ভারতবাসীর মোহ নাশ ঘটবে কবে?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

(পূর্বেপ্রকাশিতের পর)

বর্তমান ভারতে আমরা কেমন পরিস্থিতিতে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, এর কিঞ্চিৎ আভাস ফুটিয়ে তুলতে ক্ষুদ্র প্রয়াস নিচ্ছি৷ তবে, তারও  পূর্বে বলে নেওয়া ভাল (এমনটা না বলে সঙ্গত কারণেই বলা সমীচীন মনে করছি) যে, --- বর্তমানের এই দুর্বৃত্তপনা কেবল আজকের বোনা ফসল ঘরে এল তা কিন্তু নয়--- ১৯৪৭-এর সময় থেকেই সেই চাষাবাদ শুরু হয়েছিল এখন যার বনেদীয়ানা এলমাত্র৷ নীচে এ মর্মে কতিপয় তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপিত করছি ঃ---

বিগত ১৯৯০ সালের স্বাধীনতা দিবসের প্রাকসন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ব্যক্ত করেছিলেন, সেই আইডিয়াটি হচ্ছে--- সত্যটা প্রকাশ করতে হলে আমাকে বলতেই হচ্ছে যে বিজ্ঞানের অগ্রগতিসহ আমাদের জাগতিক ক্ষেত্রে উন্নতিলাভের তালিকাটি রীতিমত দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার  নিরিখে দেখতে গেলে  নৈতিক ক্ষেত্রে ঘাটতির কথাটা স্বীকার করতেই হবে৷ রাষ্ট্রপতি মিঃ বেঙ্কটরমন-কোন  রাখ ঢাক না রেখেই বাস্তবচিত্রটা তুলে ধরে সেদিন বলেছিলেন যে,দেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ লোকই অভুক্তি ও অপুষ্টিতে দুর্র্ভেগ পাচ্ছিলেন৷ তিনি আরও বলেছিলেন যে ধনী ও দরিদ্র, শহরবাসী আর গ্রাম বাসিন্দা, শিক্ষিত মানুষ আর নিরক্ষরদের মধ্যে রয়ে গেছে বিপুল আকাশ পাতাল তফাৎ৷ শহরাঞ্চল কিংবা পল্লীগ্রামের পথশিশুরা, এমনকি আমাদের দেশবাসীদের বুভুক্ষু, অসহায় অজ্ঞ, নীরীহ জনগণ রয়ে গেছেন দেশের সমৃদ্ধি রেখার গণ্ডীর বাইরে৷ আমরা চোখ মেলে তাকাতে  গেলেই দেখতে পাই, আমাদের বায়ুমণ্ডল ভারী হয়ে রয়েছে নানারকমের  বৈষম্যের নিদারুণ হাহাকারে ধনিকশ্রেণীর  দুর্দম শোষণে  দরিদ্র অসহায়েরা দুঃসহ -যন্ত্রণায় কাতর সংখ্যাধিক্যদের  দাপটে অস্থির জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন সংখ্যালঘুরাদেশের একাংশ অধিবাসীদেরই দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছেন দেশভাগজনিত কারণে ছিন্নমূলেরা, শহরে সম্ভ্রান্ত আর একশ্রেণীর মুনাফাখোরদের  দ্বারা দেশের অন্নদাতা কর্ষককূল পশ্চাদপদ দলিত ও জনজাতি গোষ্ঠীভুক্তরা সমাজের তথাকথিত সভ্য মানুষদের দ্বারা৷ খুবই দুভার্গ্যের বিষয় যে , জাত পাত বর্ণ-বৈষম্য, ধর্মমতের গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা ও গোষ্ঠী বিভাজন ইত্যাদি নিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ কামিতাই প্রশ্রয় পাচ্ছে কিন্তু মানুষে মানুষে যে সৌভাতৃত্ববোধ থাকার কথা সেটা গৌণ  হয়ে দাঁড়াচ্ছে, ইত্যাদি৷ এখন প্রশ্ণ থেকে যাচ্ছে সেই দিনটা থেকে একত্রিশ বছর পেরিয়ে এসে আজও কি ভারতবাসী হিসেবে আমরা নিজেদের চুল পরিমাণও বদলাতে পেরেছি? আশাকরি, বিবেকবান ও বিচারশীল  ব্যষ্টিমাত্রেই আমার সঙ্গে  সহমত পোষণ করতে সম্মত হতে পারবেন৷  আমি তো মনে করছি যে,---না, আমরা বিগত এই আড়াই দশকে আরও, আরও পেছিয়েই পড়েছি৷

