তৈরী করছেন৷

প্রথমেই তুলে ধরছি, আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ ভারতের আপামর জনগণকে কোন্‌ দৃষ্টিতে দেখেন সে বিষয়ে৷ পনের আগষ্টে দেশে স্বাধীনতা দিবসের রাষ্ট্রীয় ত্যোহার উৎসব উদ্‌যাপিত হয়৷ প্রকাশ্যে এর অবমাননা দেখালে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে দণ্ডনীয় অপরাধ হবে৷ কিন্তু, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আঠারোর্ধ বয়সে শুধু বোট প্রদান করা ছাড়া রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধীনতা আর কী  বা কতটুকু ভোগ করতে পারছেন---দরিদ্র, দলিত, নিরক্ষর, তথাকথিত তপশীলী জাতি--- উপজাতি ভারতবাসীরা? এখন তো দেখা যাচ্ছে প্রাপ্ত-বয়স্কদের সেই বোটাধিকারও কেড়ে নিয়েছেন বর্তমানে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷ বিগত দিনে একাধিকবার বোট দিয়ে রাজ্যে ও কেন্দ্রীয় স্তরে সরকার, মন্ত্রী, বিধায়ক বা সাংসদ বানানোর পরেও তাদের নাগরিকত্ব স্বীকৃতি পাচ্ছে না এমন হতভাগাদের মরণ-যন্ত্রণা ভুগতে হচ্ছে ডিটেনশনক্যাম্পে ‘ডি-বোটার’ তথা ‘অনুপ্রবেশকারী’ তথাবাংলাদেশী খেতাব পেয়ে (উদাহরণ---অসম রাজ্য)৷ আবার, বাঙালীদের উদ্দেশ্যে করেই হুমকি-ধমকি শোণানো হচ্ছে এন.আর.সি, সি.এ.এ ‘নাগরিকত্ব আইন’ ইত্যাদির রীতিমত ভয় দেখিয়ে৷ বলা হচ্ছে এন.আর.সি সারাদেশেই হবে, তবে কার্যত এখন অব্দি শুধু অসমেই হয়েছে আর আগামীতে হয়তো---ত্রিপুরা, মেঘালয়, মনিপুর  ও পশ্চিম বাঙলাতেই হবার ১০০শতাংশ আশংকা রয়েছে, যেহেতু অঞ্চলগুলো বাঙালী প্রধান৷ কার্যক্ষেত্রেই প্রমাণ মিলে যাবে৷

পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ হাতছাড়া হয়ে গেলে তাতে কেন্দ্রের মাথা ব্যাথার লক্ষণ দেখা যায় নি৷ আম্ফান-সাইক্লোনে পশ্চিমবঙ্গ তছ্‌নছ হয়ে গেলেও ভারত-প্রেমিক -প্রেমিকারা  এসে প্রয়োজনের তুলনায় মরুভূমিতে গণ্ডুষমাত্র জল সিঞ্চন করেই হাত গুটিয়ে নিলেন৷ মোদিজী সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল প্রতিবছরে  দু’কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে৷ হয়নি কিছুই সেই অনুসারে৷ শিক্ষিত বেকারের সামনে সমগ্র ভারতেই অমাবস্যার ঘন অন্ধকার বিরাজ করছে৷ মোদ্দা কথাটা হল,অর্থনৈতিক স্বাধীনতা’ ব্যতিরেক ‘পলিটিক্যাল লিবার্টি’ কখনও স্বাধীনতা তথা ফ্রীডম কথাটির তাৎপর্যপূর্ণ বজায় রাখতে পারে না৷ অথচ  ১৯৪৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার এই সূক্ষ্মতর  প্রতারণা ও ভ্রষ্টাচার নির্বিবাদে চালিয়ে যাচ্ছেন৷

তারপর আসছে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’-টিরও কথা৷ ব্রিটিশের মস্তিষ্ক দিয়ে সংবিধানে রঙ লাগাতে গিয়েই সম্ভবতঃ ‘প্রজাতন্ত্র’ কথাটি সংবিধানে প্রবেশলাভ করেছিল৷ এখানে প্রশ্ণ---একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক তথা ‘সমাজতন্ত্রের ধাঁচে গণতান্ত্রিক’ যদিও বা ধরা হয়, তথাপি ‘‘প্রজা’’ বলতে কাদেরে বোঝানো হচ্ছে আর কে বা কারা তবে এদেশে ‘‘রাজা’’ রয়েছেন? রাজার অস্তিত্বের স্বীকৃতি না থাকা সত্তে ‘‘প্রজার’’ স্বীকারোক্তি থাকার পেছনে কী যুক্তি বা কোন দৃষ্টিভঙ্গী কোন লক্ষ্যের দিকে ভারত এগুচ্ছে--- এসব প্রশ্ণটি উড়িয়ে দিলে চলবে?

