দুর্গাপূজা ও কালীপূজা সম্পর্কে দু’চার কথা

লেখক
পথিক বর

প্রতি বছর দুর্গাপূজা ও কালী পূজা নিয়ে বাঙালীরা মেতে ওঠে৷ এটা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ কিন্তু এই দুর্গাপূজা ও কালীপূজা সম্পর্কে আমার মনে কিছু প্রশ্ণ জেগেছে৷

প্রথমতঃ হিন্দুধর্মে বেদকে প্রামাণিক (অথেন্টিক) ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়৷ সেই বেদের যে সার সেই উপনিষদে একমাত্র এক নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ পরম ব্রহ্মের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে৷ উপনিষদের ঋষিরা এক ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কোনো দেব–দেবীর অস্তিত্ব মেনে নেননি৷ তাঁরা বলেছেন, ব্রহ্মই সব কিছুর মূলে রয়েছেন৷ তিনি সমস্ত কিছুর স্রষ্টা৷ ব্রহ্মজ্ঞরা বলেন, সেই ব্রহ্ম যখন জগৎ সৃষ্টি করেন, তখন তাঁর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রহ্মা’৷ ‘অ’ হ’ল সৃষ্টির বীজমন্ত্র৷ ব্রহ্ম  অ ঞ্চ ব্রহ্মা৷ সেই একই ব্রহ্ম যখন জগৎ পালন ও পরিচালনা করছেন, তখন সেই ব্রহ্মেরই নাম দেওয়া হয়েছে বিষ্ণু৷ বিশ্ ধাতুর উত্তর ‘নু’ প্রত্যয়  করে ‘বিষ্ণু’ শব্দটা এসেছে অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টিতে যিনি অনুপ্রবিষ্ট হয়ে রয়েছেন, সর্বব্যাপী সত্তা৷ আবার সেই ব্রহ্মই যখন সব কিছু ‘লয়’ করছেন তখন তাঁর নাম ‘মহেশ্বর’৷ যার মানে বিশ্বের সকল আপাত নিয়ন্তার যিনি মূল নিয়ন্তা৷

ব্রহ্ম মূল চিতি শক্তি৷ সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তি সূর্য, চন্দ্র, পবন, অগ্ণি, সবই এক মূল শক্তিরই বিভিন্ন প্রকাশ৷ যেন এক সূর্য থেকে বিভিন্ন দিকে বিচ্ছুরিত কিরণ রাশি৷ এই অর্থে এই প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে ‘দেব’ নামে অভিহিত করা হয়েছে৷ বেদে ‘দেব’ বলতে সূর্য, চন্দ্র, অগ্ণি, পবন, ঊষা – এঁদেরই বলা হয়েছে৷ দুর্গা, কালি, মনসা প্রভৃতি দেবদেবীর কোনও উল্লেখ বেদে নেই৷ এদের উল্লেখ রয়েছে বিভিন্ন পুরাণে, যেগুলি আজ থেকে মাত্র ১৩০০ / ১৪০০ বছর আগের লেখা৷ আসলে এই পুরাণগুলি হ’ল লোকশিক্ষার্থে রচিত কাহিনী৷ বিভিন্ন কাহিনীর মাধ্যমে পুরাণকাররা লোকশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ ব্যাসদেব অষ্টাদশ পুরাণ রচনা করার পর নিজেই লিখেছেন,

‘‘রূপং রূপবিবর্জিতস্য ভবতো যদ্ধ্যানেন কল্পিতং

স্তত্যাহনির্বচনীয়ত্ গুরো দূরীকৃতা যন্ময়া৷

ব্যাপ্তিত্বং চ নিরাকৃতং ভগবতো যৎতীর্থযাত্রাদি না

ক্ষন্তব্যং জগদীশো তদ্বিকলতা দোষত্রয়ং মৎকৃতম্’’৷৷

অর্থাৎ ‘‘তোমার রূপ নেই, আমি তোমাকে রূপ দিতে গিয়ে ছোট করার চেষ্টা করেছি৷ তীর্থমাহাত্ম্য প্রচার করে আমি তোমার সর্বব্যাপকতায় বাধা দেবার চেষ্টা করেছি, স্তুতি করে আমি তোমার অনির্বচনীয়তাকে বাক্বদ্ধ করে ফেলেছি৷ হে জগদীশ, আমার চিত্তবিকলতা প্রসূত অপরাধত্রয়কে তুমি ক্ষমা কর৷’’

