ভারতবর্ষে আর্থিক কেলেঙ্কারি বা ভ্রষ্টাচারের চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলী

লেখক
মনোজ সরকার

ট্রান্সপেরেন্সি ইণ্টারন্যাশানাল (Transperancy International)নামে একটি আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভ্রষ্টাচারের মাত্রা কতটা গভীর তার একটি তালিকা প্রস্তুত করে৷ প্রতিটি দেশের ভ্রষ্টাচারের অনীধাবনযোগ্য সূচকের(Corruption Perception Index) ভিত্তিতে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়৷ সরকারী ক্ষমতা অপব্যবহার করে ব্যষ্টিগত স্বার্থ হাসিল করাকেই সাধারণতঃ ভ্রষ্টাচার অনুধাবনযোগ্য সূচকের মাপকাঠি ধরা হয় এবং ভ্রষ্টাচারের মাত্রার আধিক্য অনুযায়ী তালিকার ক্রমাঙ্ক তৈরী করা হয়৷ অর্থাৎ যে দেশ সবচেয়ে কম ভ্রষ্টাচারী তার স্থান সবচেয়ে উপরে থাকে৷ বিশ্বের ১৭৬টি দেশকে নিয়ে ২০১৬ সালে যে তালিকা তৈরী হয়েছিল তাতে সবার উপরে ছিল ডেনমার্কের স্থান এবং ১৭৬ নম্বরে ছিল আফ্রিকার সোমালিয়া৷ এই তালিকায় ভারতের স্থান ৭৯ নম্বরে৷ আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের স্থান ১১৭ নম্বরে৷ ভ্রষ্টাচার অনুধাবনযোগ্য সূচক তৈরীতে যে মাপকদ্ধাঠি গণ্য করা হয় অর্থাৎ সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, তার অসংখ্য নজির আমাদের ভারতবর্ষে অতীতে দেখা গেছে এবং ব্যষ্টিগত স্বার্থ হাসিল করার বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির পর্দা ফাঁস হয়ে গেছে৷ টাকার অঙ্কে বড় বড় কয়েকটি আর্থিক কেলেঙ্কারির সংক্ষিপ্ত তথ্য এবার আলোচনা করা যাক৷

১) ভারতীয় কয়লা বণ্টন কেলেঙ্কারি ঃ ১,৮৬,০০০ কোটি টাকার কয়লা বণ্টন কেলেঙ্কারি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং সরকারের আমলে সংঘটিত হয়৷ টাকার অঙ্কে এটাই এখন অবধি প্রকাশ্যে আসা সর্ববৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারি৷ সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের উজ্জ্বল নিদর্শণ এই কয়লা বণ্টন কেলেঙ্কারি৷ উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারি ও আমলা অনৈতিক ভাবে প্রতিযোগিতা মূলক নিলাম বা দরপত্র না ডেকে যথেচ্ছভাবে সরকারের অধীনে থাকা কয়লাখনিগুলি বণ্টন করেছিলেন৷ সঠিক পদ্ধতিতে বণ্টন না হওয়াতে এই মর্মে প্রায় ১,৮৬,০০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারের ক্ষতি হয়৷ এর পেছনের কুশীলব যারা তারা নিশ্চয়ই মোটা রকম আর্থিক উৎকোচেভূষিত হয়েছেন৷

২) টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি ঃ ১,৭৬,০০০ কোটি টাকার এই কেলেঙ্কারি ২০০৮ সালে প্রকাশ্যে আসে৷ এই কেলেঙ্কারিও সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের উজ্জ্বল নিদর্শণ৷ এই আর্থিক কেলেঙ্কারির মূল হোতা ছিলেন প্রাক্তন টেলিকম মিনিষ্টার এ রাজা৷ কম্পট্রোলার এণ্ড অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট অনুযায়ী এ রাজা সব রকম নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে, নিলাম বা দরপত্র না ডেকে, উচিৎ মূল্যে বণ্টন না করে নাম মাত্র মূল্যে টু-জি স্পেকট্রাম লাইসেন্স বণ্টন করেছেন৷ এই মর্মে ১,৭৬,০০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারের ক্ষতি হয়৷

