এবারের লোকসভা নির্বাচনের পর ২০শে জুন প্রথম অধিবেশনে শাসক বিজেপি দলের তৈরী করা ভাষণ পাঠ করেন রাষ্ট্রপতি প্রথাগতভাবে৷ এতে বিগত সরকারের কাজের ফিরিস্তি পাঠ করে বিজয়ী সদস্যদের জ্ঞাত করেন৷
এতে বিরোধীরা মোটেই সন্তুষ্ট হন নি৷ রাষ্ট্রপতি মোদি সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন৷ কংগ্রেসের লোকসভার নেতা মাননীয় অধীররঞ্জন চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রপতির ভাষণে শুধু মোদি সরকারের প্রশংসার কথা বলা হয়েছে৷ কর্ম সংস্থানের কোনো উল্লেখ নেই৷ কৃষকদের (কর্ষকদের) কথাও সে ভাবে বলা নেই৷ জনস্বার্থের সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় বিষয় রাষ্ট্রপতির ভাষণে না থাকায় এবার সরব হবে কংগ্রেস৷ তৃণমূল কংগ্রেস কড়া সমালোচনা করেছে৷ তৃণমূল কংগ্রেস, রাষ্ট্রপতির ভাষণে জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর উল্লেখ থাকায় তাঁরা এর বিরুদ্ধে সরব হবে বলে জানান৷ এছাড়া ই.ভি.এম, বেকারত্ব, রাজ্যকে পাঠানো এডভাইসারি, ‘একদেশ-একবোট’, বি.এস.এন.এল বন্ধ করার উদ্যোগগুলির তীব্র প্রতিবাদ করা হবে৷ রাষ্ট্রপতির ভাষণের সংশোধনী চেয়ে নোটিশও দিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়৷
স্মরণে রাখা দরকার, ভারত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ তাই কেন্দ্রীয় সরকারকে নৈতিকতা ও মানবিকতার কথা স্মরণ করে নিরপেক্ষতাকে বজায় রেখে চলতেই হবে৷ দীর্ঘ ৭২ বছর গণতান্ত্রিক শাসনে ভারতের জনগণ হতাশ৷ ভারতের সংবিধান কয়েক ডজন বার সংশোধিত হয়েছে দলীয় স্বার্থে৷ তাতে জনগণেব লাভ হয়নি৷ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো ধনীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ কোটি কোটি মানুষ আজও হতদরিদ্র নিরন্ন৷
ইংরেজ আমলের ১৫টি রাজ্য, আর করদ রাজ্যগুলির রাজা মহারাজারা ভারত-ভুক্তিকে স্বীকার করায় আজ ভারত বহু ভাষা-ভাষী ও বহুজাতিক এক বিরাট দেশ৷ একে স্বীকার করেই ভারতের সংবিধান৷ অদ্যাবধি কেন্দ্রীয় সরকার কতটা উন্নয়ন ঘটিয়েছেন দেশের? এরা যাতে হাত দিয়েছেন দলীয় স্বার্থে সব কিছুকেই ধবংস করেছেন৷ জনগণের দুঃখ দুর্দশাকেই বাড়িয়েছেন৷ বরং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভাঙার অশনী সংকেত পাওয়া যাচ্ছে৷ আজ দেশ চরম বেকার সমস্যায়, ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে৷ নির্বাচনের পরও কাটাকাটি মারামারি লেগেই আছে৷ এটা কারা করছে? সেটা দলগুলো ভালভাবেই জ্ঞাত আছে৷ দল ভাঙ্গাভাঙ্গিটা আর টাকার খেলাটা, যা রাজনৈতিক দলগুলির নিত্যনৈমিত্তিক কাজ তারাই করছে৷ আজ দেশ ডুবছে! রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে৷ জনগণের প্রকৃত কল্যাণের দিকে কারোর তিলমাত্র নজর নেই৷ কেবল গদীর স্বার্থেই দলীয় নেতা-নেত্রীগণ সদা ব্যস্ত৷ লজ্জার কথা আজ নির্বাচন মানেই হ’ল বোমাবাজী, লোকক্ষয় আর রিগিং৷ এতেই বিজয়ী দলগুলো আহ্লাদে আটখানা৷
প্রবীণদের স্মরণে আছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একবার ভারতে রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থার কথা ভাবেন৷ কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিচার-বিশ্লেষণে ও জনগণের অমতে সেদিকে পা বাড়াননি৷ কে এমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ভারতে আছেন যিনি সারা ভারতের আদরনীয় ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়? যাঁকে এক ডাকে সারা ভারত মেনে