মার্কস শোষণ বলতে ভেবেছিলেন---শ্রমিক শ্রেণীকে ন্যায্য পাওনা না দিয়ে পুঁজিপতিরা যে মুনাফা লোটে সেটাই শোষণ৷ এটাও শোষণ কিন্তু এই শোষণের আগেও আরও শোষণ আছে৷ শোষণের সঠিক সংজ্ঞা একমাত্র প্রাউটের দৃষ্টিকোণ থেকেই পাওয়া যায়৷ প্রাউট প্রবক্তার ভাষায়---একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যে অবস্থিত তথাকার জনগোষ্ঠীর দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশকে স্তম্ভিত করে, ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শ্রম ও মানসিক সম্পদের অবাধ লুণ্ঠনই হ’ল শোষণ৷
তাই প্রাউটের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় শোষণ শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই হয় না৷ শোসিত জনগোষ্ঠী যাতে কোনভাবেই শোষণের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে তাই তাকে মানসিক দিক থেকেও অচেতন, পঙ্গু করে রাখতে মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক শোষণের জাল বিস্তার করে রাখে শোষক গোষ্ঠী৷
বাঙলা আজ এই সব ধরণের শোষণের শিকার হয়ে পড়েছে৷ তথাকথিত স্বাধীনতার নামে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাই হস্তান্তর করেনি, দু’শ বছর ধরে অর্থনৈতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে যে শোষণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বাঙলায় করেছিল, সেই শোষণের সব রকম ছলাকলাও দেশীয় পুঁজিপতিদের কাছে হস্তান্তর করে যায়৷ স্বাধীন ভারতে ৭২ বছর ধরে দেশীয় পুঁজিপতিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরসূরী হিসাবে সবরকম শোষণের জাল বাঙলায় আরও নিপুনভাবে বিস্তার করেছে৷ দেশীয় পুঁজিপতিরা শোষণের সব রকম ছলাকলায় বিদেশী শেতাঙ্গ শোষকদের চেয়েও অনেক বেশী পারদর্শী হয়ে উঠেছে৷
প্রাউটের দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক শোষণের কয়েকটি পর্যায় রয়েছে৷ যেমন---ঔপনিবেশিক শোষণ, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও ফ্যাসিষ্ট শোষণ৷ সব রকমের শোষণই জনগণকে পিষ্ট করে, কিন্তু শোষণের সব থেকে ভয়ঙ্কর রূপ হ’ল ফ্যাসিষ্ট শোষণ৷ এই নিষ্ঠুর শোষণে ফ্যাসিষ্ট শোষকরা হাতিয়ার করে জাতিয়তাবাদী সেণ্টিমেণ্ট, তথাকথিত ধর্মমতের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও অসংস্কৃতিকে৷ এরা মিথ্যা যুক্তির জাল বিস্তার করে, মিথ্যা তথ্য সাজিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে তাদের সমর্থন আদায় করে নেয়৷ জনগণ চিনতেও পারে না জাতীয়তাবাদের মুখোশধারী ফ্যাসিষ্ট শোষকদের৷
স্বাধীনতার পর থেকেই এই ফ্যাসিষ্ট শোষকদের কু-দৃষ্টি পড়ে বাঙলার ওপর৷ বাঙলার ওপর তাদের শোষণের থাবা বসাতে এতটুকু কালবিলম্ব করেনি৷ ভৌগোলিক দিক থেকে বাঙলাকে টুকরো করে বাঙলার অংশ পাশ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেছেন৷ পরিণতিতে বাঙলা হারিয়েছে তার ভূমি, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভাষা-সংস্কৃতি, সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে জনগোষ্ঠীও ছোট হয়েছে৷ পাশাপাশি অশ্লীল হিন্দী ও অসংস্কৃতি চাপিয়ে বাঙলার উন্নত ভাষা-সংস্কৃতিকে ধবংস করে বাঙালীকে মানসিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে৷