দেশনেতা-নেত্রীরা বলে থাকেন---‘একদেশ,একরাষ্ট্র,একজাতি, একপ্রাণ ইত্যাদি৷ তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে---(ক) দেশে জাতিভেদ, জাত-পাতের বিভেদ ও বিবাদ রয়েছে কেন? (খ) জাত-বিচারের ভিত্তিতে, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে সংরক্ষণশীলতা মানা হচ্ছে কোন লক্ষ্যে পৌঁছুতে? (গ) এখনও ভারতের বিভিন্ন মঠ-মন্দির বা তীর্থস্থান সমূহে হিন্দু-ধর্মমতানুসারে (রেলিজিয়ন) ব্রাহ্মণদেরই উপরে প্রাধান্য অর্পিত রয়েছে কেন? পুরোহিতদের নিয়োগের ব্যাপারেও আগম শাস্ত্রবিধিমতে প্রাচীন ঐতিহ্যধারা বজায় রেখেই মাননীয় রঞ্জন গগৈ ও মাননীয় এন.ভি, রমানান--- বিচারক-দ্বয়-কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষিত হয়েছিল কেন? সেইক্ষেত্রে সংবিধানের সেক্যুলারিজম কোথায় উবে গেল?

ইতিহাসই আরও সাক্ষ্যবহন করে চলেছে যে, ভারতে রাজনৈতিক আর আমলাতান্ত্রিক দাপটের প্রাধান্য এখনও উচ্চবর্ণের হাতেই কুক্ষিগত৷ ভারতের শিল্প কারখানার  এক চেটিয়া মালিকানা এখনও আম্বানী,আদানী, মিত্তাল, বাজাজ প্রমুখদের কুক্ষিগত কেন? এতসব ‘একচোখা নীতি’-র পরিদৃশ্যমান নজীর গুলো উপেক্ষা করে তবুও বলতে হবে---‘‘অচ্ছা ভারতের সদাশ্রয়ী পরিচালক গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গী সত্যিই স্বচ্ছ? শুধু লম্বা ঝাড়ু দিয়ে রাজপথে লোক দেখানো ‘প্রদর্শনী’র আয়োজনে অল্পসংখ্যক বেওকুফদের চোখে তাক-লাগানো সম্ভব হলেও  তামাম বিশ্ববাসীর চোখে দেশ-চালকদের অন্তরে লুকোনো কদর্যতা বুঝতে কিন্তু বাকী নেই৷

আসন্ন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রাকমূহূর্তে পঃবাঙলার  কিছু দলছুটদের নিয়ে ‘‘সোনার বাঙলা’’ গড়ে তোলার ব্যাণ্ড-পার্টি দিল্লী কাঁপিয়ে আর ঘন ঘন পশ্চিমবাঙলার নানা প্রান্তে গাড়ী ছুটিয়ে ঘুরলেই (জানি, সত্যিকারে গাড়ীর  খরচের যোগানদার কে বা কারা) যে পশ্চিম বাঙলার মানুষজন ‘‘বাঙালী জাতির দুষমনদের’’ চিনতে ভুল করবেন না তাও বোধহয়, হিন্দী-বলয়ের সাম্রাজ্যবাদের শোষক বানিয়ারা সম্যক  বুঝতে পেরেই ২০২১-২২ অর্থবর্ষের বাজেটে পশ্চিমবাঙলাকে জবরদস্ত মার দিতে পরিকল্পনা নিয়েছেন৷ মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, আপনারা রূপ বদল করে ভোল পালটিয়ে, সঙ সেজে ভড়ং দেখিয়ে যতই দেখান--- ‘তা নানা’ ভবী কিছুতেই ভুলবে না, কেননা আপনারা বহুদিনের পুরানা--- তাই ঠোঁট নাড়লেই আপনাদের ভেতর যায় চেনা৷ তাই, অনেকেরই মন কী বাত জী জাঁহাপনা শুনতে পাচ্ছেন না, --- জরা সমঝকে চল্‌না ঝুম্‌লাবাজি ঔর মৎ দিখানা৷

