ছিন্নভিন্ন  মানব সমাজকে  একসূত্রে  বাঁধতে  আজ একান্ত জরুরী আধ্যাত্মিক নবজাগরণ

লেখক
প্রভাত খাঁ

যে যাই বলুক  ও চিন্তা  করুক যা বাস্তব  সত্য তা হলো মানুষ  সমাজবদ্ধ প্রাণী৷ এই কারণেই  প্রাচীন ভারতবর্ষের  সমাজবেত্তাগণ ‘সংগচ্ছধবং’ মন্ত্রকে  চলার পথে  ধ্রুবতারা বলেই  মান্যতা দিয়েছেন৷

এই ‘সংগচ্ছধবং’ হলো  গণতন্ত্রের  সাফল্যের  চাবিকাঠি৷ এই চাবিকাঠিকে ফেলে যারা ছল-বল-কৌশলে সেই মানবসমাজের ঐক্য সংহতিকে  ধরে রাখার  ব্যর্থ চেষ্টা  করে তারা কেউই কোনদিন  সার্থক হয় না৷  মানুষকে  ধরে রাখার  জন্য যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন  সেটা হলো  বিশ্বৈকতাবোধকে জাগ্রত করা৷ বিশ্বৈকতাবোধ  জাগ্রত হবে  তখন  যখন  মানুষ অন্তরের সঙ্গে  বুঝবে যে তাঁদের  উৎস  সেই এক  অদ্বিতীয় পরমপিতা (পরমব্রহ্ম)৷ আমরা সবাই  নরনারী নির্বিশেষে  তাঁরই সৃষ্ট৷  যখন এই আত্মিক সম্পর্ককে সকলে  অন্তরের  সঙ্গে  মেনে নিতে পারবো তখনই আমরা  মানুষরা এক মানব সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব৷  এটাও চরম সত্য তা হলো পৃথিবীর  সৃষ্ট  সবকিছুই হলো  সেই পরম পিতারই সৃষ্টি৷ তাই  আমরা  সবাইয়ের  সঙ্গে ওতপ্রোতযোগে  বিধৃত৷  এটাই  হলো বৈচিত্রময় জগতের  ঐক্যের  সুর৷ একই  চন্দ্র-সূর্য্য একই বাতাস একই এই  ধরণী, জল ,আবহাওয়া আমাদের  বেঁচে  থাকার  পথে  সেবা দিয়ে  চলেছে৷ সবের মূলে  সেই বিরাটের শুভ ইচ্ছাশক্তিকে কাজ করে চলেছে৷ তাইতো  বলা হয়,  তার  ইচ্ছা ছাড়া  কিছুই হবার নয়৷  এটা  আপেক্ষিক  জগতে  সোজাভাবে  মেনে  নিতে বহু  দ্বিধা ও  বহু প্রশ্ণ এসে যায় মানুষের  মনে৷  এখানেই  হয়  নানা  গণ্ডগোল৷ আজ  কিন্তু ভৌতবিজ্ঞানের  উন্নতিতে  আমরা উপলদ্ধি করছি যে সারা পৃথিবী আজ একটা  বড়ো পরিবারের মতোই৷ আজ একদেশে  দুর্র্যেগ  দেখা দিল  অন্য  দেশের  ভাই বোনেরা ঝাঁপিয়ে  পড়ে রক্ষা করে৷  অন্তরের  ব্যাকুলতা  আশা আকাংক্ষা সব মানুষের একই৷  সকল  মানুষের  মধ্যে  রয়ে গেছে  স্নেহ মমতা এই শুভগুণগুলি৷  তাই আমরা  শুভের  কল্যাণের  চিন্তা করেই বাঁচবো  আর অন্যকে  বাঁচতে দেব৷  বাহিরে  আপাতদৃষ্টিতে শুধু  ভেদাভেদ ভিতরে সবই  এক৷ এই আধ্যাত্মিক  উপলব্ধি হলো  আমাদের  মিলনের একমাত্র পথ৷ তাই  এই আধ্যাত্মিকতার মন্ত্রে আমাদের দীক্ষিত  হয়ে  একসঙ্গে এগিয়ে  যেতে হবে৷ এ কাজের  একটি মাত্র  পথ আছে  আত্মবিশ্বাসে ভর করে সেই পরম স্রষ্টাকে পথপ্রদর্শক হিসাবে মেনে নিয়ে ভক্তির ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাইয়ের সাথে মিলেমিশে  একই সাথে  এগিয়ে চলা৷ এ পথে নিজেকে জানতে হবে, আত্মজ্ঞানের  সন্ধান করতে হবে৷ এরজন্য  আধ্যাত্মিক  সাধনা  করে  যেতে হবে৷ আর  নারায়ণজ্ঞানে  জীবের  সেবা করে যেতে হবে৷  এই বিশ্ব সংসারের স্রষ্টা যিনি  তাকে আনন্দ দেওয়ার  ব্রত হলো ভক্তি৷ এটি  হবে তাঁর ওপর বিশ্বাস  রেখে বৃহৎ ভাবনায়  ভাবিত  হয়ে চলা৷