আসুন তাহলে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিটার মোটামুটি একটা সালতামামি নেওয়া যাক৷ পত্র-পত্রিকার ইত্যাদি সংবাদ মাধ্যমে যে সব তথ্য বিবরণ প্রকাশ পাচ্ছে, তা থেকেই আহরণ করে যৎকিঞ্চিৎ এখানে সন্নিবেশিত করছিঃ---সারা বিশ্বের অর্থনীতিরই বিশ্বে টাল মাটাল অবস্থা৷ বৈশ্যতন্ত্র অর্থাৎ পুঁজিবাদের রমরমার কারণেই এই অস্থির অবস্থা দাপাদাপিটা চলছে৷ ক্রনি ক্যাপিটালিজমের তথা প্লুটোক্যাসীর ধনিক গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য৷ বলা যেতে পারে বিশ্বজুড়ে কায়েম হয়েছে ---অর্থনৈতিক  সাম্রাজ্যবাদ৷ আমাদের ভারতবর্ষ তো এর বাইরে নয়ই, বরং ভারত এখন সেই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদীদেরই প্রকৃষ্ট মৃগয়াক্ষেত্র৷ ভারতের বর্তমানে মূলত গৃহীত তিন কৃষি ‘আইন’,বেলাগাম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বিশেষ করে পেট্রোপণ্য ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের মূল্যের ম্যাজিক্যালি দ্রুত  উর্দ্ধগতি, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর ক্যানসার কিংবা করোনায় (যদিও  অর্থনৈতিক) আক্রান্ত হয়ে পড়া, ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পুঁজিপতিদের গা ঢাকা দিয়ে রেহাই পেয়ে যাওয়া, ঋণ খেলাপি অর্থ সরকার  দ্বারা মকুব হওয়া,দেশের নোট বাতিল করে বস্তার বস্তা নোতুন নোট ছাপিয়ে গরীব মানুষের শ্বাসনালী টিপে ধরা ইত্যাদি কারণে ভারতীয় অর্থনীতি বর্তমান কেন্দ্রীয় জমানায় আই.সি.ইউতে ভেন্টিলেটারে কাতরাচ্ছে৷ আর ‘‘রোম যখন পুড়ছে সম্রাট নীরর বেহালা বাজাবার মতই’’দিল্লীশ্বরগণ রাজ্য জয়ের স্টাচু নির্মাণ, মন্দির নির্মাণ, স্টেডিয়ামের নামকরণ বিরাট ওজনের কেক খাইয়ে দিয়ে ‘আচ্ছা ভারত’, লম্বা ঝাড়ু শিক্ষিত তরুণ-তরণীদেরসহ গোটা দেশবাসীর হাতে তুলে দিয়েই ‘‘স্বচ্ছ ভারত’’, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের কোটি কোটি শিক্ষিত বেকারদের চোখের সামনে ‘রাঙা মূলো’ বা ‘কাঁচকলা’  ঝুলিয়ে দিয়ে রেসের তাজা ঘোড়া বানিয়ে শাহেনশা গিরি দেখাতে মত্ত হয়েছেন৷ সেলুকাশ আজ বেঁচে থাকলেই দেখতে পেতেন কী বিচিত্র দেশ এই ভারত৷ ব্রিটিশ শাসনমুক্ত আর হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীদের করতলগত এই ভারত৷

বিগত ১৪/১০/২০১৭ তারিখে প্রকাশিত (২৭/০২/২০২১ তারিখে স্যন্দন পত্রিকার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত  জনৈক লেখকের লেখা  অনুযায়ী) কয়েকটি সংস্থার  সম্পদ বৃদ্ধির বিবরণঃ--- ১) গৌতম আদানির ৬৬ শতাংশ (২) মুকেশ আম্বানির ৬৭ শতাংশ (৩) বাবা রামদেবজীর ১৭৩ শতাংশ (৪) অমিত শাহের ৩০০ শতাংশ (৫) জয় শাহের১৬০ শতাংশ গুণ (অর্থাৎ মূলধন বেড়েছে ৫০ হাজার থেকে ৮০ কোটি টাকা৷)

অথচ অপর দিকে  বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স্‌) ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিশি রিসার্চ ইনষ্টিটিউট-এর প্রকাশনা অনুসারে, ২০১৭ সালেই ভারত সিরিয়্যাল নম্বর ৯৭ থেকে নেমে এসেছিল ১০১ নম্বরে (১১৯টি দেশ মধ্যে)৷ ২০১৯ সালে নেমেছিল ১০২ নম্বর আবার ২০২০ সালে এসেছে ৯৪তে  (১০৭ টি দেশের মধ্যে) ভারতের এফ.সি.আই এর গোদামে চাল উপচে পড়ছে বলে ইথানল বা বাংলায় চোলাই মদ তৈরীর জন্যে নাকি ডিষ্ট্রিনারী কোম্পানীকে অতিরিক্ত্ণ চাল দিয়ে দেওয়ার ও প্রয়াস চলছে৷

এছাড়া বর্তমান বিজেপির আমলে দেশের জিডিপির ক্রমবনতির কথা কি কেউ পারেন অস্বীকার  করতে? কেউ কি বলতে পারেন পেট্রোল, ডিজেলে জি.এস.টি ধরা নেই কেন? কেউ কি বলবেন--- ভারতের মাত্র ০.১ শতাংশ মানুষ জাতীয় সম্পদের প্রায় ৫৭ শতাংশ মালিক কেন? করোনাকালে অংসঘটতিদের সহ প্রায় ১৪কোটি মানুষ জীবীকা হারাল কেন? প্রতিবছর আমাদের দেশে বস্তিতে ঠাঁই নেয় কেনো প্রায় বিশ লাখ মানুষ?  আর মুকেশ আম্বানীর ১মিনিটের উপার্জনই কেন বা একজন  রেগা---শ্রমিকের দু’বছরের  উপার্জনের তুল্য হবে? (খবরের কাগজে বার্র্ত অনুযায়ী)