পরমশ্রদ্ধেয় দার্শনিক প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘দেশপ্রেমিকদের প্রতি’ গ্রন্থে দেশ বিভাজন প্রসঙ্গে বলেছেন‘‘--- এই অবস্থায় ভারতবর্ষের বিভাজন এড়িয়ে যাবার কোন উপায় কী দেশীয় নেতাদের হাতে ছিল না? হ্যাঁ ছিল৷ তখন তাঁরা যদি বিভক্ত ভারত মেনে না নিয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন শুরু করতেন, স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষ পাওয়া তখনও অসম্ভব হ’ত না৷ কিন্তু হিন্দু বা মুসলমান নেতৃবৃন্দ তা চাননি৷ কেন চাননি তা তাঁরাই জানেন৷’’
তবে কেন চাননি তার কারণটা পরবর্তী অনুচ্ছেদে বলেছেন--- ‘‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রাম কেবল ইংরেজ শোষণের বিরুদ্ধেই সীমিত থাকত না, সে সংগ্রাম ভারতের পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হ’ত৷ ইংরেজরা যদি দেখত যে তাদের শোষণ আর চলছে না, তখন তারা বাধ্য হয়ে ভারতবর্ষকে রাজনৈতিক স্বাধীনতাও দিয়ে দিত৷ আর সেই রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে দেশীয় পুঁজিপতিদের শোষণও বন্ধ হ’ত৷ হিন্দু ও মুসলমান উভয় পক্ষের নেতারাই ছিলেন পুঁজিবাদী৷ তাঁরা চেয়েছিলেন পুঁজিবাদকে বাঁচিয়ে রেখে দেশের স্বাধীনতা৷ এই জন্যে বাধ্য হয়েই তাঁরা খণ্ডিত ভারতের স্বাধীনতা মেনে নিলেন৷’’
যে বাধ্যবাধকতায় সেদিন দেশনেতারা দেশ বিভাজন মানতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই বাধ্য-বাধকতার রাজনীতি থেকে আজও দেশ নেতারা মুক্ত নন, সে ডান বাম রাম যে পক্ষের নেতাই হোক৷ একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস৷ তাঁর একমাত্র স্বপ্ণ ছিল দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের আর্থিক শোষণমুক্তি৷ এব্যাপারে তিনি কোন আপস করতে চাননি৷ তাই তাঁর কোন রাজনৈতিক বাধ্য বাধকতা ছিল না৷ তাই তিনি কংগ্রেস সভাপতির পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন৷ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে তাঁকে দেশের বাইরে যেতে হয়েছে৷ চিরকালের জন্যে দেশের বাইরে থেকে যেতে হয়েছে৷ সেদিন কংগ্রেস, আর,এস,এস এমনকি তথাকথিত সমাজতন্ত্রী কম্যুনিষ্টরাও সুভাষচন্দ্রের পাশে দাঁড়ায় নি৷
সততা নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমকে সম্বল করে সুভাষচন্দ্র আই.সি.এস পাশ করে ব্রিটিশের গোলামী না করে রাজনীতিতে এসে ছিলেন৷ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কোনদিনই কোনরকম কপটতাকে প্রশ্রয় দেন নি৷ ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন দেশীয় পুঁজিপতিদের সাহায্যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শক্তি অর্জন করছে৷ এদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, জনগণকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দিতে হবে৷’’ সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি মানুষের আর্থিক মুক্তির কথাও চিন্তা করেছিলেন৷ দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করার পরিকল্পনা একমাত্র সুভাষচন্দ্র করেছিলেন৷
যাই হোক সুভাষচন্দ্রের দেশীয় পুঁজিপতিদের সম্পর্কে বক্তব্য পুঁজিপতিরাতো বটেই গান্ধীজিরও পছন্দ হয়নি৷ তাই ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতিপদে সুভাষচন্দ্রের নাম গান্ধী কিছুতেই মেনে নেননি৷ তাই সভাপতি পদের নির্বাচনে গান্ধী মনোনীত প্রার্থী হলেন পট্টভি সীতারামাইয়া৷ তবু জয়ী সুভাষচন্দ্রই হয়েছিলেন৷ কিন্তু গান্ধী ও তাঁর বশংবদ পুঁজিবাদী নেতাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদত্যাগ করেন৷ সে ইতিহাস ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কলঙ্কিত অধ্যায়৷ সেই অধ্যায় ও তার খলনায়কদের আড়াল করতেই স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরেও সুভাষচন্দ্র সম্পর্কিত বহু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল আজও প্রকাশ করা হয়নি৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রচারে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলেন নেতাজী সম্পর্কিত সব গোপন ফাইল প্রকাশ করবেন৷ কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি তিনি আর রাখেন নি৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই কলঙ্কিত অধ্যায়ে কংগ্রেস,আর.এস.এস. কম্যুনিষ্টদের স্বাধীনতা অপেক্ষা সুভাষ বিরোধীতাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷
