দানবীয় সাম্প্রদায়িকতা গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেছে৷

লেখক
প্রভাত খাঁ

বেনিয়া ব্রিটিশ নীতি হলো বিভেদ সৃষ্টি করো ও  শাসন করো৷ তাই তাদের দ্বারা ভারতকে টুকরো করা হয়েছে৷ দেশকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ইংরেজ দিয়েছে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার ভিত্তিতে৷ দেশকে রক্তাক্ত করে যাদের হাতে  তুলে দেওয়া হয় তারা সবাই ছিল ইংরেজের অনুগামী স্তাবক৷ তা না হলে অখন্ড ভারতবর্ষ  পূর্ণস্বাধীনতা লাভ করতো নেতাজী সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীর দ্বারা৷  সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে বাহিনী নিয়ে আসেন ও মনিপুরের মৈরানে ভারতীয় বাহিনীর পতাকা উত্তোলন করেন৷ তাতেই ভীত  ও সন্ত্রস্ত্র হয়  ইংরেজ  শাসক  ও এদেশের  রাজনৈতিক  দলগুলো৷ সেই কারণে  রাজনৈতিক দলের নেতারা লোকচক্ষে নেতাজীকে হেয় প্রতিপন্ন করতে কুৎসা রটায়৷ কিন্তু দেশবাসী তাদের মিথ্যাচারিতায় বিশ্বাস করেননি৷ জওহরলাল তো তরবারি দিয়ে সুভাষচন্দ্রকে আহ্বান করার  হুমকী দেন৷ কমিউনিষ্ট দলতো তাঁকে ‘তোজোর গাধা’ বলে কুৎসা রটনা করে৷ সেদিন সুভাষ বিরোধিতায় আর.এস.এসও পিছিয়ে থাকেনি৷

এদিকে গান্ধীজী ১৯৩৫ সালের সরকারের (ইংরেজ) সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা আইন সমর্থন করেননি, কিন্তু তার বিরুদ্ধেও যাননি, তিনি নীরব ছিলেন৷ কিন্তু মৌনতা সম্মতির লক্ষণ৷  তাই পরক্ষে গান্ধী সেই সাম্প্রদায়িক  বাঁটোয়ারা কে সমর্থন করেছিলেন৷ এটাই হলো কংগ্রেসের  হিমালয়ান ব্লান্ডার৷ অনেকেই বলে থাকে গান্ধীজী অনুগামীদের চাপেই নীরব থাকেন৷ জওহরলাল ও অন্যান্য নেতারা স্বাধীন ভারতের শাসনাধিকার লাভে ব্যাকুল ছিলেন,  সে স্বাধীনতা যেমনভাবেই আসুক৷ স্মরণে থাকে, এদেশের নেতাদের রেডিওতে, সংবাদ মাধ্যমে নেতাজী  বার বার  অনুরোধ  করেন দেশভাগ করে অপূর্ণ স্বাধীনতা যেন তাঁরা গ্রহণ না করেন৷ কিন্তু তাঁরা শোনেননি৷ মুসলীমলীগের মিঃজিন্না দেশভাগকে  অগ্রাধিকার দেন আর কংগ্রেসও তেমন ধৈর্য্য নিয়ে আন্দোলন করেনি পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য৷ ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটায় বাংলায় মুসলীম লীগের প্রাদেশিক শাসকগণ ইংরেজের প্ররোচনায়৷ তাই দেশ হয়ে গেল বিভক্ত৷ লক্ষ লক্ষ অসহায় অমুসলমান নরনারী ও শিশু উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে এলো আর হাজার হাজার  প্রাণ হারালো৷ আজ আমরা যে খণ্ডিত ভারতে বাস করছি, সেই ভারতেও অদ্যাবধি গণতন্ত্রের  নামে চলছে বেনিয়া শাসন, ইংরেজের ডিভাইড এ্যাণ্ড রুল নীতিকে হাতিয়ার করে৷ তাই ভারত যুক্তরাষ্ট্রে অতীতের ১৫ রাজ্য ও করদ রাজ্যগুলি নিয়ে  আজ ৩৫টা ছোট বড়ো রাজ্যের জন্ম হয়েছে সেখানে আঞ্চলিকতাবাদ  প্রবল থেকে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে৷ সাম্প্রদায়িকতাও দেশকে কুরে কুরে খাচ্ছে! শাসকদল তো গণতন্ত্রের নামে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে আর আজ পর্যন্ত ২০২০ সালেও পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সেই সাম্প্রদায়িকতাকেই হাতিয়ার করেই নির্বাচন করছে ও শাসন চালাচ্ছে৷ ১২ বারের অধিক নাগরিকত্ত্ব  আইনটাই সংশোধিত হয়েছে৷ বর্তমানে দেশবাসী আতঙ্কিত  ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাস করছেন৷

