পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন নিয়ে রাজ্যের শাসক ও বিরোধীপক্ষ কলহে মেতেছে৷ প্রায় অস্তিত্বহীন ছিন্ন ভিন্ন পশ্চিমবঙ্গের ওপর ৭৭ বছর ধরে যে শোষণের স্টিমরোলার চলছে তা নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি রাজনৈতিক দল৷ অথচ দিবস পালন নিয়ে কলহে মেতেছে৷ এই কলহ নিয়ে কিছু বলার আগে ৭৭ বছরের দিনগুলো একটু দেখে নিই–
সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে ১৯৪৯ সালে খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে শরৎচন্দ্র বসু বলেছিলেন– ‘‘পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন, তার আর্থিক সংকট বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে৷’’ ব্রিটিশ ভারতে অর্থনীতির ইতিহাসে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছিলেন–‘‘ব্রিটিশরা যে অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগ করেছে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ভারতের দারিদ্র৷ এই নীতির ফল অন্যরকম হলে তা হত অলৌকিক৷ পৃথিবীতে অলৌকিক কিছু কখনও ঘটে না৷’’ এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সত্তর দশকের গোড়ায় সাংবাদিক রঞ্জিত রায় তাঁর ‘ধ্বংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ’ গ্রন্থের ভূমিকায় লেখেন–‘‘ব্রিটিশের অধীনে ভারতের অবনতির যেসব কারণ রমেশচন্দ্র দত্ত দেখিয়েছেন, স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্ব ভারতের অবনতির কারণ তার থেকে কিছু স্বতন্ত্র নয়৷ পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি তছনচ হয়ে গেছে৷’’ ওই পুস্তকেই রঞ্জিত রায় উল্লেখ করেছেন–‘‘১৯৭২–এর ২৫শে আগষ্ট লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের সমস্যার উপর বিতর্ক হয়৷ উত্তর দিতে উঠে তদানীন্তন পরিকল্পনা মন্ত্রী দুর্গাপ্রসাদ ধর স্বীকার করেন– ‘‘পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা ঔপনিবেশিক ধাঁচের৷’’ ওই পুস্তকে রঞ্জিত রায় আরও উল্লেখ করেছেন–বিধানচন্দ্র রায় থাকা সত্ত্বেও, ১৯৬২ সালে তাঁর মৃত্যুর বহুপূর্ব থেকেই অবনতি শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের৷’’ অর্থাৎ বিধান রায়ের হাত দিয়েই পশ্চিমবঙ্গ ধ্বংসের পরিকল্পনা নিয়েছিল নেহেরু সরকার৷ স্বাধীন ভারতে খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গ নতুন করে ঔপনিবেশিক শোষণের শিকার হয়৷
প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার অর্থনৈতিক শোষন বিষয়ে লিখেছেন–‘‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসানের পর ১৯৪৭ সালে বাঙলা বিভাগের মধ্যদিয়ে এল ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যুগ৷ স্বাধীনতা লাভের প্রথম পর্বে ক্ষুদ্র পশ্চিমবঙ্গ ছিল ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে সবচেয়ে বেশী অগ্রসরমান রাজ্য৷ পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক আয় ছিল অন্যান্য রাজ্যের আঞ্চলিক আয় অপেক্ষা বেশী৷ বহু বাঙলার শিল্পপতি তখনও পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে বিরাজ করত৷ বহিরাগত শোষকরা তাদের পরিকল্পনা মাফিক পশ্চিমবাঙলার শিল্প ও বাণিজ্যের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র থেকে বাঙলার শিল্পপতিদের উৎখাত করতে শুরু করে৷ স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই বাঙলা–বঞ্চনার কাজ নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক শুরু হয়ে যায়৷’’
স্বাধীন ভারতের জন্মলগ্ণ থেকেই বাঙলা নতুন করে ঔপনিবেশিক শোষণের শিকার হলো স্বদেশী সাম্রাজ্যবাদের হাতে৷ কিন্তু প্রশ্ণ হল দেশ তো স্বাধীন৷ কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই কংগ্রেস দলের শাসন৷ প্রায় দীর্ঘ ৩০ বছর কংগ্রেস পরবর্তী ৩৫ বছর বামফ্রন্টের ‘ব’ কলমে সিপিএম রাজত্ব করেছে৷ তাতে স্বদেশী সাম্রাজ্যবাদী শোষনের কোন হের–ফের হয়নি৷ কংগ্রেস ভেঙে তৈরী আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেও সেই শোষনের বিরুদ্ধে যাবার সাহস দেখাতে পারেনি৷
স্বাধীনতার ৭৭ বছরে দিল্লির শাসনে নেহেরু থেকে নরেন মোদি কেউ বাঙলার বন্ধু নয়৷ দিল্লীর সরকার স্বদেশী সাম্রাজ্যবাদী শোষকেরই তল্পিবাহক৷ কিন্তু বাঙলার শাসনে যারা থেকেছে বিধান রায় থেকে জ্যোতি বসু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মমতা বন্দোপাধ্যায় কেউ এই শোষণের বিরুদ্ধে একটা কথা বলারও সাহস দেখাননি৷ একই কংগ্রেস শাসনে খণ্ডিত পঞ্জাব যেভাবে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করেছে ও আর্থিক উন্নতি ঘটিয়েছে, সমস্ত রকম সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাঙলা তার ছিটে ফোঁটাও করতে পারেনি৷ বরং বাঙলার সম্পদ লুন্ঠিত হয়ে চলে যাচ্ছে উত্তর পশ্চিম ভারতে৷ পশ্চিমবঙ্গ আজ স্বাধীন ভারতের নয়া উপনিবেশ৷
আজ পশ্চিমবঙ্গে যে দলই শাসন ক্ষমতায় থাক–কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি কারও সাধ্য নেই বাঙলার সমস্যার সমাধান করার, যতদিন না এই ঔপনিবেশিক শোষণ বন্ধ করতে দিল্লিকে বাধ্য করা যায়৷ কিন্তু আকন্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি সে পথে যেতে পারবে না৷
আজ পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা সত্যই বিপজ্জনক৷ বাঙালী যদি এখনও সজাগ না হয়, তবে কলকাতাতেই একদিন অসমের মত বাঙাল খেদাও আন্দোলন শুরু হবে৷ তাই আজ যেখানে বাংলা ও বাঙালীর অস্তিত্ব বিপন্ন, তার ভূমি টুকরো টুকরো করে পাশ্ববর্তী রাজ্য দখল করে বসে আছে, সেই দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শাসক বিরোধী পক্ষের এই দিবস পালনের কলহ কার স্বার্থে? এতে বাঙালী জনগোষ্ঠীর কোন কল্যাণ হবে
- Log in to post comments