আরও বলতে বাধ্য হচ্ছি, অনেকেই বর্তমান দিল্লীশ্বরদের মর্জিমাফিক খেয়ালখুশীপনাকে ---যেমন, বিমুদ্রাকরণ বা টাকার মত অপকর্মকে মহম্মদ-বিন-তুঘলকীপনা বলেই ভাবতে পারেন৷ কিন্তু, বর্তমানে এই ইন্টারনেটের যুগে বিমুদ্রাকরণ---ব্যাপারখানা যে নেহাৎ তুঘলকীপনা অথবা কালোটাকা উদ্ধারের সদিচ্ছা প্রসূত পরিকল্পনা ছিল না, বরং এর পরিবর্তে দেশীয় কালোবাজারী তথা কালেটাকার মালিকদের তোফাদানেরই পরিকল্পনা ছিল, তাও ক্রমশঃ প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে৷ অর্থাৎ নোট অচল করার নামেই কালোটাকা ব্যাংকে জমা করিয়ে পরিবর্তে ‘‘শাদা বানিয়ে নেওয়া হয়েছে৷

মোদিজীর বিগত ৬ বছরে বহুবার পেট্রল ডিজেলে অন্তঃশুল্ক বাড়িয়ে (বলা হয়েছে তেল-সরবরাহকারীদের ভর্তুকি দিয়ে নাকি ক্ষতি পুষিয়ে রাখা হয়) জ্বালানীর মূল্যস্তর প্রায় দ্বিগুন হয়েছে৷ এরফলে নীট মুনাফার  পরিমান দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকা৷ এই টাকা কোথায় কীভাবে  সদ্ব্যবহার করা হয়েছে, জানি না ভারতবাসী এসবের কিছু জানেন কিনা!কারণ , আন্না হাজারে জী আর রামদেব জীর মত বাবাজীরা এখন গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন৷ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যস্তরের হ্রাস ঘটলেও ভারতবাসীর কপাল পেট্রল আর ডিজেলের উত্তাপে এখনও  পুড়েই চলেছে৷ নেপালে যে ক্ষেত্রে পেট্রল/ডিজেলের  লিটার প্রতি মূল্য ৫৩ টাকা আর শ্রীলঙ্কায় ৫১ টাকা, সেক্ষেত্রে ভারতে ৯২ টাকা৷ রাম-রাজত্বের মহতীকৃপা৷

জীবনবীমা, রেলওয়ে, সড়কপথ, অসামরিক বিমান ইত্যাদি সহ, শিক্ষা ও আরো অন্যান্য পরিষেবামূলক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে যখন  প্রাইবেটাজেশনের পথে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি বিদেশী মালিকানার হাতে তুলে দেবার প্রবণতা জেগে উঠেছে, সম্প্রতি কৃষি-আইন করে কৃষি-খাতের মুনাফা পুঁজিপতিদের  পকেটে চালান দেবার মানসিকতা এতটাই জোর পাচ্ছে, তাহলে যদি ‘পার্র্লমেন্ট-টাকেও’ নদী-পারাপার বা পশুরাখার খোঁয়াড়ের মত লীজ দেবার ব্যবস্থা করা যায় তাতেও পুঁজিপতিদের মুনাফা-বৃদ্ধির পথ সুগম হতে পারে বলে ইদানীং নির্বুদ্ধিমানদের মুখে মুখে শোণা যাচ্ছে৷

আর তা-ই যদি হয়, তাহলে একবার ভাবুন, ফাঁসিতে ঝুলে, দ্বীপান্তর-বাসে নির্বাসিত হয়ে, ব্রিটিশদের বুলেটে বিদ্ধ হয়ে জেলের অন্ধকারে গলে-পঁচে তিলে তিলে ধুঁকে আর অবর্ণনীয় ক্লেশ বরণ করে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কী প্রয়োজন ছিল--- শোষক ও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ হটাবার? ব্রিটিশদের রাজত্ব কায়েম থাকলে তো দেশের মানুষদের অন্ততঃ চুলাই মদের পরিবর্তে অঢেল পরিমানেই ‘ফরেন লিকার’ মিলতে পারত৷