ধর্ম সমীক্ষা

লেখক
শ্রী সুভাষপ্রকাশ পাল

১৯৮১ সালের আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি একটা সময় শুনতে পেলাম গুরুদেব শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি তাঁর গৃহী ভক্তদের তাঁর সঙ্গলাভের জন্য বিশেষ সুযোগ করে দিয়েছেন৷ সেই সাক্ষাৎকারের নাম ছিল ধর্মসমীক্ষা, সন্ন্যাসী দাদা-দিদিরা ৰাৰার সঙ্গ সহজেই পেতে সংঘের সাধারণ সম্পাদক G.S) ৰাৰার আপ্ত সহায়ক P.A) ও অন্যান্য পদাধিকারীদের বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতিদিনই ৰাৰার সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঘটত, আর যাঁরা দূরে বা বহির্ভারতে থাকতেন, তাঁরা মার্গের বিধি অনুযায়ী ১মাস বা ৩মাস বা ৬মাসে একবার ৰাৰার সঙ্গ পেতেন৷ ৰাৰা তাঁদের নিকট থেকে কাজের বিবরণ Report নেওয়ার সাথে সাথে সংঘের কাজ করতে ফের কী কী অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তা জেনে নিতেন, কখনও বা নিজে থেকে উল্লেখ করে সেগুলির সমাধান করে দিতেন, ব্যষ্টিগত কোন সমস্যা থাকলেও সেগুলির অযাচিতভাবে সমাধানের উপায় বলে দিতেন, গৃহী মার্গীদের ক্ষেত্রে ৰাৰার সান্নিধ্যে যাওয়ার অতখানি সুযোগ ছিল না, তাই কৃপা করে গৃহী মার্গীদের জন্য তাঁর এই উদ্যোগ, জেলায় জেলায় গৃহী মার্গীদের কাছেও সেই খবর পৌঁছে গেল৷ যাঁরা নিয়মিত দুবেলা সাধনা করেন,  যম-নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করেন, আন্তরিকভাবে বাবার কাজ করেন, তাঁরাই এই সুযোগ পাবেন, সমস্ত পৃথিবী থেকে দলে দলে মার্গীরা আসতে শুরু করেছেন, লেকগার্ডেনে তখন লোকে লোকারণ্য, তিল ধারণের জায়গা নেই৷

ওখানে গিয়ে নাম লেখাতে হত৷ কারা সুযোগ পাবেন ও কবে কখন সেই সুযোগ পাওয়া যাবে, তা জানিয়ে দেওয়া হত, স্ক্রুটিনির দায়িত্ব ছিল সবার পরিচিত রাসভারী সন্ন্যাসী আচার্য পূর্ণানন্দ অবধূতের উপর, খুব কড়া মেজাজের দাদা, তাঁর চোখকে ফাঁকি দিয়ে মাছি গলাবার জো নেই, আমিও নাম লেখালাম৷ দুবার কোলকাতা থেকে ফিরে এলাম, তৃতীয়বার বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হল,

একসঙ্গে ছজনের ডাক পড়ল,ৰাৰা আসনে বসে আছেন পাশে বিজয়ানন্দদা, তপেশ্বরানন্দদা, জগদীশ্বরানন্দদা, প্রণবানন্দদা প্রমুখ দাদারা দাঁড়িয়ে আছেন, সবার শেষে ছিল আমার নাম এক এক করে পূর্ববর্তী মার্গীদের ৰাৰার কাছে যাওয়ার ডাক পড়ল, ৰাৰা  প্রথমে প্রত্যেকের নাম পরিচয় ও কাজের হিসাব নিলেন শেষে জীবনে চলার পথে কী কী ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটেছে সেগুলি ধরিয়ে দিলেন ও যা করলে একজন আদর্শ মানুষ তথা আদর্শ মার্গী হতে পারবে তা বুঝিয়ে দিলেন৷ সবাইকে কম-বেশী শাস্তি দিলেন ও প্রত্যেকের জন্য তাঁদের উপযোগী বিশেস বিশেষ আসন, মুদ্রা বন্ধ ইত্যাদি অভ্যাস করার কথা বললেন৷