কংগ্রেস আর.এস.এস পুঁজিপতিদেরই দল৷ কিন্তু কম্যুনিষ্টরা কেন সেদিন সুভাষ বিরোধিতায় নেমেছিলেন? আসলে ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি পুঁজিপতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়, তাছাড়া সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের স্বতন্ত্র ভাবনা ছিল যা মার্কসবাদের সমাজতান্ত্রিক ভাবনার সঙ্গে মেলে না৷ সুভাষচন্দ্র সে কথাও স্পষ্ট করে বলেছেন৷ ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন--- ‘‘আজকাল সমাজতন্ত্রের নূতন চিন্তা ভারতে আসছে পাশ্চাত্য থেকে এবং তা অনেকেরই চিন্তাধারায় বিপ্লব আনছে৷ কিন্তু এদেশে সমাজতন্ত্রের চিন্তা এমন কিছু নূতন নয়, আমাদের এইরূপ মনে হয় এই কারণে যে আমরা ইতিহাসের যুগসূত্র হারিয়ে ফেলেছি৷’’ এরও আগে ১৯২৬ সালে এক ভাষনে সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে বলেছিলেন---‘‘সমাজতন্ত্র কার্লমার্কসের পুঁথির পাতা থেকে জন্ম নেয়নি, এর উৎপত্তি ভারতবর্ষের আপন চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির মধ্যে৷’’
তাই সেদিন সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অপেক্ষা দেশীয় পুঁজিপতিদের কাছে ও তাদের তাঁবেদার কংগ্রেস কম্যুনিষ্ট আর এস.এসের কাছে বেশী বিপদজনক ছিলেন৷ রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের স্বতন্ত্র চিন্তাধারাই সেদিন অন্য নেতাদের কাছে চক্ষুশূল স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সেদিন ওই সব নেতাদের কাছে স্বাধীনতা অপেক্ষা সুভাষচন্দ্রকে প্রতিহত করাই প্রধান লক্ষ্য হয়েছিল৷ সেই লক্ষ্যপুরণে তারা সেদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে হাত মেলাতেও পিছপা হননি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ যেমন সুভাষচন্দ্র ফিরে আসার ভয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে দেশ ভাগ করে চলে যায়, নেতারাও তেমনি একই খণ্ডিত ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে সুভাষচন্দ্রের ফিরে আসার পথ চিরতরে অবরুদ্ধ করে দেয়৷
আজ ভারতে এত যে রাজনৈতিক দল ছারপোকার মত কিলবিল করছে এ সবই কংগ্রেস, কম্যুনিষ্ট আর.এস.এসের কলম কাটা চারা৷ তাই ক্ষমতার রং বদল হলেও সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে মত বদল হয় না৷ স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই দেশীয় পুঁজিপতিরা রাজনীতির এক বিষাক্তবৃত্ত তৈরী করে নিয়েছে৷ যে বৃত্তের কেন্দ্রে বসে ওই পুঁজিপতিরা পরিধিকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ সমস্ত দল ও নেতারা ওই বৃত্তের পরিধির মধ্যেই আবদ্ধ থাকে৷ আজও দল ভাঙে-দল গড়ে কিন্তু ওই বিষাক্ত বৃত্তের বাইরে কেউ থাকতে পারে না৷ একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ তাঁর স্বপ্ণ ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, জনগণের দারিদ্র মোচন, ভারতীয় চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা৷ যা শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নয়, দেশীয় পুঁজিপতিদের শোষণও বন্ধ হয়ে যেত৷ যে শোষণের যাঁতাকল আজ সমাজের সর্বস্তরে জেঁকে বসেছে৷
তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এক নম্বর শত্রু হলেও দেশীয় পুঁজিপতি ও তাদের তাঁবেদার নেতাদের চক্রান্তেই সুভাষচন্দ্র ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস আজও অজ্ঞাত রয়ে গেছে৷ যে ইতিহাস প্রকাশ হলে অনেক ভণ্ডদেশ প্রেমের মুখোশ খসে পড়বে, সুউচ্চ মূর্ত্তি ধূলায় লুটিয়ে পড়বে, সুভাষ প্রেমের ভণ্ডামী বন্ধ হয়ে যাবে৷
- Log in to post comments