আবার বলা হয়েছে,

অষ্টাদশ পুরাণেষু ব্যাসস্য বচনাদ্বয়ম্৷

পরোপকার পুণ্যায় পাপায় পরনীড়ণম্৷৷

অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ রচনা করে ব্যাসদেব যে মূল উপদেশ দিতে চেয়েছিলেন, তা হ’ল পরোপকার হ’ল পুণ্য ও অন্যকে পীড়ন করা অর্থাৎ কষ্ট দেওয়াাটাই পাপ৷ ....... যাইহোক, পুরাণ হ’ল – লোক শিক্ষার্থে রচিত কাহিনী৷ এখানে কাহিনীটাকে যে সত্য হতে হবে নিশ্চয়ই তা নয়৷ এই কাহিনীর মাধ্যমে নীতিশিক্ষাটাকেই মূল বিবেচ্য বিষয় বলে গণ্য করা উচিত নয়৷

দুর্গাদেবীর উদ্ভবের ব্যাপারে পুরাণকার কথিত কাহিনী হচ্ছে দেবতারা যখন অসুরদের কাছে পরাজিত হয়ে স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত, তখন অসুর রাজা মহিষাসুরকে নিধন করার জন্যে দেবতারা উপায় খুঁজছেন৷ এখানে ‘দেবতা’ হ’ল সমাজের সৎ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের রূপক৷ আর ‘অসুর’ হ’ল ‘অত্যাচারী দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের রূপক৷’ পুরাণ অনুসারে অত্যাচারী মহিষাসুরের নিধনের জন্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আদি সমস্ত দেবতাদের ভেতর থেকে তীব্র জ্যোতি বেরিয়ে এল৷ তারপর সেই জ্যোতি দেবীমূর্ত্তি ধারণ করল৷ আর সেই দেবীকে সমস্ত দেবতারা তাদের নিজ নিজ অস্ত্র দিয়ে রণসাজে সজ্জিত করলেন৷ ইনিই দুর্গতিনাশিনী ‘দুর্গা’ নামে অভিহিত হলেন৷ এর অন্তর্নিহিত অর্থ এইটাই যে, সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সম্মিলিত শক্তিকেই বলা হচ্ছে অশুভশক্তিনাশিনী দুর্গা৷

সেই দুর্গার হাতে ‘মহিষাসুর’ রূপী অশুভ শক্তির বিনাশ হয়৷

একটা মজার কথা হ’ল, পুরাণের কাহিনী অনুসারেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের অঙ্গ থেকেই দুর্গার আবির্ভাব৷ তাহলে ‘দুর্গা’ শিবের ‘স্ত্রী’ হলেন কী করে?

‘পার্বতী’ আর ‘দুর্গা’ তো পুরাণ কথা অনুসারেও এক নয়৷ অথচ, অন্য পুরাণে দুর্গাকে শিবের স্ত্রী বলা হচ্ছে৷ তাহলে এটা স্ববিরোধিতা হচ্ছে না কি?

