(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
জাতীয়তাবাদের নামে হোক বা মানবতাবাদের নামে হোক এই শোষণের নিদান কোন চিন্তাবিদ্ আজও দেন নাই৷ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার এর নিদান দিয়েছেন যে এর জন্য চাই বিশ্বৈকতাবাদী মনোভাবের সঙ্গে শোষণ বিরোধী মনোভাব৷ অর্থাৎ মানুষের মূল লক্ষ্য হবে বিশ্বৈকতাবাদ ও নব্যমানবতাবাদ, কিন্তু যতক্ষণ কোনস্থানের বা কোন গোষ্ঠীর ওপরে থাকবে শোষণ ততক্ষণ রাখতে হবে শোষণ বিরোধী আন্দোলন ও মনোভাব৷ তখন আর পরিবার বা গোষ্ঠী বা জাতির ওপর বা প্রদেশ বা রাজ্যের ওপর শোষণের জন্য আন্দোলন বা আন্দোলনের মনোভাব ভৌম ভাবাবেগ যা সামাজিক ভাবাবেগ নয়, যা নব্যমানবতাবাদী ভাবধারা বিরোধী নয়,কারণ মূল লক্ষ্য থেকে গেছে বিশ্বৈকতাবাদীভাব বা বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ৷ যেখানে বিশ্বৈকতাবাদী মনোভাব বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ নেই সেখানে ভৌমভাবাবেগ ও সামাজিক ভাবাবেগ বিপজ্জনক৷ যেমন আসামের অসমীয়াদের আসামী ভাবাবেগ ভৌম ও সামাজিক ভাবাবেগ যার ফলশ্রুতি দেখা গেছে বাঙালী নিধন যজ্ঞ৷ লালু যাদবের নিম্ন জাতির, ভাবপ্রবণতা এনেছে উচ্চজাতি ব্রাহ্মণ, ভূমিহার, রাজপুত সংঘাত৷ সুতরাং বিশ্বৈকতাবাদ বা বিশ্বভ্রাতৃত্ব ভাবধারার সঙ্গে চাই শোষণ বিরোধীভাব ধারা যাকে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন জনপ্রিয় ভাবধারা৷ শোষণ করা মানে অমানবিক কার্যধারা৷ সেই অমানবিক কাজকে রোধ করা মানে হলো মানবিকতা৷ তাই গোষ্ঠী বা জাতি বা পরিবারের উপর অত্যাচার শোষণ চলতে থাকবে আর মানবতার নামে চুপ থাকব তা দূর না করতে নিষ্ক্রিয় থাকব তা কোনদিন মানবিকতা নয়৷ যে কোন ধরনের শোষণ তা ব্যষ্টির ওপর হোক বা পরিবারের ওপর হোক বা জাতি বা প্রদেশের ওপর হোক তা অমানবিক ও তা দূর করা ভৌম ভাবাবেগ নয় সামাজিক ভাবাবেগ নয় এ হবে মানবতাবাদী তথা নব্য মানবতাবাদী মনোভাব৷ ‘আমরা বাঙালী’ আবেগ কোন ক্ষুদ্র ভৌম ভাবাবেগ বা সামাজিক ভাবাবেগ নয়৷ কারণ এ হলো বাংলার ওপর শোষণ দূর করবার জন্য বাঙালীদের মধ্যে ঐক্য আনার আবেগ৷ আর এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠা বা বিশ্ব সরকার গড়ে তোলা প্রাউট অর্থনীতির প্রেষণায়৷ ভারতে যে ৪৪টি সমাজ বা সভ্যতা আছে আর সারা বিশ্বে যে ২৫৬টি সভ্যতা বা সমাজ আছে সেসব সমাজের আপন আপন ভাষা-সংসৃকতি ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ভিত্তিতে ওই সমাজগুলির মধ্যে ঐক্য আনা আর তারপর ওই সমাজগুলি নিয়ে বিশ্বসরকার গড়ে তোলা ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা৷ বিশ্ব সরকার বা এক মানবসমাজ গড়ে তোলার ভিত্তি হলো শোষণমুক্ত ওই ২৫৬টি সভ্যতা৷ বাঙালী সভ্যতার মানুষের ঐক্যের জন্য যেমন চাই ‘আমরা বাঙালী’’ ভাবাবেগ, তেমনি অঙ্গ দেশের ওপর ভাষা-সংসৃকতি ও অর্থনৈতিক শোষণের জন্য অঙ্গিকা সমাজ ভাবাবেগ, তেমনি ভোজপুরী ভাষাভাষীদের জন্য ‘ভোজপুরী’ ভাবাবেগ৷ পাঞ্জাবী সভ্যতার জন্য পাঞ্জাবী