একজন মহান দার্শনিক বলেছিলেন–‘‘কিছু সংখ্যক গুণ্ডা–বদমাস অপেক্ষা একটি ভ্রান্ত দর্শনের অনুগামীরা সমাজের অনেক বেশী ক্ষতি করে৷’’
দুর্নীতি, শ্লীলতাহানী,খুন, ধর্ষনের মত জঘন্য অপরাধের ঘটনা প্রতিদিনই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে৷ এক একটি ঘটনা ঘটে–রাজনৈতিক দল থেকে বুদ্ধিজীবী মহল গণমাধ্যম সমাজের সর্বস্তরে সরগোল শুরু হয়, কঠোর সাজার দাবী ওঠে, রাজপথে মোমবাতি জ্বলে তারপর সব স্তিমিত হয়ে যায়৷ আর একটা ঘটনার জন্যে অপেক্ষায় থাকে প্রতিবাদের রংমশাল জ্বালাতে৷ কিন্তু তাতে অন্ধকার দুর হয় না৷ বরং দুর্নীতি অপরাধ বেড়েই চলে৷
কিন্তু সমাজে এই অপরাধ বন্ধের জন্যে কী করা হচ্ছে? বড়জোর সমালোচকরা প্রশাসনকে গালমন্দ করছেন, প্রশাসনকে আরও শক্ত হতে উপদেশ দিচ্ছেন৷ আর একটু এগিয়ে কিছু বিচক্ষণ বুদ্ধিজীবী আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে আরও কড়া আইন প্রবর্তনের সুপারিশ করছেন৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যপক সমালোচনার চাপে পড়ে সরকার নোতুন আইন প্রবর্তন করছেন যেমন দিল্লীর ধর্ষণের ঘটনায় বিচলিত হয়ে সরকার ধর্ষণ বিরোধী নোতুন বিল এনে লোকসভায় ও রাজ্যসভায় পাশ করালেন৷ কিন্তু তাতেও তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না
শুধু এই অপরাধই নয়, অজস্র এ ধরনের এমনি অপরাধ প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে৷ দুর্নীতিতে তো গোটা দেশটা ছেয়েই গেছে৷ আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই এসব ঘটছে আর যাদের হাতে আইনকে কার্যকরী করার ভার তারাই আইন ভঙ্গ করে বেআইনী কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে৷
আসলে এটা যে একটা ভয়ঙ্কর সংক্রামক ব্যাধি– এটা কি কেউ বুঝতে চেষ্টা করছেন না এই ভয়ঙ্কর সংক্রামক ব্যাধি মহামারীর মত গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাই এই মারাত্মক ব্যাধির পেছনে কোন্ ভাইরাস কাজ করছে, এই ভাইরাস ধ্বংস করার কী উপায় –সেটাই আজ ভাবতে হবে৷
সমাজে চার ধরনের দর্শন রয়েছে৷ এক একটা দর্শনের প্রভাবে মানুষের এক এক ধরনের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গী তৈরী হচ্ছে৷ এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে আত্মস্বার্থ কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী তথা মনোভাব৷ এর পেছনে রয়েছে আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক দর্শন, যেমন ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ৷ এই দর্শন মানুষকে শেখায় কেবল নিজের লাভ, নিজের সংকীর্ণ সুখটার দিকে তাকাতে৷ অন্যের তাতে সুখ বা দুঃখ– তাতে তাদের মাথাব্যথা নেই৷ সমাজজীবনে এ এক ভয়ঙ্কর ভাইরাস, যা সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷
দ্বিতীয় প্রকার দর্শন হ’ল জড়কেন্দ্রিক দর্শন যেমন মার্কসবাদ৷ এই দর্শন বলে জড়বস্তু ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুই নেই৷ তাই এই দর্শনের প্রভাবে মানুষ ভাবছে, তার মনের সমস্ত আশা–আকাঙক্ষা জড় ভোগ্যবস্তুকে দিয়েই মেটাতে হবে, তাই যত বেশি সম্ভব ভোগ্যবস্তুকে কেমন করে সে করায়ত্ত করবে, নিজে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবে, সেই চিন্তাতেই সে সদাব্যস্ত৷
তৃতীয় প্রকার দর্শন হ’ল ডগ্মা কেন্দ্রিক দর্শন৷ এই দর্শনের অনুগামীরা অন্ধভাবে কোনো কিছুকে বিশ্বাস করে তাকেই আশ্রয় করে মানুষকে সবকিছু করতে শেখায়৷ যুক্তি–বিজ্ঞানকে এরা মূল্য দেয় না, বিভিন্ন কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসপূর্ণ তথাকথিত ধর্মমতাশ্রয়ী সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে চলার শিক্ষা এরা মানুষকে দেয়৷
এই তিনটি দর্শন ঘুরে ফিরে ভোগবাদকে প্রশ্রয় দেয়, যে ভোগবাদ ইন্দ্রিয় সুখকেই জীবনের চরম বলে ভাবতে শেখায়৷ তাই আজ সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে যে ব্যাভিচার, অনাচার, দুর্নীতি–তার কারণই হলো পুঁজিবাদী শোষণ ও ভ্রান্ত দর্শনের প্রভাব৷
চতুর্থ দর্শন হল ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শন৷ এই ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শন শেখায়, সমস্ত নদী যেমন সমুদ্রে গিয়ে মিলিত হয়, তেমনি সমস্ত মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য ঈশ্বরের সঙ্গে অর্থাৎ ভূমাচৈতন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়া৷ তখনই মানুষ পাবে জীবনের পূর্ণ আনন্দ–পরিপূর্ণ প্রশান্তি৷ এই ঈশ্বর কেন্দ্রিক দর্শন ঈশ্বরকে ভালবাসতে শেখায়৷ আর ঈশ্বর সবার মধ্যে বিরাজিত৷ তাই এই দর্শন ঈশ্বরজ্ঞানে জগতের সবাইকেই ভালবাসতে শেখায়৷ সবার প্রতি পবিত্র কর্তব্যবোধ জাগিয়ে দেয়৷ ঈশ্বর ভাবনা মনকে পবিত্র করে –সূক্ষ্ম দিকে পরিচালিত করে, তাকে নৈতিকতায, নব্যমানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ করে৷ এটাই প্রকৃত আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷
এই আধ্যাত্মিক শিক্ষাই মানুষকে যথার্থ নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে৷ এই আধ্যাত্মিক শিক্ষাই মানুষের মনকে সমস্ত কলুষতা থেকে মুক্ত করতে পারে৷ কিন্তু বর্তমানে দেশের নেতা–মন্ত্রীরা তথা আজকের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই এই আধ্যাত্মিকতাকে বর্জন করে সমাজের উন্নতি করতে চান– যা কখনোই সম্ভব নয়৷ আধ্যাত্মিকতা ছাড়া মানুষের মন কখনোই কলুষমুক্ত করা যাবে না৷
বর্তমানের নেতা–নেত্রী তথা বুদ্ধিজীবীদের বৃহদংশ পূর্বোক্ত প্রথম তিন প্রকার দর্শনের ধারক ও বাহক৷ এই কারণে এই তিন দর্শনের গণ্ডীর মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রেখে যতই তাঁরা সমাজকে কলুষমুক্ত করার কথা উচ্চকন্ঠে প্রচার করুন না কেন, তাঁরা ব্যর্থ হবেনই৷ যথার্থ আধ্যাত্মিক শিক্ষা ছাড়া কোনো আইনই সমাজকে ব্যাভিচার, পাপাচার ও দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে পারবে না৷
- Log in to post comments