চাই আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা

লেখক
নিরপেক্ষ

জাতিগঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হ’ল শিক্ষা৷ আজ যে সারা দেশ জুড়ে অসংখ্য আর্থিক দুর্নীতি, নারী–লাঞ্ছনা, পারিবারিক হিংসা ও হত্যা সহ অজস্র অপরাধের ঘটনা ঘটছে এ সবের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি৷ প্রতি বছর তো লক্ষ লক্ষ যুবক–যুবতী স্কুল কলেজের গণ্ডী পেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছে৷ এই স্কুল কলেজগুলিই প্রধানতঃ মানুষ তৈরীর কারখানা৷ মানুষের মধ্যে সদ্বৃত্তির মূল্যবোধের জাগরণের প্রাথমিক দায়িত্ব এই স্কুল–কলেজের৷ এই স্কুল কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে যে এই প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করছে না–সে সম্পর্কে বোধহয় কেউই দ্বিমত হবেন না৷ মূল্য ভিত্তিক শিক্ষা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে উধাও হয়ে গেছে৷  অর্থনৈতিক শিক্ষাটাই অধিকতর গুরুত্ব লাভ করেছে৷ অধিকতর  বলব কেন, বস্তুতঃ এই অর্থনৈতিক শিক্ষাটাই আজকের শিক্ষাব্যবস্থার ধ্যান–জ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কী করে ছাত্র–ছাত্রারা কিছু রোজগার করতে পারবে – এটাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কীভাবে মনুষত্বের বিকাশ ঘটবে এই শিক্ষা আজ উধাও৷

শিক্ষা ব্যবস্থার এই ত্রুটির জন্যেই ভোগসর্বস্ব জীবনাধারার গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলেছে সমাজ৷ আত্মসুখ, স্বার্থপরতা মানুষের জীবনকে গ্রাস করছে৷ আর এই আত্মসুখ লাভের জন্যে নানান অশোভন, অনৈতিক, অসামাজিক, অমানবিক কাজ করতে আর মানুষ পিছপা হচ্ছে না৷ ভোগবাদের মাদকের নেশা অন্যান্য সমস্ত নেশার মতই ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে পেতে আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ও গোষ্ঠী সমাজজীবনকে গ্রাস করছে৷ মদ, হেরোহিন প্রভৃতি মাদক দ্রব্যের নেশা যেমন কিছু জীবনকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে, এই ভোগসর্বস্বতাও ঠিক ওই ধরণের মদ বা হেরোইনের নেশারই মত সমাজজীবনকে গ্রাস করছে৷ এই ভোগসর্বস্বতা যেন এক ধরণের ভয়ঙ্কর রাক্ষস৷ তার হাত থেকে সমাজ আজ নিস্তারের রাস্তা পাচ্ছে না৷

এ থেকে একমাত্র নিস্তারের রাস্তা মূল্যভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, যে শিক্ষাব্যবস্থায় গোড়া থেকে মানুষকে শেখানো হবে নৈতিকতা, সমাজচেতনা আর তার সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷ আধ্যাত্মিক শিক্ষা মানে ‘রিলিজিয়াস টিচিং’এর কথা এখানে বলা হচ্ছে না৷ রিলিজিয়াস টিচিং তো বহু ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, অযৌক্তিক ডগ্মা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, প্রভৃতি শিক্ষা দেয়৷ আধ্যাত্মিক শিক্ষার সঙ্গে এ ধরণের কোনো অযৌক্তিক ডগ্মা ভিত্তিক শিক্ষার কোনোমাত্র সম্পর্ক নেই৷ আধ্যাত্মিক শিক্ষার মূল কথা হ’ল বিশ্বের সমস্ত মানুষ এক বিশ্বপিতার সন্তান৷ ঈশ্বর, ব্রহ্ম, আত্মা, গড্–একই পরমসত্তার চিত্রনাট্য৷ এই বোধই মানুষের মধ্যে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বোধ (বিশ্বের সবাই ভাই–বোন) জাগাবে৷ বিশ্বের সমস্ত সম্পদেরও প্রকৃত মালিক সেই বিশ্বপিতা ব্রহ্ম৷ তাই এই বিশ্বের সমস্ত সম্পদেও বিশ্বের সবার অধিকার রয়েছে৷ আর মানুষের জীবনের প্রকৃত আদর্শ হ’ল ‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’–আত্মমুক্তি অর্থ অণুর সঙ্গে ভূমার (ব্রহ্মের) মিলন ও জগতের কল্যাণ৷ ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’৷