তেমনি পুরাণ অনুসারেই দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনের সময় সেই সমুদ্র মন্থন থেকে লক্ষ্মীর সৃষ্টি৷ তাহলে লক্ষ্মী শিবের কন্যা হলেন কী করে? ‘সরস্বতী’–কেও, কোনও কোনও পুরাণে বলা হচ্ছে ব্রহ্মার কন্যা৷ আবার কোনো কোনো পুরাণে বলা হচ্ছে শিবের কন্যা৷ অর্থাৎ পুরাণে পুরাণে বিরোধ৷ আসলে পুরাণ–কাহিনীর মধ্যেকার মূল নীতিবাক্যটাই গ্রহণীয়৷

এবার আমি দুর্গাপূজা সংক্রান্ত অন্য প্রসঙ্গে বিভিন্ন সাবেকী দুর্গাপূজায় ‘বলিদানে’–র প্রথা রয়েছে৷ শাস্ত্রে আছে – এই যুক্তিতেই ‘বলিপ্রথা’ আজও অব্যাহত৷ মানবিক কারণে অনেক ক্ষেত্রে পশুবলি বন্ধ করা হয়েছে – এটা ঠিকই৷ কিন্তু, ‘বলিপ্রথা’–র সমর্থনকারীরা বলছেন, ‘আমরা শাস্ত্র মেনে চলেছি৷ আমরা তো অন্যায় করছি না৷’ শাস্ত্রের উক্তি উদ্ধৃত করে তাঁরা বলছেন, ‘বলি না দিলে দেবী অসন্তুষ্ট হবেন ও অনেক অনর্থ হবে৷

এখন শাস্ত্রের কথাকে যদি অনড় মনে করেন, তাহলে আপনি কী বলবেন?

আসল কথাটা হ’ল পুরাণে রূপকার্থে অনেক কথা বলা হয়েছে, অনেক কাহিনীর উল্লেখ আছে, কিন্তু রূপকের আড়ালে বা ‘কাহিনী’–র আড়ালে মূল নীতিবাক্যটিকেই উদ্ধার করতে হবে৷ অনেক সিদ্ধ মহাপুরুষ বলেছেন, আসলে পুরাণকাররা মনের ‘পশুভাব’কে বলি দিতে বলেছেন –জীবন্ত ছাগ–মহিষকে বলি দিয়ে নিষ্ঠুরতার সাধনা করতে বলা হয়নি৷ তত্ত্বজ্ঞ ঋষি বলেছেন,

‘‘কেবলম্ শাস্ত্রমাশ্রিত্যং ন কর্ত্তব্যবিনির্ণয়ঃ৷

যুক্তিহীন বিচারে তু ধর্মহানি প্রজায়তে৷৷’’

–কেবল শাস্ত্রের উক্তির ওপর নির্ভর করে কর্তব্য নির্ধারণ করবে না৷ শাস্ত্রের কোনো কথা যদি যুক্তিহীন বলে বিবেচিত হয়, তাহলে তা অনুসরণ করলে ধর্মহানি হয়৷ তাই শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে এই বলি প্রথাকে কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না৷ এর বিরুদ্ধে সমস্ত যুক্তিবাদী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সরব হওয়া উচিত৷

দুর্গাপূজা বা কালীপূজার নামে মদ্যপান

সংবাদপত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে জানা গেল, এবার দুর্গাপূজার সময় মদ বিক্রি অন্যবারের চেয়ে বেশি হয়েছে৷ দুর্গাপূজায়, বিশেষ করে কালীপূজার সময় ‘মায়ের প্রসাদে’–র নাম করে মদ্যপান করাটা সম্পূর্ণ অনৈতিক কাজ, এ ব্যাপারে  কারুর কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়৷ তন্ত্রে সে পঞ্চ ‘ম’ কারের সাধনার উল্লেখ রয়েছে, এই পঞ্চ ‘ম’–এর সূক্ষ্ম অর্থ রয়েছে৷ সেই সূক্ষ্ম অর্থ না বুঝে উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় কি ধর্মসম্মত? মোটেই নয়৷ শাস্ত্রের নাম করে এসব বন্ধ করা উচিত৷

মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার বুদ্ধি–বিবেক, মদ্যপান সেই বুদ্ধি–বিবেক–কে আচ্ছন্ন করে দেয়৷ বুদ্ধি যখন কাজ করে না, তখন তাকে ‘মানুষ’ বলা যায় না, কারণ সে তখন বুদ্ধিবিবর্জিত অবস্থায় যা–ইচ্ছা–তাই করতে পারে৷ তাই এ ব্যাপারেও ‘মদ’ খাওয়ার সমর্থনে যে কোনো নির্দেশকেও অযৌক্তিক, অমানবিক বলতে হবে৷

ধর্মের সারকথা

‘ধর্মের’ মূল কথা হ’ল এক মনে ঈশ্বরের ধ্যান করা, অন্যদিক থেকে মনকে টেনে এনে ঈশ্বরের দিকে চালিত করা৷

‘‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী’’৷ অর্থাৎ মন যেমন চিন্তা করে তেমনি হয়৷ তাই মনকে যদি একাগ্র করে – এক মনে শুদ্ধ–পবিত্র– চৈতন্যস্বরূপ ঈশ্বরের চিন্তায় ডুবিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে মন শুদ্ধ–বুদ্ধ–পবিত্র– হয়ে উঠবে৷

ধর্মের এই সারকথাকে ভুলে আমরা ধর্মের নামে যা কিছুই করি না কেন, তাতে ধর্মকে বিকৃত করা হবে৷ আর, বর্তমানে ধর্মের নামে ধর্মের এই বিকৃতিকেই প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে –  যা মানুষের ব্যাষ্টিগত জীবনের পক্ষে ও সমাজের পক্ষে অমঙ্গলজনক – দারুণ ক্ষতিকর৷ এ ব্যাপারে সবাইকেই একটু চিন্তা–ভাবনা করতে অনুরোধ করি৷

অন্তর্জগতে অর্থাৎ মনে মনে যেমন আমরা ঈশ্বরের ধ্যান করব, তেমনি বহির্জগতে এই বিশ্বের সর্বসত্তা তথা সর্ববস্তু ঈশ্বরের প্রকাশ অর্থাৎ সবকিছুর মধ্যেই ঈশ্বর আছেন – এই ভাবনা নিয়ে আমরা জগতের সেবা করব৷ তাই ঈশ্বর চিন্তা ও জগতের সেবা – এটাই ধর্মের সারকথা৷

পঞ্চ ‘ম’ কারের মধ্যে ‘মদ্য’ হ’ল একটি ‘ম’৷ বলা হচ্ছে, তন্ত্র সাধনাকে নাকি সাধনার অঙ্গ হিসেবে ‘মদ্যপান’ করতে হয়৷ আসলে তন্ত্রোক্ত ‘মদ্যের’ সূক্ষ্ম অর্থ হল ঃ–

‘‘ সোমধারা ক্ষারেৎ যাতু ব্রহ্মরন্ধ্রাৎ বরাননে৷

পীত্বানন্দ ময়ং যস্তদ্ স এব মদ্য সাধকঃ৷’’

অর্থাৎ সাধনার ফলে ‘ব্রহ্মরন্ধ্র’ অর্থাৎ ‘পিনিয়্যাল গ্ল্যাণ্ড’ থেকে যে সোমধারা বা সুধারস (অর্থাৎ

মেলাটনিন হরমোন) ক্ষরিত হয়, সে সুধারস পান করাকে বলা হয় মদ্যপান৷

সাধারণ অবস্থায় মনের চঞ্চলতার জন্যে পিনিয়ালের ক্ষরিত হর্মোন নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু ধ্যানের দ্বারা মনকে স্থির ও শান্ত করলে ওই হরমোন সুষুম্না বেয়ে পড়তে থাকে ও নিম্নের চক্রগুলিকে সঞ্জীবিত করে ও মনকে আনন্দে আপ্লুত করে দেয়৷ এইটাই হ’ল প্রকৃতপক্ষে সাধকের ‘মদ্যপান’৷ তাই রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, ‘সুরা খাই না রে মন, সুধা খাই জয় কালী বলে৷’