পূর্ব প্রকাশিতের পর
এই নেশন -হীন মাৎস্যন্যায়ের chaos) যুগেই ভারতবর্ষে দেখা দিল বৌদ্ধবিপ্লব জীবনাদর্শ আবার নূতন করে একদল মানুষকে ঐক্যসূত্রে বাঁধল৷ একটি নূতন নেশন তারা গড়ে তুলল৷ গোড়ার দিকে অ-বৌদ্ধরা ছিল -ছিল-বিচ্ছিন্ন, তাই তারা নিজেদের নিয়ে কোন নেশন গড়ে তুলতে পারেনি৷ কিন্তু ক্ষমতার মোহে মত্ত হয়ে তথা রাজশক্তির প্ররোচনায় বৌদ্ধরা যখন অ-বৌদ্ধের উপর অবিচার আরম্ভ করল তখন অবৌদ্ধের মধ্যে জেগে উঠল এক বৌদ্ধবিরোধী সেন্টিমেন্ট anti-Buddhist sentiment)৷ ঠিক যেমনটি জেগেছিল অনার্যের মধ্যে আর্যের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায়৷ বৌদ্ধযুগের শেষের দিকে তাই ভারতে দেখা দিয়েছিল মোটামুটি বিচারে দুটো নেশন৷ একটি বৌদ্ধ সেন্টিমেন্ট, অপরটি গড়ে ওঠা বৌদ্ধ -বিরোধী সেন্টিমেন্ট৷
ভিক্ষুদের অধঃপতনের ফলে, মঠের ও সংঘের নানা গোলযোগে, রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ও সর্র্বেপরি বৌদ্ধ সমাজে নাম করা দার্শনিক পন্ডিতের অভাব ঘটায় ও অপরপক্ষে অ-বৌদ্ধদের রাজশক্তির সাহায্য থাকায় ও শংকরাচার্যের মত মহাপন্ডিত ও মহাতার্কিকের আবির্র্ভব হওয়ায় ভারতবর্ষে বৌদ্ধরা শুধু পরাজিতই নয় , ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে যায়৷
এর ফলে বৌদ্ধ নেশনের মৃত্যু ঘটল৷ শঙ্করাচার্য ও বিভিন্ন অ-বৌদ্ধ রাজার সহযোগিতায় যে নূতন সেন্টিমেন্ট ভারতবর্ষে গড়ে উঠল, যাকে সনাতনী বা ব্রাহ্মণ্য মতবাদ বলা হয়, তার প্রতিষ্ঠা ছিল মূলতঃ বৌদ্ধবিরোধী মনোভাবের ওপর৷ তাই বৌদ্ধ নেশনের মৃত্যু ঘটবার পর এই ব্রাহ্মণ্য নেশন বেশী দিন টিকে থাকতে পারেনি৷ ভারতবর্ষে আবার দেখা দিল নেশন-হীন অবস্থা৷
বৈদিকোত্তর যুগে ভারতবর্ষে যখন আর্য ও অনার্য দুটি নেশনের মৃত্যু ঘটেছিল তখন বাইরে থেকে কোনও আক্রমণ হয়নি৷ দেশের ভেতরেই ঘটেছিল বৌদ্ধ বিপ্লব৷ যদি সে সময় বাইরে থেকে কোন বড় রকমের আক্রমণ হ’ত তাহলে আক্রমণকারীরা অনায়াসেই তৎকালীন নেশন-হীন ভারতবর্ষকে দখল করে নিতে পারত৷ কিন্তু ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য, যখন বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য--- নেশনের মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার এদেশ নেশন-হীন হ’ল তখন কোন অভ্যন্তরীণ বিপ্লব দেখা দিল না৷ ঘটল বাইরে থেকে মুসলমান আক্রমণ৷
বৌদ্ধ ধর্ম ভারতবর্ষ থেকে সম্পূর্ণভাবে যখন বিলুপ্ত হ’ল তার কিছুকাল পরে ব্রাহ্মণ্য নেশনের মৃত্যু হ’ল কেবল তখনই মুসলমানরা ভারত জয় করতে পেরেছিল৷ তার আগে পারে নি ৷ সিন্ধুদেশ আক্রমণ করার পর তাদের অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল৷ দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ্য নেশনগুলিও একক ভাবে নিতান্ত দুর্বল ছিল না, আর তাই তারা শেষ পর্যন্ত মুসলমান আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল৷