দেশের আর্থিক তথা সামাজিক  উন্নয়নটা চোখে পড়ার মতো নয়৷ চরম বেকার  সমস্যায় ও  দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে, নিরাপত্তা হীনতায় সারা ভারত আজ ক্ষতবিক্ষত ও ক্লান্ত৷ শাসকদল নিছক নোংরা দলবাজি, দলাদলি, দুর্নীতিতেই সিদ্ধ হস্ত৷ অর্থনীতিতে  ভারততো অনেকক্ষেত্রে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের থেকে নিম্নগামী৷ ভারতের বর্ত্তমান আর্থিক  উন্নয়ন প্রচণ্ডভাবেই নিম্নমুখী৷ সেদিকে সরকারের কোন  ভ্রুক্ষেপই নেই৷ মানুষকে চমকদিতে আকাশ অভিযান চন্দ্রাভিযান হচ্ছে, কিন্তু হতভাগ্য দেশের কোটি কোটি মানুষের  মাথার ওপরে ছাদ নেই,পেটে ভাত নেই, জনজীবনে নিরাপত্তা নেই, অনেকেরই পথেই জন্ম আর পথেই মৃত্যু হচ্ছে! কিন্তু নেতা মন্ত্রীদের নিরাপত্তায়  হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে৷ এ কেমন গণতন্ত্র?

অধিকাংশ জাতীয় দল ভেঙ্গে গেছে পারিবারিক দল হওয়াতে৷ পুরাতন কংগ্রেস আজ টিম টিম করছে৷ ইন্দিরার নব কংগ্রেসই দাবী করে আসল কংগ্রেস দল বলে৷ ইতিহাস সেটা মানে না৷ ইতিহাস কখনোই কিছু বিস্মৃত হয় না৷

নেতাজী এই বাংলারই তরুণ কংগ্রেস নেতা যিনি আই.সি.এস পাশ করে ইংরেজের চাকরী না করেই দেশসেবায় মন দিয়েছিলেন, দেশবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে৷  তিনি  দেখেছেন ও সহ্য করেছেন ইংরেজের নির্মম  অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা যেটা গান্ধিজির কংগ্রেসের-তরুণ নেতাদের কখনও করতে হয়নি৷ নেতাজী  বীরের মতো সংগ্রাম করে কারাবাস সহ্য করে গেছেন কিন্তু ইংরেজেেের সঙ্গে কোনো আপোস করেননি৷ তাই  ইংরেজ নেতাজীকে ভয় করতেন৷ 

কিন্তু গান্ধীজির মতাদর্শ ছিল বেশ কিছুটা  নরম৷  তাই ইংরেজদের  আচরণ তাদের প্রতি ততটা কঠোর ছিল না৷ তরুণ নেতা  সুভাষ গান্ধীজির কংগ্রেস দলে যোগ দিয়ে ভারতবর্ষের অখণ্ড পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপ্ণ দেখতেন৷  কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে গান্ধীজির মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে জয়ী হন সুভাষচন্দ্র৷ কিন্তু নেতাজীর কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার বিষয়টিকে গান্ধী অনুগামীরা মেনে নিতে পারেনি৷ তাদেরই চক্রান্তে নেতাজী কংগ্রেস সভাপতির পদ ত্যাগ করেন ও নোতুন দল ঘটন করে নাম দেন ফরোয়ার্ড ব্লক৷

ইংরেজের  কঠোর দৃষ্টি পড়ে তাঁর উপর৷ তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার  জন্য চিন্তা করেন৷ তাই ছদ্মবেশে দেশ ত্যাগ করেন৷  তিনি জার্র্মনে গিয়ে ইংরেজের শত্রু হিট্লারের সঙ্গে যোগযোগ করেন ইংরেজ বিতাড়ণের লক্ষ্যে৷   কিন্তু সুদূর জার্র্মন থেকে  ভারত সীমান্তে লড়াই সম্ভব নয় বলে  তিনি সাবমেরিনে জাপান পাড়ি দেন৷ সেখানে তখন তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিলেন আর এক মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু৷ জাপানে বিপ্লবী রাসবিহারীর সঙ্গে  সাক্ষাৎ করেন তিনি তাঁর সৃষ্টি আজাদ হিন্দবাহিনীর (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হাতে ইংরেজ সৈন্য হিসাবে বন্দী হন, তাঁদের নিয়ে আগেই রাসবিহারী সিঙ্গাপুরে এই বাহিনী ঘটন করেন) দায়িত্ব নেন ভারতবর্ষের মুক্তির উদ্দেশ্যে৷ জাপান সরকার অক্ষশক্তির পক্ষ থেকে সব রকম সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দেন সুভাষকে৷  রাসবিহারী বার্দ্ধক্য হেতু সুভাষচন্দ্রকে আই .এন.এ বাহিনীর  সর্বাধিনায়ক করেন৷ সুভাষ বাহিনী নিয়ে দিল্লি চলো অভিযান করেন  ইংরেজ সরকারকে উৎখাতের জন্য৷ এটাই এদেশের নেতাদের  চোখে অসহ্য হয়৷ তাই তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে চরিত্রহনন করে ও দেশবাসীকে ভুল বোঝায়৷ সেদিন সুভাষ বিরোধিতায়  কংগ্রেস কমিউনিষ্ট আর.এস.এস এক মঞ্চে ছিল৷ নেতাজীর মৃত্যু রহস্যটা ছিল এই মঞ্চেরই চক্রান্ত যা  সম্পূর্ণ মিথ্যা এক গল্প৷ নিজেরা দেশ স্বাধীন করেছে সেটা খাড়া করতেই তাই-হকু-বিমান বন্দরে  তাঁর  বিমানে দুঘর্টনার গল্প ফাঁদে৷ 