স্বাধীনতার পর মাত্র দু’বছরের মধ্যেই সমস্ত পঞ্জাবী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজ সম্পন্ন করে ভারত সরকার৷ কিন্তু বাঙালী উদ্বাস্তু সমস্যার কোনো সমাধানের উদ্যোগ ভারত সরকার আজও নেয়নি৷ উপরন্তু আজ এন আর সি নামক কালাকানুনের দ্বারা বাঙালীকে বিদেশী চিহ্ণিত করে ভারতের মাটি থেকে উৎখাতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ এইভাবে ফ্যাসিষ্ট শোষণের সমস্ত হাতিয়ার নিপুণভাবে ব্যবহার করে তীব্র অর্থনৈতিক শাষণ বাঙলার বুকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তথাকথিত ধর্মের নামে বিকৃত ধর্মীয় মতবাদের সুড়সুড়ি দিয়ে শৈবতন্ত্র ভিত্তিক বাঙলার উন্নত সভ্যতা, সংস্কৃতি, ও আধ্যাত্মিক চেতনাকে বিকারগ্রস্ত করা হয়েছে, তার প্রাণশক্তিকে ধবংস করা হয়েছে৷
কোন জনগোষ্ঠীর মানসিক উন্নতি ও বিকাশের সব থেকে শক্তিশালী মাধ্যম হ’ল তার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি৷ উন্নত ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমেই একটা জাতির চরিত্র গড়ে ওঠে৷ তাকে করে তোলে উন্নত আচরণ পরায়ণ, সভ্য, সৎ নীতিবাদী ও তেজস্বী৷ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বাঙালীর এই চরিত্রের পরিচয় পেয়েছিল৷ মূলত বাঙালীর বৈপ্লবিক তেজস্বীতার কাছেই মাথা নত করে ব্রিটিশ ভারত ছাড়ে৷ দেশীয় ফ্যাসিষ্ট শোষক পুঁজিপতিরা বাঙালীর এই চরিত্র সম্পর্কে অবগত ছিল৷ তাই স্বাধীনতার পর মুহূর্ত্ত থেকেই বাঙালীকে তার ভাষা-সংস্কৃতি থেকে উৎখাত করে, তার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও নৈতিক মানকে নিম্নমুখী করে তাকে বিপথে চালিত করতে বাঙলার বুকে চাপিয়ে দিয়েছে যৌন আবেদন মার্কা অপরাধপ্রবণ অতি নিম্নমানের অশ্লীল চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, সাহিত্য৷ সঙ্গে মদ জুয়ার আড্ডা৷
ভারতের বৈশ্য শাসিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সবরকম সুযোগ-সুবিধা, আইন-কানুন ফ্যাসিষ্ট শোষকদেরই অনুকূলে৷ আমলাতন্ত্র পুলিশপ্রশাসন এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোও পরোক্ষভাবে এদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকে৷ তাই আমলা, পুলিশ-প্রশাসন সবসময় ফ্যাসিষ্ট শোষকদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত থাকে৷ আর রাজনৈতিক নেতারা ওই শোষকদের উচ্ছিষ্টের ছিঁটেফোঁটা পাওয়ার লোভে দলাদলী, খেয়োখেয়ী করে মরছে৷
বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণকে বহুদলে বিভক্ত করে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত রেখে ফ্যাসিষ্ট শোষক ও তাদের অর্থে পালিত শাসকবর্গ মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক অধিকার হরণ করে নেয়৷ এইভাবে এক একটি জনগোষ্ঠীকে মানসিক ও নৈতিকভাবে দুর্বল করে দিয়ে নির্মমভাবে শোষণ করে যায়৷ বাঙলা আজ এমনি এক ভয়ঙ্কর ফ্যাসিষ্ট শোষণের শিকার৷
আজ বাঙালী যদি এই দলাদলির রাজনীতি ভুলে, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ না হয় , ফ্যাসিষ্ট শোষণের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ায়, তবে অচিরেই বাঙালীকে অসম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও উচ্ছেদ হয়ে অসহায় সম্বলহীন ভবঘুরের মতো পথে পথে ঘুরে মরতে হবে৷
- Log in to post comments