কয়েক বছর আগে বিশ্ব ব্যাঙ্কের এক সমীক্ষায় বলা হয়, পৃথিবীতে আয় বৈষম্য ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ আরও বলা হয়েছে বিশ্বে দারিদ্র্য সীমারেখার নিম্নে রয়েছে ৭৬ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ৷ আজ পৃথিবীর প্রায় এক শতাংশ মানুষের কুক্ষিগত পৃথিবীর ৫০ শতাংশের বেশী সম্পদ৷ সমাজে দারিদ্র্য সীমারেখার নিম্নে যারা বসবাস করছে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি না হলেও গত দশ বছরে ভারতে কোটিপতিদের সম্পদ বেড়েছে দশ গুণ৷ এক বছরে ভারতের শীর্ষস্থানীয় পুঁজিপতিদের সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ ৫০,৪০০ কোটি টাকা৷ আর প্রতিদিনই এক-এক জনের গড়ে সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ ১.৩৮ কোটি টাকা৷ তাই দেখা যাচ্ছে পুঁজিপতিদের সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, অথচ কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় শুকিয়ে মরছে৷ অর্থাভাবে কত প্রতিভা যে বিকশিত হতে পারছে না---অঙ্কুরেই শুকিয়ে মরছে তার ইয়ত্তা নেই৷ অথচ অন্যদিকে চলছে অর্থের চরম অপচয়৷ একদিকে বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ অন্যদিকে লজ্জা নিবারণের বা প্রচণ্ড শীত থেকে বাঁচবার সামান্য বস্ত্রটুকু থেকে অনেকেই বঞ্চিত৷ কেন এই বৈষম্য৷ এ তো চরম অন্যায়৷
কেউ বলতে পারেন, যারা ধনী তারা বুদ্ধি খাটিয়ে পরিশ্রম করে তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করছে, তাতে তাদের দোষ কোথায়? তাছাড়া দেশের আইন মেনেই তো তারা ধনী হয়েছে বা সম্পদ আরও বৃদ্ধি করছে৷ তাতে তাদের অপরাধ কী?
ব্যাপারটা একটু গভীর ভাবে ভাবতে হবে৷ এই বিশ্বের সমস্ত সম্পদের প্রকৃত মালিক কোনো মানুষ নয়৷ কারণ কোনো মানুষ কোনো কিছু প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টি করেনি৷ মানুষ কেবল প্রাকৃতিক সম্পদের কিছু রূপ পরিবর্তন এনেছে অথবা বলতে পারি ঈশ্বরসৃষ্ট একাধিক মৌল পদার্থের মিশ্রণে বা রাসায়নিক যৌগ Physical mixture and chemical compound) তৈরী করেছে মাত্র৷ এই কারণে এ সবের প্রকৃত মালিক কোনও মানুষ হতে পারে না৷ এই প্রকৃত মালিক বিশ্বস্রষ্টা৷ বিশ্বের সমস্ত মানুষ তাঁরই সন্তান৷ তিনি সকলের পিতা৷ প্রাউট-প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, ‘বিশ্বের স্থাবর-অস্থাবর কোনও সম্পত্তি কারোর ব্যষ্টিগত সম্পত্তি নয়, সবকিছুই তাদের সকলকার পৈত্রিক সম্পত্তি, আর সেই পিতা হচ্ছেন ব্রহ্ম৷ জীব দায়ভাগ ব্যবস্থার পিতৃশাসিত একান্নবর্তী পরিবারের মত এই সম্পত্তি ভোগ করতে পারে মাত্র৷ একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের মত জীবের উচিত তাদের সাধারণ সম্পত্তি বা এজমালি সম্পত্তি উপযুক্তভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা, সেগুলো যাতে যথাযথভাবে কাজে লাগানো ও সবাই যাতে সমান অধিকারি নয়ে খেয়ে পড়ে সুস্থ শরীর, মন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করা৷’
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সম্পদ যখন সকলের পৈত্রিক সম্পদ তখন কারো ঘরে প্রাচুর্যের বিলাসিতার স্রোত বয়ে যাক, আর কেউ অনাহারে তিল তিল করে শুকিয়ে মরুক এ ব্যবস্থাকে ন্যায় সঙ্গত বলা যেতে পারে না৷
এটা ঠিক, বাস্তবের বিশ্বের সমস্ত মানুষের মধ্যে সব সম্পদ একেবারে সমান ভাবে ভাগ করে দেওয়া যায় না, বা মানুষের শ্রমের বা বুদ্ধির মূল্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করাও যায় না কিন্তু তাহলেও মানব সমাজের বিরাট আয় বৈষম্য থাকাও উচিত নয়, সম্পদ বণ্টন যুক্তিসঙ্গত হওয়া উচিত৷ সমাজের প্রতিটি মানুষ যেন যুগ অনুসারে জীবনের নূ্যনতম চাহিদা মেটানোর সুযোগ পায় প্রতিটি মানুষ যেন কর্ম করে তা প্রয়োজন মেটাবার সামগ্রিক সন্দেহের উপযোগী ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করতে পারে সে ব্যবস্থা করাটা প্রতিটি জনকল্যাণমূলক সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য৷
কোনও মানুষকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ সঞ্চয়ের অধিকার দেওয়া উচিত নয়, জমির ক্ষেত্রে যেমন সিলিং রাখা হয় তেমনি সম্পদের ক্ষেত্রেও সিলিং রাখা উচিত৷ কয়েকজনের ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ সম্পদ সঞ্চিত হতে থাকলে অন্যত্র চরম অভাব দেখা দেবেই কারণ পৃথিবীর সম্পদও তো সীমিত৷ তাই এই সম্পদের যুক্তি সঙ্গত বণ্টন চাই৷ নাহলে বঞ্চিতদের মধ্যে চরম বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ দানা বাঁধবেই৷
ধনীরা দেশের আইন মেনেই সম্পদ সঞ্চয় করেন---একথা বললে বলতে হয়, ইচ্ছেমত ধনসঞ্চয়ের অধিকার সংক্রান্ত আইনেরই পরিবর্তন হওয়া উচিত৷ এই অধিকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা উচিত৷ তার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের প্রতিটি মানুষেরই যুগোপযোগী ভাবে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের গ্যারাণ্টির স্বপক্ষে প্রবল জনমত গড়ে তোলা উচিত৷ নতুবা ধন-বৈষম্যের ন্যায় সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তির অন্য পথ নেই৷
- Log in to post comments