আর এই দেশের  স্বাধীনতাটা যে কতো বড়ো এক ভাঁওতা, যা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার মতো অভিশপ্ত সিদ্ধান্ত সেটা আজ দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন!

এই সেদিন দিল্লীতে যে নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটে গেল, ঘর-বাড়ি , দোকান-বাজার ভস্মীভূত হল, ৫০ এরও বেশি নিরীহ মানুষের প্রাণ গেল, তার দায় কেন্দ্রীয় সরকার অস্বীকার করতে পারে না৷ এই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতাই ভারতীয় গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেছে৷

তাই গণতন্ত্রকে বাঁচাতে প্রয়োজন সেই অধ্যাত্মবাদ যেখানে বলা হয়েছে মানবজাতি এক ও অভিভাজ্য, সবাই অমৃতের পুত্র৷ জাতপাত-ভেদাভেদ স্বার্থান্বেষী মানুষের সৃষ্ট বিশ্বপিতার  পৃথিবীতে৷ মানবতাকে, বিশ্বৈকতাবাদকে আশ্রয় করেই সার্থক গণতন্ত্র ঘটন করতে হবে৷ যেখানে সবাই সমান অধিকার পাবে৷

 ভারতের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ কিন্তু সব মানুষের  ধর্ম এক,  ধর্মমত  তথা ধর্মীয় বিশ্বাস  ভিন্নভিন্ন হয়৷ যেমন , হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান ধর্মমত ইত্যাদি৷

সাম্প্রদায়িকতার যে ভয়াবহতা দেশকে খণ্ডিত করেছে, ভারতবাসী আজও সেই অভিশপ্ত সাম্প্রদায়িকতার রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়নি৷ অতীব লজ্জার কথা এই সাম্রদায়িকতাকেই হাতিয়ার করে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখছে, ক্ষমতা দখল করছে৷ মানুষ দিশাহারা একটু নিরাপদ আশ্রয় ও শান্তিতে বাস করার পথ খুঁজছে৷ বহুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ---

‘‘নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে  বিষাক্ত নিঃশ্বাস,

শান্তির ললিতবাণী শোণাইতিছে ব্যর্থ পরিহাস৷৷’’

তাই বিদায় নেবার আগে ডাক দিয়ে যাই

দানবের সাথে সংগ্রামের তরে,

প্রস্তুত হতেছে যারা ঘরে ঘরে৷৷

সেই দানবীয় শক্তি আজও গণতন্ত্রের মুখোশ ধরে দেশের শাসক হয়ে বসে আছে৷ তাই রবীন্দ্রনাথের সেদিনের আহ্বান আজও সমানভাবে প্রযোজ্য৷

পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমান জগতের  একমাত্র  সর্বরোগ হর বিশল্যকরণী হলো প্রগতিশীল উপযোগ  তত্ত্ব ---‘প্রাউট ’৷  এটি একটি সামাজিক  অর্থনৈতিক তত্ত্ব যা  পৃথিবীর সকল জীবজন্তু, গাছপালা বিশেষ করে সমগ্র মানবসমাজের এক আদর্শে চলার পথের নির্দেশনা৷ এটি দিয়েছেন মহান দার্শনিক  শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার  যিনি আধ্যাত্মিক জগতে মার্গগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী নামে পরিচিত৷ তাঁর প্রদর্শিত পথেই দানবীয় শক্তির বিনাস ঘটিয়ে সর্বগ্লানীমুক্ত, সর্বকলুষমুক্ত, সর্বশোষণমুক্ত এক মানব সমাজ ঘটন সম্ভব৷