৩) ওয়াকফ বোর্ড ভূমি কেলেঙ্কারি ঃ ২০১২ সালে প্রকাশ্যে আসা এই আর্থিক কেলেঙ্কারির মূল্যমান প্রায় ১,৫০,০০০ কোটি টাকার উপরে৷ কর্ণাটক স্টেট্ মাইনরিটিজ কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান একটি চাঞ্চল্যকর অভিযেগে জানান যে কর্ণাটক ওয়াকফ বোর্ড (একটি মুসলিম চ্যারিটেবল ট্রাস্ট) সম্পূর্ণ বে-আইনি ভাবে বোর্ডের অধীনে থাকা ২৭ একর জমি বণ্টন বা আত্মসাৎ করেছেন যার আর্থিক মূল্যমান প্রায় ১,৫০,০০০ কোটি টাকা৷ বস্তুত বোর্ডের অধীনে থাকা জমি দরিদ্র ও নিঃস্ব মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণের মধ্যে বণ্টন করার কথা৷ কিন্তু অভিযোগ যে বোর্ডের সদস্য, রাজনীতিবিদ ও জমি মাফিয়াদের যোগসাজসে প্রায় অর্ধেক জমি জলের দরে বিক্রি করে দেওয়া হয় অথবা আত্মসাৎ করা হয়৷

৪) কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি ঃ ২০১০ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমস আয়োজন উপলক্ষ্যে প্রায় ৭০,০০০ কোটি টাকার মত আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়৷ অনুমান করা হয় যে ৭০,০০০ কোটির বরাদ্দকৃত অর্থের মাত্র অর্ধেক পরিমাণ টাকা ভারতীয় খেলোয়ারদের জন্যে খরচ করা হয়েছিল৷ সেণ্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশনের অনুসন্ধানে কমনওয়েলথ্ গেমস্ সংক্রান্ত প্রোজেক্টে বিভিন্ন রকম তথ্য যথা ভূয়ো সংস্থাকে টাকা প্রদান, তালগোল পাকানো অর্থ মূল্য, ফোলানো ফাঁপানো অর্থ মূল্য, বরাদ্দ অর্থ তছরূপ ইত্যাদি উঠে এসেছে৷ গেমস্ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকারী আমলার কারুকার্যের ফলেই এসব হয়েছে এটা বলা বাহুল্য৷

৫) তেলগি স্ট্যাম্প কেলেঙ্কারি ঃ ২০০২ সালে ২০,০০০ কোটি টাকার এক অভিনব আর্থিক কেলেঙ্কারির কাহিনী প্রকাশ্যে আসে৷ অন্যান্য আর্থিক কেলেঙ্কারি যেমন রহস্য, নাটক ইত্যাদিতে ভরা, তেলগির ট্যাম্প কেলেঙ্কারি তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়৷ জনৈক আব্দুল করিম তেলগি নামক এক ব্যষ্টি জাল স্ট্যম্প পেপার ছাপানোর যাবতীয় কলাকৌশল করায়ত্ত্ব করে দীর্ঘদিন ধরে জাল স্ট্যাম্প পেপার ছাপিয়ে ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে বিক্রি করত৷ দেশের মোট ১২টি রাজ্যে তার এই জালিয়াতি চক্র ছড়ানো ছিল ও আনুমানিক ২০,০০০ কোটি টাকার জাল স্ট্যাম্প পেপার বাজারে ছাড়া হয়েছিল৷ এটা অনস্বীকার্য যে স্ট্যাম্প পেপার ছাপানো ও বিক্রির কাজে লিপ্ত যে সমস্ত সরকারী দপ্তর, তাদের একটা অংশের সমর্থন ছাড়া তেলগির পক্ষে একাজ চালিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হত না৷

ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক জগতে উপরোক্ত কেলেঙ্কারিগুলি বিপুল পরিমাণ অর্থ জড়িত বলে সামনের সারিতে স্থান করে নিয়েছে৷ এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কেলেঙ্কারি হল সত্যম কম্পিউটার সার্ভিসেস কেলেঙ্কারি (১৪,০০০ কোটি টাকা), পশুখাদ্য কেলেঙ্কারী (১,০০০ কোটি---লালুপ্রসাদ যাদব যেটাতে জড়িত), বোফর্স কেলেঙ্কারি (১০০ কোটি), হাওয়ালা কেলেঙ্কারি (১০০ কোটি) ইত্যাদি৷

লক্ষ্যণীয় প্রতিটি কেলেঙ্কারিতে কুশীলবের ভূমিকায় আছে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, সরকারী আমলা বা কোনো বিত্তবান ব্যষ্টি৷