মুসলমানরা ভারতবর্ষে আসার পর এদেশে দেখা দিল একটা নূতন মুসলমান নেশন৷ তাদের ছিল নিজস্ব ভাষা(গোড়ার দিকে তুর্কী, পরে ফার্সী) নিজস্ব আচার-ব্যবহার , পোষাক -পরিচ্ছদ, রক্তধারা, জীবনযাত্রা প্রণালী ও ধর্মমত, আর এর সঙ্গে ছিল ওইগুলির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটা বিজয়ী সেন্টিমেন্ট৷ একথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে সেকালের সেই বিজয়ী মুসলমান নেশন ভারতবর্ষের তৎকালীন অধিবাসীদের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করেছিল ৷ যেমনটি করেছিল অনার্যের উপর আর্য, অবৌদ্ধের উপর বৌদ্ধ, বৌদ্ধের উপর ব্রাহ্মণ্য নেশন৷ অ-মুসলমানদের ওপর মুসলমানদের অত্যাচার অ-মুসলমানদের নূতনভাবে একতাবদ্ধ করল৷ তাদের মধ্যে দেখা দিল পাল্টা মুসলমান বিরোধী সেন্টিমেন্ট anti-Muslim sentiment) ৷ ভারতবর্ষে দেখা দিল দুটি নেশন--- একটি নেশন খাড়া করল ফার্সী ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিজয়ী মুসলিম সেন্টিমেন্ট, অপরটি ভারতের সাবেকী ভাষা সংসৃকতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা হিন্দু সেন্টিমেন্ট ৷ ভারতে দীর্ঘকাল ধরে পাশাপাশি এই দ’টো নেশন বেঁচে রইল৷
মুসলমান নেশন চলেছিল একটি সম্পূর্ণ নূতন ধরনের সেন্টিমেন্টকে আশ্রয় করে কিন্তু ততখানি জোরালো সেন্টিমেন্ট অ-মুসলমান বা হিন্দুর ছিল না৷ তাই তাদের গড়ে উঠতে হয়েছিল সম্পূর্ণভাবে মুসলমান বিরোধী একটা সেন্টিমেন্ট অর্র্থৎ ব্রাহ্মণ্য নেশনের মত একটা ঋণাত্মক সেন্টিমেন্টের ভিত্তিতে৷ তাই ব্রাহ্মণ্য নেশনের নেতারা যেমন বৌদ্ধ-বিদ্বেষকে নিজেদের পুঁজি হিসেবে দেখেছিলেন ঠিক তেমনি হিন্দু নেশনের নেতারা পঁুজি করেছিলেন মুসলমান-বিদ্বেষকে৷ মুসলমান যা করবে হিন্দুকে তার ঠিক উল্টোটা করতে হবে৷ মুসলমান নামাজ পরবার সময় কাছা দেয় না, তাই হিন্দুকে কাছা দিয়ে কাপড় পড়তেই হবে৷ গোমাংস ও কুক্কুট মাংস মুসলমানদের অতি প্রিয়, তাই হিন্দুদের পক্ষে সেগুলি অভক্ষ্য৷ মুসলমান পশ্চিম মুখে উপাসনা করে,তাই হিন্দুর পশ্চিম উপাসনা নিষিদ্ধ৷ এধরনের আরও কত কী ! যাই হোক , এই ধরনের বিধি-নিষেধের ফল হিন্দু পক্ষে খারাপ হয়েছিল একথা বলতে পারি না ৷ এগুলোর সাহায্যে হিন্দুর মধ্যে মুসলিম বিরোধী সেন্টিমেন্ট ভালভাবেই গড়ে উঠেছিল৷ নইলে সেযুগে ভারতের অ-মুসলমানদের পক্ষে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হ’ত না৷
যেমন আমরা আর্য- অনার্যের ব্যাপারে দেখেছি যে পাশাপাশি দুটো নেশন দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের স্বতন্ত্র সেন্টিমেন্ট জীইয়ে রাখতে পারেনি, হুবহু তেমনিই ব্যাপার ঘটল হিন্দু ও মুসলমান এই দুটি নেশনের ব্যাপারেও৷ মুসলমানের ভাষা ফার্সী ছিল সম্পূর্ণ বিদেশী ভাষা, আর হিন্দুর ভাষা প্রাকৃত ছিল ভারতের মাটিতে তৈরী৷ তাই শেষ পর্যন্ত প্রাকৃত-সঞ্জাত পূর্বী পাঞ্জাবী বা পশ্চিমী হিন্দীর সঙ্গে ফার্সী মিশিয়ে রাজধানীর মুসলমানেরা গড়ে তুলল একটি মিশ্র ভাষা যার নাম উর্দু ভাষা৷ এতে মুসলমানদের ন্যাশানাল সেন্টিমেন্ট কিছুটা চিড় খেয়ে গেল৷ হিন্দুদের সঙ্গে তাদের একটা বোঝাপড়ায় নামতে হ’ল ৷ হিন্দুদের অন্যান্য ভাষাতেও ঢুকল অজস্র ফার্সী শব্দ৷ জন্ম নিল হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ভাষা বাংলা, মৈথিলী, অসমিয়া , ভোজপুরী,গুজরাতী, পাঞ্জাবী প্রভৃতি ভাষাগুলি৷ (ক্রমশঃ)