ধর্ম ও ধর্মমত

লেখক
পথিক বর

পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত রক্তপাত ঘটেছে ও ঘটছে তার অধিকাংশই ধর্মমতের লড়াই, সম্প্রতি প্যালেস্টাইন-ইজরায়েলের যে সংঘাত তার মূলেও আছে ধর্মমত৷ আমাদের দেশেও ধর্মমত সমাজের ভেদ বিদ্বেষের একটা অন্যতম কারণ৷ দেশটা ভাগও হয়েছে এই ধর্মমতকে কেন্দ্র করেই৷ কিন্তু মানুষের ধর্ম ও ধর্মমত ঠিক এক নয়৷ 

প্রকৃতপক্ষে এই রিলিজিয়ন বা ধর্মমত নিয়ে বর্তমানে  মানবসমাজে চরম অশান্তি চলছে৷ আমাদের দেশে এ তো এখন একটা প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে৷ আর এ নিয়ে যত সমস্যা৷ পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী লড়াই ও রক্তপাত হয়েছে এই রিলিজিয়নের  সেন্টিমেন্টকে কেন্দ্র করে৷

‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ নিয়ে  অজস্র সেমিনার, ভাবগম্ভীর আলোচনা, মিছিল, মিটিং, বৈঠক,চুক্তি হয়েছে তবু কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷

এরমূল কারণ হ’ল মানুষের রিলিজিয়ানের সেন্টিমেন্ট৷ কিন্তু এই  সেন্টিমেন্ট যে একেবারে ভ্রান্ত ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে  আছে, এই সত্যটা এতদিন সুষ্পষ্টভাবে মানবসমাজের সামনে তুলে ধরা হয়নি৷

বিংশ শতাব্দীতে  বিশ্ববিশ্রুত  ধর্মগুরু  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী, যাঁর লৌকিক নাম শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার --- যিনি যুগান্তকারী সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন ‘প্রাউটে’র প্রবক্তাও,সুস্পষ্টভাবে বলেছেন ধর্ম ও ‘রিলিজিয়ন’ প্রকৃতপক্ষে এক নয়৷  তিনি বলেছেন, রিলিজিয়ন  বহু কিন্তু সমস্ত  মানুষের একটাই  ধর্ম৷ কারণ কী? ধর্ম মানে সোজা কথায়  প্রতিটি সত্তার সত্তাগত বৈশিষ্ট্য৷ সে জীবিত সত্তা হোক বা বস্তু হোক, সবার ক্ষেত্রেই  প্রযোজ্য৷ প্রতিটি সত্তারই একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তার পরিচিতি বহন করে৷ যেমন আগুনের ধর্ম জ্বালিয়ে দেওয়া, জলের ধর্ম নীচের দিকে  গড়িয়ে  যাওয়া, চিনির ধর্ম মিষ্টত্ব  অর্র্থৎ প্রতিটি সত্তার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা থেকে  বোঝা যায়, সেটা সেই সত্তা বা বস্তু৷ কোনো সত্তা বা বস্তুর  ধর্ম জানতে হলে তার আচরণগত বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করতে হবে৷ প্রতিটি জীব সুখ চায়, অর্র্থৎ তার এটা অভাব রয়েছে তা পূরণ করতে চায়,সেই অভাব পূরণ হলে  সে সন্তুষ্ট হয়৷ যেমন একটা গোরু পেট ভরে খাবার পেলে সন্তুষ্ট আর কিছু চায় না৷ কিন্তু মানুষের চাওয়ার  শেষ নেই৷ পেট ভরলেও  মন ভরে না, সে যত পায় তত চায় ‘কবিগুরুর ভাষায় ‘যাহা পাই তাহা ভুল করে চাই,  যাহা  পাই তাহা চাই না৷’ তাই , আজ  যে মোটা ভাত মোটা কাপড় চায়, তা পেলে  সে বাড়ী, গাড়ী কত কিছু চায়, যত পায় তত চায়৷ এই যে অনন্ত চাহিদা  এটাই মানুষের ধর্মষ (‘বৃহদেষণা প্রণিধানঞ্চ ধর্ম’৷ সংস্কৃতে  বৃহৎ মানে সীমাহীন৷ মানুষের  মধ্যে  অসীমের  চাহিদা  রয়েছে, অসীমকে  পাওয়ার  জন্যে যে চেষ্টা--- তাই মানুষের ধর্ম৷

এখন অসীম কী? একমাত্র  ভূমা চৈতন্য ছাড়া কোনোকিছু অসীম নেই৷ তাই প্রকারান্তরে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি মানুষই সেই ভূমা-চৈতন্যকে অর্র্থৎ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকেই  চায়৷ এই ভূমা চৈতন্যকে পেলে তবে  সে পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করবে৷  এই ভূমা চৈতন্যকেই বলা হয় ঈশ্বর বা ব্রহ্ম৷ ভিন্ন ভাষায় একেই বলে গড্‌ বা আল্লা৷ বিশ্বের সমস্ত মানুষেরই এই সত্তাগত বৈশিষ্ট্য৷ তাই বিশ্বের সকল মানুষেরই ধর্ম একই, একে আমরা বলব মানবধর্ম৷ এই মানবধর্মের পথ ধরে মানুষ যত এগুবে ততই তার মন প্রসারিত হবে ও বিশ্বের সমস্ত সত্তার  প্রতি তার মমত্ব ও ভালবাসা বাড়বে৷ এটাই মানবতার পরাকাষ্ঠা৷ একেই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেন বিশ্বমানবতাবাদ৷ এটাই মনুষ্যত্বের চরম বিকাশের পথ ৷ তাই সংকীর্ণ বিশ্বাসকে  কেন্দ্র করে গড়ে  ওঠা রিলিজিয়ন নয়, মানবতার চরম বিকাশই মানুষের  প্রকৃত ধর্ম--- এটাই ‘মানবধর্ম’৷ বিশ্বের সমস্ত  আগুনের যেমন এক ধর্ম,  সমস্ত  জলের যেমন এক ধর্ম, সমস্ত মানুষেরও এক ধর্ম৷  তাই  রিলিজিয়নের বিকৃত ধারণা নিয়ে মানুষের  মধ্যে যে পারস্পরিক  দ্বেষ, বিদ্বেষ, ঘৃণা--- এসব সম্পূর্ণরূপ অবলুপ্ত হওয়া উচিত৷ মানবসমাজ এক ও  অবিভাজ্যা--- একে বিভিন্ন সেন্টিমেন্টে বিভক্ত হতে দেওয়া উচিত নয়৷ এজন্যে  রিলিজিয়নের সেন্টিমেন্ট মানুষের মন থেকে  সরিয়ে দেওয়া উচিত৷ মানবধর্ম সম্পর্কে বিশ্বকবি বলেছেন---‘পশু বলছে সহজ ধর্মের পথে ভোগ কর, মানুষ বলছে মানব ধর্মের সাধনা কর৷’ মানুষ যেদিন ধর্মমত নিয়ে ভেদ বিদ্বেষ ভুলে মনুষ্যত্ব অর্জনে দুঃসাধ্য সাধনা অর্থাৎ মানবধর্মের সাধনায় রত হবে সেদিনই তৈরি হবে এক অবিভাজ্য আদর্শ মানব সমাজ৷