সবশেষে আমার পালা, আমি চিন্তা করলাম---আমার পূর্ববর্ত্তী মার্গী দাদাদের অনেক দোষ ত্রুটির কথা ৰাৰা উল্লেখ করেছেন, কেউ নামকরা মার্গী হয়েও এখনও ঘুষ নেন৷ কেউ বড় অফিসার পার্টিতে থেকে সবার অগোচরে মদ খান, কেউ মাতৃজাতির প্রতি যথোচিত ব্যবহার করেননি ইত্যাদি ইত্যাদি সে তুলনায় আমার ভুলত্রুটি নেই বললেই চলে৷ ৰাৰা প্রথমে নাম-ধাম এবং কাজের পরিচয় নিলেন৷ তারপর বলে চললেন ---ছেলেটিও ভাল শিক্ষাদীক্ষাও আছে, একজন শিক্ষিত ছেলের তো এই ভুলগুলো থাকা উচিত নয়, রাগতভাবে বললেন--- কিরে বলব নাকি সবার সামনে, সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন পরিচিত সন্ন্যাসী দাদারা বিশেষ করে আচার্য তপেশ্বরানন্দ অবধূত যিনি আমার লৌকিক সম্পর্কযুক্ত ব্যষ্টি আবার আমার শ্রদ্ধেয় আচার্যদেবও৷পুনরায় শুরু করলেন--- ‘‘তুমি ভুল ত করেছ পরন্তু যাকে যা দেবে বলেছিলে তা দাওনি কেন? জান না কাউকে কথা দিলে তা রাখতে হয়৷ এবার থেকে তা রাখবেতো? আমি ঘাড়ে নেড়ে সম্মতি জানালাম এবং এটাও বুঝলাম--- হাতে নাতে ধরা পড়ে গিয়েছি বাবার কাছে কিছুই লুকানো যাবে না, বাবা সবার  সবকিছু জানেন৷ বাবা জিজ্ঞেস করলেন--- কি শান্তি নোব? আমি শাস্তি প্রার্থনা করলাম, যে সমস্ত মার্গী দাদা ঐ ঘরে বসেছিলেন বাবা তাদের বললেন---Close your eyes’ এবার আমাকে পোষাক খুলতে বললেন, উপরের জামাটা খুললাম৷ দাদারা ইঙ্গিতে গেঞ্জিটাও খুলতে খুলতে বললেন, এতেও হল না, নির্দেশ এল-প্যান্টটাও খুলতে হবে, আমি ঘাবড়ে গেলাম, আমার ত শাস্তি কম হওয়ার কথা, ৰাৰা কী করতে যাচ্ছেন, বাবা এবার স্বহস্তস্থিত ছড়ি দিয়ে কোমরের দুপাশে প্রহার করতে লাগলেন, বলে চলেছেন--- কিরে আর ভুল করবি? আমি চিৎকার করে বলছি--- না ৰাৰা, না বাবা আর ভুল হবে না, কিন্তু কে শোনে কার কথা৷ তিনি কৃপা করে মেরেই চলেছেন, এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর দাদাদেরকে বললেন--- দেখত ওর চোখে জল এসেছে কিনা, সত্যি কথা বলতে আমার চোখে চট করে জল আসে না, চোখে জল আসেনি শুনে ৰাৰা পুনরায় প্রহার করতে শুরু করলেন৷ কখন প্রহার বন্ধ হয়েছে বুঝতে পারিনি, একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম, সম্বিত ফিরে পেলাম--- যখন বাবা আদর করে কাছে ডাকছেন---‘আয়, আমার কোলে আয়, কোলে বসিয়ে আদর করতে করতে বললেন---‘কি রে এবার ভাল হবি না ভাল হয়ে গিয়েছিস? বাবার বেত্রাঘাতের যন্ত্রণা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল, আমি বললাম---ৰাৰা! আমি ভাল হয়ে গিয়েছি এরপর বাবা দুটো শপথ করালেন৷ সেটা একান্ত ব্যষ্টিগত হওয়ায় এখানে তা আর উল্লেখ করলাম না (এরপর) ৰাৰা আমার জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি আসন ও মুদ্রা দিলেন যা পরে বিজয়ানন্দদার কাছে শিখে নিয়েছিলাম৷

ৰাৰার বেত্রাঘাত এতখানি হয়েছিল যে আমি সেদিন  বাসায় ফিরে গিয়ে বেশী চলাফেরা করতে পারিনি৷ কোমরের দুপাশে ছড়ির দাগ স্পষ্ট হয়েছিল, প্রায় সাতদিন অবধি ঐ দাগ ছিল৷ আমার কর্মস্থল মদনমোহনচক চৌধুরী বিদ্যাপীঠ ফিরে গিয়ে কয়েকদিন কারও সামনে জামাকাপড় পরিবর্তন করিনি, সবার অলক্ষ্যে কোনরকম স্নান সেরে পুনরায় জামাকাপড় পরে নিতাম৷ শাস্তির ফল সাধারণত কষ্টদায়ক হয়, কিন্তু এ শাস্তি যে এতখানি আনন্দদায়ক এবং পরিনামে হিতকারক হয়, তা আগে বুঝিনি, যে এই শাস্তি পেয়েছে সেই একমাত্র উপলব্ধি করতে পেরেছে৷ ধর্মসমীক্ষার পর বেশ কিছুদিন কী আনন্দ ও মানসিক প্রশান্তিতে কেটেছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না৷