এ বিশ্বের  সবাই  বা সবকিছু  যখন  ব্রহ্মের বিকাশ, তাই  মানুষ  সবাইকে  ভালবাসবে৷ ব্রহ্মের  বিকাশ  হিসেবে  সবার  সেবায়  আত্মনিয়োগ করবে৷

কিন্তু আজ মানুষ ধর্মের বাণীকে  বিকৃত করে ধর্মের  নামে জাত -পাত -সম্প্রদায় ভেদ সৃষ্টি  করে  মানবসমাজের  ঐক্য নষ্ট  করেছে৷  আমাদের  বুঝতে  হবে  একপিতার  পাঁচ সন্তান হলে, সন্তানদের পৃথকজাত বা সম্প্রদায় হতে পারে না৷  তাই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, পারস্পরিক  ঘৃণা, সংঘর্ষ কোনোদিন ধর্মের  পথ হতে পারে না৷

মানুষ বর্তমানে  প্রকৃত ধর্ম বা  আধ্যাত্মিকতাকে  ভুলে ধর্মকে  আপন  আপন সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির  কাজে  লাগাতে চাইছে৷  ধর্মকে  বিকৃত করে মানবসমাজকে  ধবংসের  পথে ঠেলে দিয়েছে৷

তাই বিংশ শতাব্দীতে  জগদ্গুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূত্তির্জী ধর্ম সম্পর্কে মানুষের সমস্ত বিভ্রান্তি ও ভুল ধারনা  দূর করে প্রকৃত  ধর্মের পথের  সন্ধান দিয়েছেন৷ তিনি  বলেছেন, সকল  মানুষই  এক পরমপিতার  সন্তান  তাই  সমস্ত  মানুষ  এক পরিবারের  সদস্যেরই  মত৷

তিনি বলেছেন, মানুষের  আদর্শ হ’ল---‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ অর্র্থৎ অন্তর্জগতে  আধ্যাত্মিক অনুশীলনের  মাধ্যমে  আত্মোন্নতি ঘটিয়ে  অণুর সঙ্গে  ভূমার  মিলন--- ব্রহ্মসম্প্রাপ্তি৷ আর, সামাজিক ক্ষেত্রে সবাইকে  সঙ্গে নিয়ে চলা৷  এক আদর্শ সমাজ সৃষ্টি করা৷ যাতে প্রতিটি মানুষের  অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা  ও বাসস্থানের  ব্যবস্থা  হয়--- তার  জন্যে সবাই  মিলিত প্রচেষ্টায় এক  উপযুক্ত  সামাজিক -অর্থনৈতিক  ব্যবস্থা গড়ে  তুলুক৷ সেই পথই তিনি  দেখিয়েছেন তাঁর  যুগান্তকারী ‘প্রাউট’ দর্শনের  মাধ্যমে৷ এই প্রাউটের  বাস্তবায়নের  মাধ্যমেই  বিশ্বের  সমস্ত  সমস্যার  সুষ্ঠু সমাধান করা যাবে৷ এটাই  আধ্যাত্মিক  নবজাগরণের  পথ৷  আজ  এই আধ্যাত্মিক নবজাগরণের  মাধ্যমেই  ছিন্ন ভিন্ন  সমাজকে   একসূত্রে  গেঁথে বিশ্বমানবতার  সুদৃঢ় ভিত্তি গড়ে  তুলতে হবে৷