ভাবাবেগ এইভাবে ২৫৬টি সমাজের আপন আপন ভাবাবেগে৷ অর্থাৎ যাতে আপন আপন সভ্যতার ভাষা-সংসৃকতি ঐতিহ্য বজায় থাকে ও আর্থিক শোষণমুক্ত হয় তার জন্য একতা আমার জন্য ব্যবস্থা করা ও সবপ্রকার শোষণ দূর করা৷ যতদিন মানুষ শোষণ করবে ততদিন বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হতে পারে না৷ যদিও বিশ্বের সভ্যতাগুলি বা সমাজগুলি তথা বাঙালীর সমাজের বাঙালী আবেগ আঞ্চলিক মনে হয়, নামে আঞ্চলিক অভিপ্রকাশ হলেও সব সমাজের মধ্যে একটি লক্ষ্য বিশ্বৈকতাবাদ বা বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধ৷ তাই আঞ্চলিক অভিপ্রকাশ হলেও কিন্তু প্রতিটি সমাজের অন্তর্নিহিত স্পিরিট হল এক মানবসমাজ, এক বিশ্ব সরকার ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধ৷ তাই ‘আমরা বাঙালী ও ভারতের ৪৪ টি সমাজ তথা সারা বিশ্বের জন্য২৫৬টি সভ্যতা সমাজ কোন সংকীর্ণ ভৌম প্রবণতা বা সামাজিক ভাব প্রবণতা নয়৷ সমাজগুলির মূল ভাব হলে সংশ্লেষনাত্মক, কোন বিশ্লেষণাত্মক মনোভাব বা ভাবধারা নয়৷
এখন বাঙলার শোষক কারা? যারা জাতীয়তাবাদের সুযোগে বাংলার অর্থকে বাঙলার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, বাঙলাতে সস্তা মার্র্ক হিন্দি সংসৃকতি ঢুকাচ্ছে, বাংলাভাষাকে দমন ও উপেক্ষা করে চলছে আর বাঙালী হয়েও ক্ষমতা লাভের জন্য যা অর্থলোভে, কায়েমী স্বার্থপূর্ত্তির জন্যে বহিরাগতদের মদত দিচ্ছে, বাঙালী হয়ে বাঙালীকে শোষণ করছে ও সেই সঙ্গে বাঙালীর ঐক্য নষ্ট করতে সাহায্য করছে তারা বাঙালী হলেও বাঙলার প্রথম শ্রেণীর শত্রু৷ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বকবি-বিশ্বৈকতাবাদী, কোন সাম্প্রদায়িক বা সংকীর্ণ ভাবধারাকে প্রশ্রয় দিতেন না৷ কিন্তু বঙ্গভঙ্গের সময় বাঙালী ঐক্য আনার জন্য বাঙালী ভাবাবেগ জাগাতে কলম ধরলেন---
বাঙলার মাটি, বাঙলার জল
বাঙলার বায়ু বাঙলার ফল
পুন্য হউক পুন্য হউক হে ভগবান৷
বাঙালীর প্রাণ বাঙালীর মন
বাঙালীর ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক এক হউক হে ভগবান৷
তিনি এও বললেন যে--- ‘‘বাঙালী অদৃষ্ট কর্ত্তৃক অপমানিত হয়ে মরবে না, সাংঘাতিক মার খেয়েও বাঙালী মারের উপরে মাথা তুলবে৷ আর বললেন--- দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ের দুর্গম লক্ষ্যে গিয়ে পৌছবই যদি আমরা মিলতে পারি৷’’ অর্থাৎ ঐক্য আনতে পারি৷
কেবল বাঙালীর জন্য বাঙলাকে শোষণমুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলা নয়৷ বিশ্ব সরকার গড়ার ক্ষেত্রে, বিশ্বৈকতাবাদের জন্য বাঙলা অগ্রণী ভূমিকা নেবে৷
তাই বিশ্বের স্বার্থে, বিশ্বভ্রাতৃত্বের জন্যে বাঙালীকে এক হতে হবে ও শোষণমুক্ত বাংলা গড়ে ২৫৬টি সভ্যতা বা সমাজের কাছে দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হবে৷ বাঙালীর দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য যে বাঙলার সভ্যতা বিশ্বের সকল সভ্যতার শ্রেষ্ঠ তাই অন্য সব সভ্যতার অভিভাবকত্ব বাঙলাকে নিতে হবে৷
- Log in to post comments