নেবে? আজকের দলীয় নেতা-নেত্রীগুলির দিকে কারোরই প্রতি তেমন শ্রদ্ধা আছে বলে মনে হয় না৷ তাছাড়া রাজ্যগুলির নিজস্ব শাসনব্যবস্থাকে অস্বীকার কেউ করবে না৷ অতি তাজ্জ্বব ব্যাপার গত পাঁচ বছরের শাসনে চরম ব্যর্থ বিজেপি সরকার যদি বর্তমানে নির্বাচনে এর নানা মারপ্যাঁচ ও দল ভাঙ্গাভাঙ্গি করে বেশী সদস্যকে টেনে এনে সরকারে এসেছেন৷ কিন্তু তারা ও তার সরকার যে ভারতের ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যকে জলাঞ্জলী দিয়ে ‘এক দেশ-একবোটের’ জিগির তুলছে সেটা দেশের ১৩৩ কোটি মানুষ মানবে কী? একমাত্র অদ্যাবধি নেতাজী সুভাষচন্দ্রই হলেন ভারতের তথা অতীতের ভারতবর্ষের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি৷
আর্যাবর্তের (উত্তর ভারত) এর সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের অনেক ব্যাপারে মিলই নেই৷ তবু সেই প্রাচীন সনাতন ধর্মের আত্মীক টানে ও কৃষ্টি সংস্কৃতির জন্য একটি মিল আছে, সেই কারণে একটা একাত্মতা আছে৷ ওখানকার মানুষ উত্তর ভারতের হিন্দী বলয়ের হিন্দী ভাষা নিয়ে যে একগুয়েমী সেটা পছন্দ করেই না৷ তাছাড়া তাঁরা একটা নিজস্ব চিন্তা ও ভাবধারা নিয়ে থাকে৷ তারা উত্তর ভারতের গো-বলয়ের সংকীর্ণ গোঁড়ামীকেও দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগানোতে সম্মতই হবে না৷ এক দেশ আর এক বোট (ভোট) বাঙলা ও পূর্ব ভারত এর সীমান্ত এলাকাবাসী এর চরম বিরুদ্ধে৷ তারা বিজেপির ‘‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর’ ব্যাপারে হিন্দু-মুসলমান বিভেদকামী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকে ঐতিহাসিক কারণে মানে না৷ কারণ অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রত্যেকে মাটির সন্তান৷ শুধু তাই নয়, কয়েক পুরুষ আগে সবাই ছিল হিন্দু৷ নানা কারণে মুসলমান আমলে বাধ্য হয়ে অনেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন৷ তারা সেই কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে আচার-আচরণে এই মাটিরই মানুষ৷ তাই বাঙালী জনগোষ্ঠী মূলত হিন্দু ও মুসলমান৷ ভেদাভেদটা বাঙালী মানতে পারে না৷ ইংরেজ আমলে সরকার দক্ষিণ অসমের বরাক অঞ্চলটা যেটি বৃহত্তম বাঙলার ছিল সেটি অসমের সঙ্গে যুক্ত করে দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাঙলাদেশ) অসমের কিছু এলাকা দিয়ে দেয়৷ যখন বাঙলাদেশ হয় তখন সেই হিন্দু বিতাড়নে হয়তো কিছু লোক বাধ্য হয়ে পুরাতন এলাকায় ফিরে আসেন৷ আজ কেন্দ্রীয় সরকার তাদের ভাগ্য নিয়ে অসমে ‘জাতীয় নাগরিক পঞ্জী’র নামে যা করছেন সেটা মানবতাবিরোধী কাজ তাছাড়া এটা একটা ঘৃণ্য কালাকানুন৷ অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ এই কালাকানুনের বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা করেছেন৷ কেন্দ্রীয় সরকার এর কাছে আরও ডিটেনশন ক্যাম্প করার জন্য অসম সরকার কয়েক কোটি টাকা দাবী করেছেন৷ এটা তো অমানবিক ব্যাপার৷ অসমের প্রায় ৪০ লক্ষ বাঙালী হিন্দু-মুসলমানকে অনাগরিক হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়েছে৷ তাঁদের বিচার চলছে ট্রাইবুন্যালে৷ অনেকে আত্মহত্যা করেছেন৷ এ কেমন কথা৷! এ কেমন গণতন্ত্র! এ কেমন গণতান্ত্রিক সরকারের বিচার৷ সমস্ত বাঙালীরা এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে৷ সারা দেশের, শুধু দেশের নয়, সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ এর প্রতিবাদে সর্বত্র মুখর হয়ে উঠবে৷
- Log in to post comments