দুঃখের কথা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও দেশে আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা তৈরী হ’ল না৷ যে যখন ক্ষমতায় আসে তার দলীয় মতবাদের ছাঁচে শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে চায়, তাই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কখনও লালকরণের ও কখনও গেরুয়া করণের  অভিযোগ ওঠে৷ সোভিয়েত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ  লিখেছেন– ‘‘শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে এরা  ছাঁচ বানিয়েছে, কিন্তু ছাঁচে ঢ়ালা মনুষ্যত্ব কখনও টেকে না৷ সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যারতত্ত্ব যদি না মেলে তবে ছাঁচ ফেটে চৌচির হয়ে যাবে, নতুবা মানুষের  মন যাবে মরে, মানুষ হয়ে যাবে   কলের পুতুল৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গেছে৷ কিন্তু সেখান থেকে আমাদের রাষ্ট্রনেতারা কোন শিক্ষা নেয়নি৷ তাই যে দল যখন ক্ষমতায় আসে তারমত করে শিক্ষার ছাঁচ বানিয়ে  সরলমতি ছাত্র–ছাত্রাদের  পলিটিক্যাল ডল বানার প্রয়াস করে৷ তারই বিষময় ফল ফলছে শিক্ষার অঙ্গনে৷ বিষাক্ত করে তুলছে সমাজকে৷

বিদ্যার তত্ত্বের সঙ্গে সজীব মনের তত্ত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে নব্যমানবতাবাদী আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেছেন মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ যাঁরা সমাজের সার্বিক কল্যাণের চিন্তায় রত তাঁদের অবিলম্বে এগিয়ে আসা উচিত  এই নব্যমানবতাবাদী শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে৷ আজ যতরকম সামাজিক রোস সমাজকে বিধ্বস্ত করছে তার মূল কারণ শিক্ষায় গলদ৷

শিক্ষার যে মূল বিষয়–অর্থাৎ কে শিখাইবে, কি শিখাইবে৷ অর্থাৎ শিক্ষক ও শিক্ষার বিষয়বস্তু ঠিক করাটাই গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ মানুষকে মানুষ করে গড়ে তোলার কাজটা শিক্ষার শুরু থেকে করতে হবে৷ তাই শিক্ষা ব্যবস্থাকে নূতন করে ঢ়েলে সাজাতে হবে৷ শিক্ষার প্রতিটি মাধ্যমকেই আদর্শ শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে৷

বিশ্বকবির কথায়– তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী৷ মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবেই মানুষ৷ সেই চেষ্টাটা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু করতে হবে৷

 স্কুল–কলেজ যেমন শিক্ষার মাধ্যম, তেমনি, দূরদর্শন, পত্র–পত্রিকা প্রভৃতি গণমাধ্যমগুলি বা শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাও শিক্ষার মাধ্যম৷ আজকে সমাজ ব্যবস্থাকে শোধরাতে গেলে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই এক যোগে এই দায়িত্ব নিতে হবে৷ আজকের বুদ্ধিজীবী সমাজকেও নিরর্থক বৌদ্ধিক ‘কচ্কচানি’ ছেড়ে মানুষের ত্রিস্তরীয় কল্যাণের কথা অর্থাৎ দৈহিক, সমাজের সামাজিক–র্থনৈতিক প্রভৃতি স্থূল জাগতিক ও তৎসহ মানসিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণের কথা ভেবে সমাজ–কল্যাণ ব্রত নিতে হবে৷ এ ছাড়া সমাজ–সভ্যতাকে বাঁচানো যাবে না৷